১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৩:৪৯:০৫ পূর্বাহ্ন


গণবিপ্লবের ঘোষণাপত্র ও স্বাধীনতা সংগ্রাম
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০১-২০২৫
গণবিপ্লবের ঘোষণাপত্র ও স্বাধীনতা সংগ্রাম জুলাই বিপ্লব নিয়ে চিত্রকর্ম


দেখছি-শুনছি, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতা আন্দোলনের পথ ধরে পূর্ববর্তী সরকারের পতনের প্রেক্ষাপট এবং অর্জন নিয়ে ঘোষণাপত্র প্রণয়নের কার্যক্রম চলছে। স্বল্প সময়ে অনেক হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের পর আন্দোলন, তথা বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ হতেই পারে। কিন্তু জুলাই-আগস্ট আন্দোলন কি তাহলে পূর্বপরিকল্পিত, সাজানো আন্দোলন ছিল? আপাতদৃষ্টিতে ছাত্রদের সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন সরকারের ভুল কৌশলের কারণে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। 

একপর্যায়ে আন্দোলন চরম সহিষ্ণুতায় রূপ নিলে সরকারবিরোধী শক্তি সংযুক্ত হয়ে সরকার পতনের একদফার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিতাড়িত করে। এরপর প্রত্যাশা থাকলেও কিন্তু কোনো বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়নি। দেশে প্রচলিত সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতির কাছে সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পাঁচ মাস সরকার পরিচালনা করছে। ভেঙে পড়া অর্থনীতি, আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে ভালো কিছু সংস্কারমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন থাকে সমাজের সব ক্ষেত্র থেকে বৈষম্য দূরীকরণ, হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ এবং মহাদুর্নীতির বিচার ব্যবস্থা এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ রয়ে গেছে। অনেকের মতে, এ কাজগুলো করার সক্ষমতা নেই বর্তমান সরকারের। 

অথচ সরকারঘনিষ্ঠ একটি মহল বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারি করার তাগাদা-আলটিমেটাম দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সংবিধান বাতিল, আওয়ামী লীগকে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার কথা। ঘোষণাপত্র দিয়ে কি এগুলো করা সম্ভব। একটি স্বাধীন দেশে যুদ্ধ জয়ের পর গৃহীত সংবিধান বাতিল করতে বা সংশোধন করতে অবশ্যই একটি নির্বাচিত সংসদ প্রয়োজন। সরকার বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। তাদের সুপারিশ এই মাসেই পাওয়া যাবে। সেগুলো সমন্বিত করে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে একটি পথনকশা করা যেতে পারে। এগুলো কিছু কিন্তু বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে না। বরং কোন পরিপ্রেক্ষিতে কি কারণসমূহের জন্য ছাত্র-জনতা আত্মাহুতি দিয়েছে সেটি লিপিবদ্ধ থাকবে।

অনেকে আবার জুলাই-আগস্টে দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে বলে দাবি করে ১৯৭১ মহান স্বাধীনতা আন্দোলনকেও অবমূল্যায়ন করার অপপ্রয়াস করছে। ১৯৭১ স্বাধীনতা আন্দোলনে পরাজিত শক্তি অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে নিজেদের অধিক দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে অপচেষ্টা করছে। মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের অবমূল্যায়ন করার প্রচেষ্টাও দৃশ্যমান। কিন্তু মনে রাখতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ শহীদ এবং মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত না হলে ২০২৪ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কোনো সুযোগ থাকতো না। সব সংশ্লিষ্ট পক্ষই কম-বেশি ৫৪ বছরেও স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল আদর্শ অর্জিত না হওয়ার জন্য দায়ী। যেসব অভিযোগের কারণে পূর্ববর্তী সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে, সেই একই ধরনের অপরাধ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে কি জাতি মুক্ত হতে পেরেছে?

