বৈষম্যবিরোধীই মূল স্লোগান। আওয়ামী লীগ হটাতে ঐক্য হওয়া ছাত্র-জনতার এ শক্তি এখন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু ছাত্র জনতার এ শক্তি কী তাদের মত পুরাপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে অর্ন্তবর্তী সরকারে? প্রশ্ন আসতেই পারে, যাদের রক্তের উপর দিয়ে স্বৈরাচার হটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, তারা আবার তাদের মত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হবেন কেন? বাস্তবতা ভিন্ন। ছাত্রশক্তি এখন নানাভাবে উপেক্ষিত। তাদের মতের গুরুত্ব যথেষ্ট কমে গেছে বলে উপদেষ্টাদের বিভিন্ন স্ট্যাটাসে উঠে আসছে।
একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের যে ক’জন সমন্বয়ক তারাও অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস না পেরুতেই হতাশা জানান দিচ্ছেন। যার মর্মার্থ তাদের মত প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। দেড় সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার রক্ত, প্রায় কুড়ি হাজার মানুষের চোখ, হাত, পাসহ বিভিন্ন অঙ্গহানির মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের রূপরেখার স্বপ্ন দেখেছিল, সেটাতে রাজনৈতিক দলসমূহের অনেকেরই মন নেই। সবার চোখেই ক্ষমতা। সবাই ছাত্রদের পাশ কাটিয়ে প্রভুদেশ খোঁজার মিশনে। যাদের কিছুটা নেক দৃষ্টি পেলেই ক্ষমতার মসনদের ঘ্রান পেতে সহজতর হয়ে যাবে।
অনেক রাজনৈতিক দল যে স্বৈরাচারের যাঁতাকলে বহু নেতাকর্মীকে ইহজগত ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছে, লাখ লাখ নেতাকর্মী মামলা হামলায় জর্জরিত হয়ে একটা জেনারেশন নষ্ট করে দিয়েছে। সংসার ব্যবসা হারিয়ে রাস্তায় নেমে গেছেন। এখন এদেরকে এড়িয়ে সেই ১৬ বছর শাসন করা আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের, যুবলীগের দরদে, সত্যিকারের রাজনৈতিক পরিবেশ উপহার দেয়ার মন্ত্র আওড়িয়ে পতিত সরকারকে ফিরিয়ে আনা বা তাদের প্রতিষ্ঠা করে রাজনীতিতে জিইয়ে রাখার মিশনে নেমেছেন অনেক বড় দল। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় মায়া কান্না ছিল। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের আলোচনা উঠলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কতিপয় নেতা কঠোর বিরোধীতা করে বসেন।
এমন প্রেক্ষাপট কী ইঙ্গিত করে সেটা আর বুঝার বাকি নেই। অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলছেন, “কাজেই, এবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেওয়ার অর্থ হলো, আজ থেকে ২০ বছর পর আমাদের ৪০০০ সন্তানের মৃত্যু পরোয়ানাতে স্বাক্ষর করা, কথাটা যেন আমরা মাথায় রাখি।”
সত্যিকার অর্থেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও শুরু করেছে একযোগে অনেক রাজনৈতিক দল। মাত্র আড়াই তিন মাসের ব্যবধানে জুলাই আগষ্টের গণহত্যার শিকার যেসব ছাত্র জনতা বা আহতদের চোখের আড়াল করে দিয়েছেন রাজনীতিবিদদের অনেকেই। নিহতের নাম মুখে আনছেন না, পরিবারেরও খোঁজ নিচ্ছে না কেউ। আহতদের চিকিৎসা নিতে আন্দোলন করতে হয়।
এমতাবস্থায় নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষার চিন্তা শুরু করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। নিজেরাই এমন প্রেক্ষাপট দেখে মন্তব্য করছেন যে রাজনীতিবিদদের হাত মেলানো শুরু। আর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে থাকাদের ফাঁসির দড়িও দ্রুত এগিয়ে আসছে।
এহেন প্রেক্ষাপটে নতুন দল গঠন করে রাজনীতির মাঠে পাকাপোক্তভাবে টিকে থাকার চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ সংশ্লিষ্টরা। এর আগেও একবার রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা ছিল। কিন্তু এবার অনেকটাই স্পষ্ট করলো তারা। এবং আগামী জানুয়ারিতেই ওই দল ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা নাহিদ ইসলামকে নেতৃত্বে রেখে দল গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দলের নাম এখনো চূড়ান্ত না হলেও তারুণ্যনির্ভরই হচ্ছে দলটি। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বিভিন্ন জেলা সফর করেছেন। ওই সময় নতুন দল গঠনের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত এই প্ল্যাটফর্মকে সাংগঠনিক রূপ দিতে গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। একই সঙ্গে গঠন করা হয় জাতীয় নাগরিক কমিটি। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠনে কাজ করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি। দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়েও কিছুদিন ধরে কাজ করছেন। তারা মনে করেন, বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে মানুষ নতুন রাজনৈতিক শক্তিকে দেখতে চায়।
জানা গেছে, জানুয়ারিকে সামনে রেখেই তাদের প্রস্তুতি চলছে। জানুয়ারিতে তারা নতুন একটি রাজনৈতিক দল ঘোষণা করতে পারেন। অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে নেতৃত্বে রেখেই তারা দল গঠনের চিন্তা করছেন। ওই সূত্রটি আরও বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের উদ্যোগেই নতুন এই দল হবে। নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা এবং বাইরের বিভিন্ন দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন হতে পারে এই দল। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও চলছে বলে জানা গেছে।
নতুন দল গঠন করলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি থাকবে। প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করবে এই দুটি সংগঠন।
নাম প্রকাশ না করে জাতীয় নাগরিক কমিটির শীর্ষপর্যায়ের এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নাহিদ ইসলামকে সামনে রেখে আমরা জানুয়ারিতে দল গঠনের বিষয়ে ভাবছি। সে ক্ষেত্রে তাকে দল গঠনের আগে উপদেষ্টার পদ ছাড়তে হবে। সবকিছু চূড়ান্ত হলে আমরা আশা করি, সেটি তিনি করবেন। নাগরিক কমিটি ঢাকাসহ দেশের সব থানাপর্যায়ে কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলাপর্যায়ে কমিটি করার কাজ করছে। জানুয়ারির মধ্যেই সেটি সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে আমরা আশাবাদী।’
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষপর্যায়ের আরেক জন নেতাও প্রায় একই কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তারুণ্যনির্ভর দল গঠন করতে চাই। দেশের জনগণ তরুণ নেতৃত্বকেই বেছে নেবেন। তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে নাহিদ ইসলামকেই আমাদের যোগ্য মনে হয়েছে।’
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা শুরু হয় গত সেপ্টেম্বরে। ৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র পুনর্গঠন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও ‘নতুন বাংলাদেশের’ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সফল করার লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির ৫৬ সদস্যের একটি কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রায় একই সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও বিভিন্ন জেলায় সফর শুরু করেন। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫টি জেলায় তারা কমিটি ঘোষণা করেছেন। বাকি জেলাগুলোও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটি ঢাকায় ২০টির বেশি থানা পর্যায়ের কমিটি ঘোষণা করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘জানুয়ারির আগে আগে আমরা সব জেলার কমিটি ঘোষণা করব।’
তবে সবই যে ছাত্রজনতা থাকবে এর পেছনে ঠিক এমনটা নয়। বর্তমানে উপদেষ্টাদের মধ্যে যারা সরাসরি কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন এমনরাও এ দলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন।