আমি আমার একটি ফেইসবুক পোস্টে লিখেছিলাম ‘শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেননি, সেই সময় তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন জিয়াউর রহমান।’
প্রথম আলোতে খান মোহাম্মদ রবিউল আলম লিখেছেন,
“শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেননি বলে ফরহাদ মজহার যে মন্তব্য করছেন, তার প্রতি-উত্তরে বলা যায়, তাহলে এ দেশে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ কী ঘটেনি? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৫৫ বছর জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে বন্দী ছিলেন। তবে কি তিনি আরাম-আয়েশ, ভালো খাবার দাবার, আশ্রয়ের আশায় কারাগারে বন্দী ছিলেন?”
আমার লেখায় কোথাও এই ধরনের কথা নাই। আমার মন্তব্য সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ে মন্তব্য। শেখ মুজিবর জেলে ছিলেন, যুদ্ধ করেন নি। খান মোহাম্মদ রবিউল আলমের সেক্টর জানা থাকলে, জানাবেন। রাজনীতিতে শেখ মুজিবর কি করেছেন বা করেন নি, সেটা ভিন্ন তর্ক। কুতর্ক এবং মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া আওয়ামি-ফ্যাসিস্ট বয়ান প্রতিষ্ঠিত রাখবার কৌশল।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় নি। সেটা শুরু হয়েছে ২৫ মার্চের পরে। শেখ মুজিবরের বক্তৃতা কিম্বা তার পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকা আর সশরীরে যুদ্ধ ক্ষেত্রে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করা এক কথা নয়। শেখ মুজিবরের কাছ থেকে আমরা তা আশাও করি না। অন্যদিকে তার অবদানকে খামাখা সম্প্রসারিত করা এবং বাস্তব সত্য অস্বীকার করে তাকে ‘মহানায়ক’ বানাবার নানান বয়ানই বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করবার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ট্রাজিক পতনের পর ফ্যাসিস্ট শক্তি ১৫ অগাস্ট সামনে রেখে যখন সশস্ত্র হামলার মহড়া প্রদর্শন করছে তখন মোহাম্মদ রবিউল আলম সেই আওয়ামি-ফ্যাসিস্ট বয়ানেরই প্রতিধ্বনি করলেন। এটা ঠিক নয়।
তিনি আরো লিখেছেন, “কিন্তু যখন কেউ বঙ্গবন্ধুকে সংকোচনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছেন বা তাঁর সম্পর্কে দ্রুত উপসংহারমূলক মন্তব্য করছেন, তখন তা জটিল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ কারণে যে তা কি ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ? আমরা কি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্বিচার মন্তব্য করব, সংকোচনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নেব। নাকি খোলামন নিয়ে দেখব”।
অর্থাৎ আমার মন্তব্য ‘সংকোচনবাদী’, এবং আমি “দ্রুত উপসংহার মূলক মন্তব্য” করেছি। ‘ঐতিহাসিক-তথ্য প্রমাণের সঙ্গে’-তা সাযুজ্যপূর্ণ কিনা সেই প্রশ্নও তিনি তুলেছেন। বেশ।
‘মুক্তিযুদ্ধ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারণা। যার মধ্যে যুগপৎ রাজনৈতিক বা আদর্শগত লড়াই এবং একই সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে সশস্ত্র যুদ্ধের ধারণার জড়িত।
প্রথমত যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রসঙ্গে আসি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের উপর আক্রমণ করে, জিয়াউর রহমান তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তিনি তার বাহিনীর পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দি করে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন, সেটা ছিল একজন তরুণ সৈনিকের ঐতিহাসিক এবং অসম সাহসিক কীর্তি। শুধু তাই নয়, তিনি সশস্ত্র হানাদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
শেখ মুজিবর তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে কারাবন্দী হয়েছেন। সেটা ঠিকই ছিল। শেখ মুজিবের পার্লামেন্টারি বা সংসদীয় রাজনৈতিক আদর্শ আর সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ সাংঘর্ষিক। পার্লামেন্টারি রাজনীতির সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের ধারণা বা প্রয়োগ যায় না। তাই তিনি যুদ্ধের কোন প্রস্তুতিও নেন নি।
তাহলে বুঝতে হবে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও অর্জন নিছকই সংসদীয় গণতন্ত্র কিম্বা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা নয়। তাই শেখ মুজিবর রহমান সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেন নি, তার কোন প্রস্তুতিও তিনি নেন নি সেটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পর্যালোচনা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাংলাদেশের জনগণের ওপর হামলা শুরু করলে শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় তাদের কাছে বন্দী হন। এই জন্যই মতাদর্শ এবং সামরিক উভয় অর্থেই বলেছি শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করেন নি।
