০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:২০:৪০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


আমান আযমী’র বক্তব্যের নেপথ্যে কি?
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৯-২০২৪
আমান আযমী’র বক্তব্যের নেপথ্যে কি? আবদুল্লাহিল আমান আযমী


বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী’র বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের গোপন বন্দীশালা আয়নাঘর থেকে বের হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আযমী’র বক্তব্যের নেপথ্যে কি? তার এমন বক্তব্য আসলে কাকে লাভ দিলো? কে বা কারা এমন বক্তব্যের ফসল ঘরে তুললো বা তুলতে চাইছে? এসব নানান ধরনের কৌতুহল অনেককে ভাবিয়ে তুলেছে। এর পাশাপাশি আরও রহস্যময় ঠেকেছে যখন আযমী’র বক্তব্যকে তার ব্যক্তিগত বলে দাবি করে জামায়াতে ইসলামী পিছুটান দিয়েছে। 

কি বলেছেন আযমী?

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার থাকা অবস্থায় ২০০৯ সালে বরখাস্ত হন আমান আযমী। জামায়াতের ইসলামীর সাবেক আমির মরহুম গোলাম আযমের মেজো ছেলে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী গত ৬ আগস্ট মুক্তি পান সেই আওয়ামী লীগ আমলের কুখ্যাত বন্দীশালা আয়নাঘর থেকে। আমান আযমীকে ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে আট বছর গোপন বন্দিশালায় রাখা হয়। আর মুক্তি পেয়েই সম্প্রতি তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রথমে স্বশরীরে সংবাদ সম্মেলন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও পরে ভার্চ্যুয়ালি সে-টি সেরে ফেলেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্থিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন। এর পাশাপাশি আযমী বাহাত্তরের সংবিধান ‘বৈধ নয়’ মন্তব্য করে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি জানান। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও। তিনি বলেন, “শেখ মুজিব সাহেব ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলেছেন এবং এটাই ৩০ লাখ হয়ে গেছে। কোনো জরিপ ছাড়া ৩০ লাখ শহীদ বলে বলে তারা মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।

দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া

এদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীতসহ জনসাধারণের আবেগ ও অনুভূতির বিষয়কে নিয়ে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী’র এমন বক্তব্যে পড়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন। প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ৪৮ বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে তারা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় সংগীত নিয়ে যে কোনো অপপ্রচার এবং ঔদ্ধত্য ও হীন তৎপরতা বন্ধেরও আহ্বান জানান। আর তা না হলে এর বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে বড়ো ধরণের কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। বিবৃতিদাতারা হলেন- ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, নিজেরা করি'র, সমন্বয়ক খুশি কবীর, অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী, সিনিয়র অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি উপাচার্য পারভীন হাসান, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মো. হারন-অর-রশিদ, অ্যাডভোকেট তবারক হোসেন, আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলম, এএলআরডি'র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, লেখক রেহনুমা আহমেদ, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক ঈশানী চক্রবর্তী, অধ্যাপক জোবায়দা নাসরিন, অধ্যাপক মাহা মির্জা, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ল্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক ড. সাদাফ নুর প্রমুখ। 

এদিকে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, ‘৭১ সালের মার্চ মাসেই স্বাধীনতার ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নামকরণ, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতসহ মৌলিক প্রশ্ন নিষ্পত্তি করেই রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ ও তার অনুষঙ্গ একটি মীমাংসিত জাতীয় ইস্যু । এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা দেশদ্রোহিতার শামিল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, জাতীয় সংগীত, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ও জাতীয় পতাকার ওপর আঘাত ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ।

টনক নড়লো জামায়াতের

এদিকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দন্ডিত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আমান আযমীর বক্তব্যের পর সারাদেশে নানান ধরনের বির্তকে স্বভাবতই দায়ভার গিয়ে পড়ে জামায়াতের ওপর। তবে দেরিতে হলেও টনক নড়ে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী এই দলটির। জাতীয় সংগীত নিয়ে সাবেক ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর দেওয়া বক্তব্যটি তার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত, তিনি দলের কেউ নন বলে জানিয়ে দেয় জামায়াতে ইসলামী’র নেতারা। গত ৮ সেপ্টেম্বর রোববার এক বিবৃতিতে এ কথা বলেছেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এতে আরো বলা হয়েছে, আমান আযমী জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। জামায়াতের সঙ্গে তার সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই। তিনি জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা তার একান্ত ব্যক্তিগত। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তার (আমান আযমী) বক্তব্যকে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার সুযোগ নেই। তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জামায়াত সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অবকাশ নেই। 

