নিউইয়র্কের বাসগুলোতো ইদানীং একটা সাইন ভেসে ওঠে। আর তাহলো, ফেয়ার রিকোয়ার্ড। অর্থাৎ ভাড়া দিন। এতো বেশি যাত্রী বিনা ভাড়ায় বাস ভ্রমণ করে যে, অবশেষে বিরক্ত হয়ে সম্ভবত তারা এ সাইন দিতে বাধ্য হয়েছে।
আমার মতে, সম্ভবত অর্ধেকেরও বেশি যাত্রী প্রতিদিন ভাড়া না দিয়ে বাস ভ্রমণ করে। আমি আমার বাংলাদেশি কমিউনিটির কথা বলছি। আমি থাকি পার্কচেস্টারে। ওভাল পার্ক থেকে আমি আমার দেশি ভাইদের বাস ভ্রমণের সময় যা প্রত্যক্ষ করি, তাহলো তাদের প্রায় ৯৯ শতাংশ ভাড়া দেন না। এমটিএ কর্তৃপক্ষের এসব আকুতি তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে বলেও মনে হয় না।
এ ব্যাপারে একটা গল্প মনে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রছাত্রীরা একসময় লন ক্রস করে হলের রুমে ঢুকতো শর্টকাট যাওয়ার জন্য। হল কর্তৃপক্ষ পায়ে চলা এ রাস্তার ওপর একটি বেড়া দিলেন। শিক্ষার্থীরা তখন বেড়ার পাশ দিয়ে নতুন রাস্তা তৈরি করে। আবার বেড়া দিলে আবার নতুন রাস্তা। কর্তৃপক্ষ শেষে বিরক্ত হয়ে একটা নতুন সাইনবোর্ড লাগায় শিক্ষার্থীদের বিবেক জাগ্রত করার জন্য। তাহলো, ভদ্র লোকেরা লন ক্রস করে না। আমি জানি না, আগামীতে এমটিএ কর্তৃপক্ষ এমন কোনো স্লোগান তৈরি করে কি না, যাতে বিনা টিকেটের যাত্রীদের বিবেক জাগ্রত করা যায়!
কালো যদি মন্দ তবে-
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের একটি গানের কথা, ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দো কেনে?’ নির্দিষ্ট এ রংটি নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তেই কত কথা, কত দ্বন্দ্ব, কত অবহেলা। আমাদের এ উপমহাদেশে তো এই ‘কালো’ রং নিয়ে তাচ্ছিল্য আর অবহেলার শেষ নেই। আধুনিক এ সময়ে এসেও আধুনিক মানসিকতার মানুষেরাও সাদা-কালোর হিসাব-নিকাশের পাল্লা নিয়ে বসে থাকেন। বলিউডে তো হরহামেশাই গায়ের শ্যামবর্ণের জন্য অনেক নামজাদা তারকাও হেনস্তা হন। অনেকে এর প্রতিবাদ করেন, অনেকে আবার নিজেদের মেধা আর কর্ম দিয়ে বুঝিয়ে দেন কালোর প্রভাব আর প্রতাপ।
প্রসঙ্গটা এলো নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এলে বিরোধীদের কালো পতাকা প্রদর্শন নিয়ে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে প্রায় প্রতিবারই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক এসেছেন। আর প্রতিবারই বিএনপিসহ বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ জেএফকে বিমানবন্দর, তার হোটেলের সামনে এবং বক্তৃতার দিন জাতিসংঘের সামনে কালো পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। আর প্রতিবারই এ সমাবেশ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠন বিরোধীদের এ কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছে।
এবার রাজনৈতিক পটভূমি ভিন্ন। শেখ হাসিনা পলাতক। বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অন্তর্র্বর্তী সরকার। তার প্রধান হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক এসেছেন উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার আগমন উপলক্ষে জেএফকে বিমানবন্দরে কালো পতাকা নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠন। তারা আরো ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের সদর দফতরের সামনে প্রধান উপদেষ্টাকে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি পালন করবে।
এতোদিন এই কালো পতাকা প্রদর্শনকে তারা খারাপ বলে জানতেন, এখন সে কাজটিই তারা নিজেরাই করতে চলেছেন-ব্যাপারটা প্রবাসে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ!
‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ’-এ উক্তিটিকে বাংলা সাহিত্যের ‘প্রথম রোমান্টিক উক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেটি ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসে প্রথম সাক্ষাতে কপালকুন্ডলা নবকুমারের উদ্দেশ্যে করেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুন্ডলা’ উপন্যাসের এ উক্তিটি আমাদের দেশের জন্য এক সর্বজনীন প্রতীকী বাক্যে পরিণত হয়েছে। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, সবকিছুই যেন পথভ্রষ্ট। প্রতিনিয়ত মনের মধ্যে কপালকুন্ডলার এই উক্তিটি উঁকি দেয়, ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’
প্রসঙ্গটা এলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির বিভিন্ন নেতার সাম্প্রতিক বিভিন্ন উক্তি প্রসঙ্গে। ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তর্র্বর্তী সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে জনগণ মানবে না। তাই দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচিত সরকারই ঠিক করবে কী সংস্কার হবে।
নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে বিএনপির চিন্তাধারা নিয়ে এখন আলোচনা জোরালো হচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে বক্তব্যে ‘ভিন্নতা’ দেখা যাচ্ছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্য।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের একদিন পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকায় এক জনসভায় বক্তব্য দিয়েছেন। তারেক রহমানের সে বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নির্বাচন নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো করা কিংবা ‘অবিলম্বে নির্বাচনের’ কোনো দাবি তোলেননি তিনি। তারেক রহমান অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও সেটি কবে নাগাদ করতে হবে সে সম্পর্কে কিছু বলেননি তিনি।
দু’জনের বক্তৃতা বিবৃতি দেখে কপালকুন্ডলার মতো প্রশ্ন জাগে-বিএনপি তুমি কি পথ হারাইয়াছ?
নিউইয়র্ক, ২২ সেপ্টেম্বর ২৪