কিন্তু এর জন্য আমি শেখ মুজিবরের সমালোচনা করি নি এবং করব না। কারন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ তাঁর রাজনীতি ছিল না। শেখ মুজিবর ফিডেল ক্যাস্ট্রো বা হোচি মিন ছিলেন না। তিনি হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির আদর্শে বিশ্বাস করতেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি সিয়াটো এবং সেন্টোর বিরোধিও ছিলেন না। শেখ মুজিবর যা করেন নি তাকে সেই গৌরব দেওয়া যেমন ইতিহাস অস্বীকার করা, তেমনি অন্যদের গৌরব অস্বীকার করাও ইতিহাস ও রাজনীতির দিক থেকে অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। এর চরম মূল্য বাংলাদেশের জনগণকে বাহাত্তর সাল থেকে দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে।
জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদ ছিলেন না। কিন্তু একজন বীর সৈনিক ছিলেন। শুধু তাই নয় ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তিনি শেখ মুজিবর রহমানের নামে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সমর্থনে একটি বিবৃতি পাঠ করেন এবং দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি শুধু বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন তা নয়, প্রথাগত নির্বাচনবাদী বা সংসদীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতাও তিনি এবং অন্যান্য বীর সৈনিকেরা প্রমাণ করে দিলেন।
জিয়াউর রহমানের এই সামরিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার তাৎপর্য গভীর। যা আমরা খুব কমই আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে আলোচনা করেছি। শেখ মুজিবের রাজনীতির মধ্য দিয়ে যে গণচেতনার বিকাশ ঘটেছে শেখ মুজিবরের নাম গ্রহণের মধ্য দিয়া জিয়াউর রহমান তাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ স্বাধীনতাকামী গণচেতনার ধারাবাহিকতা শেখ মুজিবরের মধ্য দিয়ে নয়, জিয়াউর রহমানের মধ্যে দিয়েই ধাবিত হয়েছে। এটাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ধারা। ইতিহাসের এই ভেদচহ্নগুলো আমাদের সতর্কতার সঙ্গে চিহ্নিত করতে হবে। জিয়াউর রহমানের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাকে সেই আলোকেই পাঠ করতে হবে।
তাই জিয়াউর রহমানই মুক্তিকামী গণচেতনার ধারাবাহিকতা হিশাবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, শেখ মুজিবর রহমান নন। । সৈনিকদের এই অবদান ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হোত না। তাই জিয়াউর রহমান নিজের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন নি। কার্যত তিনি ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা কিন্তু একই সঙ্গে ছেদও বটে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই শেখ মুজিবরের প্রাদেশিক স্বায়ত্ব শাসনের দাবি বাংলাদেশ স্বাধীনতার দাবিতে পরিণত হয়েছিল। সশশ্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সেই রাজনীতিরই ধারাবাহিকতা, কিন্তু সেটা শেখ মুজিবরের ধারা নয়।পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কোন ধারা নাই।
তত্ত্বগত ভাবে এর তাৎপর্য কি? জিয়াউর রহমান বুঝিয়ে দিলেন যুদ্ধ – বিশেষত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ রাজনীতি্রই সম্প্রসারণ। এর জন্য তাকে হোচি মিন বা মাওজে দং পড়তে হয় নি। শেখ মুজিবর সেটা বোঝেন নি। অবশ্য শেখ মুজিবরের কাছ থেকে আমরা তা আশা করতেও পারি না। রাজনীতি ও যুদ্ধের সন্ধিবিন্দু্র ধারণা শেখ মুজিবর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের অন্তর্গত ছিল না।
জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর বাংলাদেশ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকার সময় সংবিধান লংঘন, শেখ মুজিবের হত্যার সঙ্গে যেসব মুক্তিযোদ্ধা জড়িত ছিলেন তাদের দেশত্যাগে সহায়তা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের অভিযোগে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তার ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীর সৈনিকদের অবদান অস্বীকার করবার দুঃসাহস। আওয়ামী লীগ ক্রমাগত এই ধরণের অপকর্ম করেছে। ব্যাক্তির অর্জন ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার যে ফ্যাসিস্ট ধারা আওয়ামী লীগ প্রবর্তন করেছে জুলাই বিপ্লব সেই ফ্যাসিস্ট ধারার বিরুদ্ধে জনগণের জবাব।
শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থেকেও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, এই ধরণের অবাস্তব ও হাস্যকর দাবি শেখ মুজিবরকে ‘মহানায়ক’ বানাবার ফ্যাসিস্ট প্রকল্পের অংশ। এই বয়ান থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে।
আশা করি শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর আমরা আওয়ামি-ফ্যাসিস্ট বয়ান প্রত্যাখান করব এবং যার যা অবদান তা নির্মোহ ভাবে বিচার ও মূল্যায়ন করবার শক্তি অর্জন করব।
ফরহাদ মজহার- এর টাইম লাইন থেকে নেয়া।