১৬ জানুয়ারী ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৮:০১:৪২ পূর্বাহ্ন


অগ্রাধিকারে চলতে হবে সংস্কার ও নির্বাচন কার্যক্রম
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০১-২০২৫
অগ্রাধিকারে চলতে হবে সংস্কার ও নির্বাচন কার্যক্রম প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস


বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় তুমুল বিতর্ক চলছে। নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে। নিতান্ত নিরীহ গোছের কোটাবিরোধী আন্দোলন পূর্ববর্তী আওয়ামী সরকারের ভ্রান্ত কৌশলের কারণে পর্যায়ক্রমে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শেষে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ইতিহাস সৃষ্টি করে পতন ঘটে ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার। সংবিধান সমুন্নত রেখেই সেনাবাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার এবং নিরপেক্ষ, অবাধ, মুক্ত, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অঙ্গীকার নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে।

 দীর্ঘসময়ের অপশাসন, অবাধ দুর্নীতি, অর্থ লোপাটের কারণে ভঙ্গুর অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, বিপুল আর্থিক দায় দেন, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাঝে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে সরকার চতুর্মুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পাঁচ মাস সময়ে কিছু অর্জন করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকারের বিবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজ জীবনে স্বস্তি এসেছে বলা যাবে না। বিশেষত কয়েকটি রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছে। আবার সরকার সমর্থক দুই একটি দল এবং ছাত্র-জনতার সংগঠিত একটি শক্তি আগে সব ধরনের সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথা বলছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সকল ধরনের সংস্কার করতে তিন-চার বছর সময় লেগে যেতে পারে। অনেক সংস্কার করা অনির্বাচিত খণ্ডকালীন সরকারের পক্ষে সম্ভব না। 

সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা এবং সরকার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সরকারের স্বরূপ বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। জুলাই-আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। চাঁদাবাজি, দখল, অবৈধভাবে ক্ষমতা অপব্যবহার, নতুন মোড়কে দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। বাজার ব্যবস্থাপনা, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আসেনি। জুলাই-আগস্ট এবং তত পরবর্তী সময়ের হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞের নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। সরকারের অনেক শিথিল ব্যবস্থার কারণে বেশ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। সচিবালয়ের মত সুরক্ষিত স্থানে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এগুলো থেকে বোঝা যায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দীর্ঘদিন দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারছে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের দাবি ১৯৭২ সংবিধান কবর দেওয়া, দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে সকল প্রকার কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করা। ১৯৭২ সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশ পরিচালনার অনন্য দলিল। সন্দেহ নেই নানা সংশোধনে মূল সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। তাই বলে যুদ্ধ জয়ী একটি দেশের সংবিধানকে কবর দেওয়ার মতো দাবি স্বাধীন দেশের দায়িত্বপূর্ণ নাগরিকদের দাবি হতে পারে না। সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য কমিশন করেছে। কমিশন জানুয়ারি ২০২৫ সুপারিশ প্রদান করলে সরকার রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সম্মত সংশোধন বিষয়ে সুপারিশমালা চূড়ান্ত করবে,পরবর্তী নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সংশোধিত সংবিধান সংসদে আলোচনা এবং বিতর্কের পর অনুমোদন করবে। সংবিধানের কিছু সংশোধনী ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালতের আদেশে বাতিল হয়েছে।

জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনের ৫ মাস পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ঢাকায় জাতীয় শহিদ মিনারে বিপ্লবের ইস্তেহার ঘোষণা করার ব্যবস্থা করেছিল। বিষয়টি নিয়ে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধী মনোভাবের কারণে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে সরকার নিজ উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে সম্মত ইশতেহার ঘোষণার কথা বলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নিভৃত করেছে।

সবাই জানে, সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার সুপারিশ করার জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এগুলো ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে সুপারিশ দেওয়ার কথা ছিল। একমাত্র শ্বেতপত্র প্রদান কমিটি একটি প্রাথমিক রিপোর্ট দেওয়া ছাড়া অন্য কমিটিগুলো রিপোর্ট দেয়নি। একটি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সূত্রে জানা গেল জানুয়ারি ২০২৫ শেষ নাগাদ কমিশনগুলো রিপোর্ট জমা দেবে। এরপর রিপোর্টগুলো বিষয়ে সরকার রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সংগত কারণেই অনেক তর্কবিতর্ক শেষে অনেক কাট চ্যাট করে সম্মত সুপারিশগুলো সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে ঘোষণা করবে। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার সংসদে অঙ্গীকার অনুযায়ী, সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে। বুঝতে হবে ১৯৭২-২০২৪ পর্যন্ত জমা হয় নানা অনিয়ম, অপশাসনের অর্গল ভেঙে সংস্কার সুপ্রিম করতেই ৬-৯ মাস সময় লাগতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো আন্তরিক হলে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অন্য সামাজিক শক্তিগুলো তাদের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করলে সংস্কার এবং নিবার্চনী কার্যক্রম যুগপৎভাবে এগিয়ে যেতে পারে।

সরকার কর্তৃক পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন কাজ শুরু করেছে। আদালত সংবিধানের সংশোধনী বাতিল করে কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান পুনরায় চালু করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। জানুয়ারি ২০২৫ এই বিষয়ে উচ্চ আদালতে সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে গঠিত কমিশনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সম্মত সংশোধনী অচিরেই এসে যাবে। এমতাবস্থায় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতে হলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিতে হবে। বাংলাদেশ অব্যশই রাজনৈতিক দল হিসেবে তারুণ্যকে অভিনন্দন জানাবে। স্মরণে রাখতে হবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় মূলধারার রাজনৈতিক দল থেকে বিচ্যুত হয়ে ডাকসাইটে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নতুন রাজনৈতিক দল করে হালে পানি পায়নি।

অনুভব করছি, দুই একটি রাজনৈতিক দল ভাবছে নির্বাচন হলেই তারা বিপুল ভোট পেয়ে সরকার গঠন করবে। আর তাদের নির্বাচনের জন্য তর সইছে না। আবার সরকার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকারের কার্যকাল দীর্ঘায়িত করে চলে বলে কৌশলে নিজেদের অনুকূলে প্রশাসন সাজিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে। যেভাবেই হোক স্মরণ রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকে অস্বীকার করে উগ্র ধর্মীয় গোড়ামির ভিত্তিতে কোন রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশে কখনো গ্রহণ যোগ্যতা পাবে না। সাধারণ মানুষ চায় দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা, সৎ মানুষের শাসন। সেটি নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্কার করে সরকার আন্তরিক থেকে ২০২৫ শেষ নাগাদ নির্বাচন করা যুক্তি যুক্ত হবে। দেশে কিন্তু দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সংকুচিত হয়ে আসছে। জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট ঘনীভূত হওয়ায় শিপ্লকারখানাগুলো সংকটে। অর্থনৈতিক সংকটে ঘনীভূত হচ্ছে। সবাই চায় জবাবদিহিমূলক নির্বাচিত সরকার। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের সংস্কার করে নির্বাচনে আসতে হবে। দেশের মানুষ ভোটের সিদ্ধান্ত দেবে কোন দলকে তারা দেশ শাসনে দেখতে চায়। সংস্কার উদ্যোগ এবং নির্বাচনী কার্যক্রম যুগপৎভাবে চলায় কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।

শেয়ার করুন