আযমী’র প্রশ্নবোধক বক্তব্য ও জামায়াতের পিছুটান

রাজনৈতিক অঙ্গনে আমান আযমী’র এমন বক্তব্য নিয়ে নানান ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পরপরই বিএনপি ও ছাত্রদলের অনেক গুম হওয়া নেতাকর্মীদের হদিস এখসো মিলছে না। এখনো যখন তাদের বাড়িতে কান্নার রোল ঠিক তখনই সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী মুক্তি পেলেন। তাকে কি অবস্থায় রাখা হয়েছিল-এসবসহ আরো অন্যদের খবর সংবাদ কর্মীদের পাশাপাশি অন্যরা আশা করেছিলেন। কিন্তু সে-সময়ে ঠিক খুব একটা সেদিকে না গিয়ে আমান আযমী’র মুখে দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বক্তব্য রহস্যজনক ঠেকেছে অনেকের কাছে। প্রশ্ন উঠেছে এমন বির্তকিত বক্তব্য দিতে তাকে কে সাহস যুগিয়েছে? অন্যদিকে তার বক্তব্য নিয়ে যখন দেশ অনেক উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তখন জামায়াত এর সুদুর প্রসারী প্রতিক্রিয়া টের পেয়ে আমান আযমী’র দেয়া বক্তব্যতে তাদের দলের নয় বলে প্রচার করেছে-যা অনেকের কাছে দলটির পিছুটানই মনে করে। এটাকে অনেকে বলেছেন, জামায়াত ইসলামী এমন বহু নেতা কর্মী বা দলের বিশিষ্টজনকে মাঠে নামিয়ে কুলকিনিরা না পেলে বা বির্তক দেখা দিলেই তার পক্ষ ত্যাগ করে, দেয় পিছুটান। অনেকে মনে করেন যতই পিছুটানই দিক না, তবুও আমান আযমী’র এমন বক্তব্যে কারণে সুদুর প্রসারী প্রতিক্রিয়ায় ঠিকই জামায়াতকে বেকায়দায় ফেলেছে। কেননা দলটি এখন দেখা যাচ্ছে বর্তমানে ভোল পাল্টিয়ে ও সবকিছু বদলিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতের সাথে মধুর সম্পর্ক গড়তে উঠে পড়ে লেগেছে। আর ঠিক এমন সময়ে আমান আযমী’র দেয়া বক্তব্য জামায়াতকে বিব্রত করেছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সে-জন্যই কি আমান আযমী’র বক্তব্যকে দলটির নিজের না বলে দেয়া হলো পিছটান? কারো কারো মতে, আমান আযমী’র এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে সম্প্রতি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিরা নিরব থাকবে। আর সেসুযোগে জামায়াত হাত গুটিয়ে তাদের অতীত দম্ভ নিয়ে মাঠে বিচরণ করবে। কিন্তু সারা দেশে আমান আযমী’র বক্তব্য নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় দেখা দিলে দৃশ্যপট থেকে এমন ব্যক্তিকে জামায়াত ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধা করেনি। 

ছাত্রদের সাথে বিভেদ সৃষ্টিতে উস্কানি?

এদিকে কারো কারো মতে, সাবেক ব্রিগেডিয়ার আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর পক্ষ থেকে দেয়া এধরনের বক্তব্য দেয়ার মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে চলে এসেছে। তার পক্ষ থেকে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে সবারই ধারণা ছিল যে আট বছর ‘গুম করে রেখে’ তার উপর চালানো নির্যাতনেরও বর্ণনাতেই তিনি থাকবেন। কিন্তু ওই সংবাদ সম্মেলনে তা-কে কুখ্যাত বন্দীশালা আয়নাঘরে রাখার পাশাপাশি বন্দী থাকা অবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্যের চেয়ে অন্য বিষয়ে বক্তব্য দেয়া নিয়ে বেশি আগ্রহ ও মারাত্মক সন্দেহের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কেনো তিনি এমন বক্তব্য দিলেন? তিনি কি চলমান পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন বিভেদ সৃষ্টি করতে এমন বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি কি বোঝাতে চান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সর্বস্তরের জনতার আন্দোলনটি কোনো একটি মতার্দশের শক্তি নেপথ্য কাজ করেছে। না-কি বোঝাতে চান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনটি দেশের একাত্তরের চেতনার বিপরীতে কাজ করেছে? কেননা সেই আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানান ধরনের কালিমা লেপনের চেষ্টা করেছে। এখন এই আমান আযমী কি করে আশা করলেন বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা-র এমন দাবির প্রতি সহানুভুতিশীল হবে? তিনি কি চেয়েছেন বা আশা করছেন ২০২৪ সালে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিজয়কে ৭১-এর বিজয় কিংবা মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে দাঁড় করতে বা করাতে...? যেনো এই ইস্যুতে রাজনৈতিক মাঠে একটা বড়ো ধরনের বিভেদ তৈরি হয়ে ঘোলা পানিতে কেউ মাছ শিকার করুক-এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মাঠে।

শেয়ার করুন