যেহেতু, দেশের ঘনীভূত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক সংকট মোকাবিলা করার মতো অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা বর্তমান সরকারের সীমিত, তাই কিছু অপরিহার্য সংস্কার ন্যূনতম সময়ে সম্পাদন করে ২০২৫ নভেম্বর ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন করে যথাযথ হবে। ১৯৭২ সংবিধান থাকবে কিনা, সংশোধন হবে কি না, কোন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হবে, কোনটি থাকবে, সেটি নির্ধারণের দায়িত্ব এবং অধিকার আছে শুধু নির্বাচিত সরকারের। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা ধরনের পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।

যত দিন যাবে, পরিস্থিতি আরো অবনতি হবে। বরং জাতিকে সুযোগ দেওয়া হোক অবাধ-নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের পছন্দের সরকার গঠনের। যে কাজটি পূর্ববর্তী সরকার দীর্ঘদিন কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেখতে চায় সরকার কীভাবে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারি করে? কি থাকে সেই ঘোষণাপত্রে? মনে রাখতে হবে অনেকের নামেই অনেক অভিযোগ থাকে। কিন্তু অকাট্য প্রমাণাদির মাধ্যমে স্বাধীন আদালতে সেগুলো প্রমাণ না হলে কাউকে দোষী করে শাস্তি দেওয়া যায় না।

আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রজন্ম। সম্পৃক্ত থেকেই জানি, কারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধিকারের শত্রুপক্ষ-মিত্রপক্ষ। কারো কাছ থেকে এই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন নেই। বর্তমান প্রজন্ম ঠিকই এক সময় সঠিক তথ্য জানবে, সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন কিন্তু ভারত কেন কোথাও পালানোর পথ থাকবে না, যারা এখন ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে।

মৌলিক অবকাঠামো পরিবর্তনের অধিকার নেই অনির্বাচিত সরকারের

যতই দাবি দাওয়া থাকুক বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের, যেভাবেই গঠিত হয়ে থাকুক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মৌলিক অবকাঠামো পরিবর্তনের কোনো অধিকার বা ক্ষমতা নেই অনির্বাচিত সরকারের। বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শের ভিত্তিতে ১৯৭২ সংবিধান রচনা করেছে। সন্দেহ নেই নানা সংশোধনের মাধ্যমে সেই সংবিধান ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। অবশ্যই সেই সংবিধান সংশোধন করে যুগপৎ করার সুযোগ আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির প্রভাবে ১৯৭২ সংবিধান কবর রচনা করার মতো ধৃষ্টতাপূর্ণ দাবি এবং সংবিধান থেকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বাদ দেওয়ার সুপারিশ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই। সে কথাই বলছে বিএনপি, জাসদসহ মূলধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

সবাই জানে ভ্রান্ত, দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্বের কারণে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ১৫ বছর মেয়াদি সরকারের। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের আন্তর্জাতিক মানের এবং নির্মোহ বিচার হলেই নির্ধারিত হবে করা কতটুকু দায়ী। আর বিশ্বাসযোগ্য বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার অধিকার কোনো কর্তৃপক্ষের নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৯৭২ সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছে। অর্থনীতি, নির্বাচন পদ্ধতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, জ্বালানি বিদ্যুৎ প্রতিটি ক্ষেত্রে সংস্কার করার সুপারিশ করতে পারে সরকার। এমনকি সংবিধান সংসধোনের সুপ্রিম হতে পারে। কিন্তু কোনো ধরনের সংস্কার বা সংশোধন করতে হলে সেটি করবে সর্বজনীন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সাংসদ। আর সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে সংসদের দুই-তিন সাংসদের অনুমোদন লাগবে।

এখন যেসব দাবি তুলছে ছাত্রসমাজ বা নাগরিক অধিকার সংগঠন, সেগুলো কিন্তু জুলাই-আগস্টে উচ্চারিত হয়নি। ১৯৭২ সংবিধান স্বীকার না করলে এই সরকার অবৈধ হয়ে যাবে। অবৈধ সরকারের সব কার্যক্রম ভবিষ্যতে আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে। এক স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত হয়ে আরেক স্বৈরাচারের অধীন হওয়ার জন্য ছাত্র-জনতা আত্মাহুতি দেয়নি। সর্বত্র যে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের অর্জন মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে, সেটির নেপথ্যে আছে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, অনুমান করতে বিজ্ঞানী হতে হয় না।

আশা করি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী সব শক্তি দেশের মৌলিক বিষয়াদি পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াবে। অবিলম্বে নির্বাচনের মাধ্যমে জনসমর্থিত সরকার গঠন এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান এবং একমাত্র এজেন্ডা হওয়া উচিত। বিশ্ব মহল কিন্তু নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষা করছে।

শেয়ার করুন