বিচিত্র শহর নিউইয়র্ক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠীর বসবাস এ শহরকে যেমন একদিকে কসমোপলিটন শহরের মর্যাদা দিয়েছে, তেমনি এদের মোজাইক সংস্কৃতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে এ শহরের। এ শহরে একদল লোক একটা সুন্দর জীবনের জন্য সকাল সন্ধ্যা অমানবিক পরিশ্রম করে চলেছে। পাশাপাশি একটা শ্রেণির জীবনযাপনে রয়েছে, একটা চরম বিলাসিতা আর আভিজাত্য। এ শহরে একদল লোক মাথা গোঁজার জন্য এক বেডরুমের একটা অ্যাপার্টমেন্ট বা অস্বাস্থ্যকর বেসমেন্টে গাদাগাদি করে অমানবিক জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে একশ্রেণির মানুষ শুধু নিজেরাই বিলাসব্যসনে তাদের দিন কাটাচ্ছে না তাদের কুকুরের প্রয়োজনে ব্যয় করছে প্রতিদিন শত শত ডলার। প্রয়োজনে এসব কুকুর রাতযাপন করছে বিলাসী আবাসিক হোটেলে।
এক জরিপে জানা গেছে, ৭০ পারসেন্ট আমেরিকান কুকুর পোষে আর এদের আদরযত্ন করে নিজ সন্তানের মতো। কিন্তু তারা যদি জরুরি প্রয়োজনে কোথাও যায়, তাহলে তারা তাদের কুকুর রেখে যান কোন পেট হোটেলে।এসব হোটেলে নির্দিষ্ট ভাড়ায় কুকুর পাবে একটি নিজস্ব কক্ষ। ছাদে কাচের ঘরে সুর্যস্নান করার সুবিধা, গার্ডেনে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ, পান করতে পারে বিদেশি বোতলের পানি। আর সঙ্গে লাঞ্চ, ডিনার অথবা ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা তো থাকছেই।
এ শহরে এমনি একটা বেস্ট ডগ আবাসিক হোটেলের নাম বিস্কিট অ্যান্ড বাথ। পাঁচতলা বিশিষ্ট এ হোটেলটির অবস্থান ম্যানহাটনের ২২৭ ইস্ট ৪৪ স্ট্রিটে। এতে কুকুর অতিথিদের জন্য রয়েছে স্ন্যাকবার, ক্যাফেসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।
আপনি যদি হোটেলটিতে ঢোকেন, তাহলে দেখতে পাবেন কুকুর অতিথিদের কেউ হোটেল লাউঞ্জে বসে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ শ্যাম্পু করে ব্লো ড্রাই নিচ্ছে, আবার কেউ ব্যস্ত হট শাওয়ার নিয়ে।
সর্বশেষ হিসাব মতে, আমেরিকায় কুকুরের সংখ্যা ৮৯.৭ মিলিয়ন। আর এদের প্রয়োজনে বিভিন্ন স্থানে ডগ হোটেলের পাশাপাশি রয়েছে ডে কেয়ার সেন্টার। কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রী তাদের পোষা কুকুরকে কাজে যাওয়ার সময় এসব ডে কেয়ার সেন্টারে দিয়ে যান এবং ফেরার পথে ঘরে নিয়ে আসেন। এসব কুকুরের জন্য রয়েছে- হেলথ ক্লিনিক, ম্যাসেজ সেন্টার ইত্যাদি আর বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ডগ সেন্টারে রয়েছে কুকুরদের নানা জাতের খাবার, তাদের জামাকাপড়, থাকার রুম ইত্যাদি।
এ উন্নত দেশের কুকুরের বিলাসী জীবনযাপন দেখতে আগ্রহীরা ডগ হোটেল, ওয়েস্ট ৭৬ স্ট্রিট ম্যানহাটন অথবা ৩১১ ইস্ট ৬০ স্ট্রিটে ঘুরে আসতে পারেন।
নিউইয়র্কের যে রেস্তোরাঁয় খাবার খেতেন প্রেসিডেন্ট লিংকন ও জর্জ ওয়াশিংটন
বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল শহর নিউইয়র্ক। একই সঙ্গে জনবহুলও। বিপুলসংখ্যক মানুষের রসনা তৃপ্তির জন্য এখানে রয়েছে হাজার রকম ব্যবস্থা। রাস্তার পাশে স্ট্রিট ফুড, কিংবা অফিসের পাশের রেস্তোরাঁ-যে কোনো স্থানেই ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারেন নিউইয়র্কবাসী। আর এর সঙ্গে ইতিহাসের একটু অংশ হতে পারলে তা বাড়তি পরিতৃপ্তির সুযোগ করে দিতে পারে। এমন সুযোগ নিয়ে এখনো টিকে আছে নিউইয়র্কের প্রাচীন কিছু রেস্তোরাঁ।
আমরা হয়তো অনেকেই জানি না আমেরিকার প্রথম ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁটির অবস্থান এ নিউইয়র্কেই। নাম ডেলমোনিকোস। ১৮২৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমেরিকার প্রথম খাবার রেস্তোরাঁ হিসেবে ডেলমোনিকোস নিজেকে দাবি করে আসছে। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে এ রেস্টুরেন্টে ভোজন করতেন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন। যাকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বহু বছরের দাসপ্রথা বিলোপ করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মহান বীর হিসেবে বিবেচিত হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আধুনিকীকরণে যার বিরাট ভূমিকা ছিল। এছাড়াও এ রেস্টুরেন্টে নিয়মিত ভোজন করতেন লেখক মার্ক টুয়েন, প্রিন্স অব ওয়েলসসহ অনেক নামিদামি ব্যক্তিরা। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই ডেলমোনিকোস ভোক্তাদের জন্য নিয়ে আসে বিস্তৃত পরিসরের খাদ্যতালিকা। সে সময় থেকেই এখানে রয়েছে বিশেষ খাবার কক্ষ, যেখানে রয়েছে বিশেষ বিনোদনের ব্যবস্থাও।
১৮৫০ সাল থেকে তাদের সিগনেচার ডিস হচ্ছে- ডেলমোনিকো স্টেক। রেস্তোরাঁয় আছে প্রাইভেট ডাইনিং রুম।
আমেরিকার ফার্স্ট ফাইন ডাইনিং রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে আপনিও ইতিহাসের অংশ হতে পারেন। তাহলে ঠিকানাটা জেনে নিন।
ডেলমোনিকোস
৫৬ বিয়েভার স্ট্রিট, নিউইয়র্ক-১০০০৪
ফোন- ২১২ ৩৮১ ১২৩৭
এছাড়াও নিউইয়র্কে এখনো টিকে আছে এমন এক রেস্তোরাঁ, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭৬২ সালে। ওই বছর নিউইয়র্ক শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্রঁসে তাভেঁ রেস্তোরাঁ। অল্প সময়ের মধ্যেই রেস্তোরাঁটি জমে ওঠে। সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এমনকি জর্জ ওয়াশিংটনও এখানকার খাবারের স্বাদ নিয়েছেন। ফ্রঁসে তাভেঁর খাবারের গুণমুগ্ধদের মধ্যে রয়েছেন আরো বহু রথী-মহারথীরা।
নিউইয়র্ক শহরের সবচেয়ে প্রাচীন বার ও রেস্তোরাঁ হচ্ছে এই ফ্রঁসে তাভেঁ। ১৭৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ রেস্তোরাঁর মেনু বইয়েই মিলবে তার প্রাচীনত্বের প্রমাণ। সমসাময়িক খাবার যে একেবারে নেই তা নয়। তবে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবারেরই প্রাধান্য দেয় এরা। একদিক থেকে এ রেস্তোরাঁকে বলা যায়, প্রাচীন ও আধুনিক সময়ের সার্থক মেলবন্ধন।
এ রেস্তোরাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইয়ার ইন’। ঐতিহাসিক জেমস ব্রাউন হাউসে ১৮১৭ সালে এ রেস্তোরাঁটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউইয়র্কের অন্যতম প্রাচীন এ রেস্তোরাঁর প্রতিটি দেওয়াল ও সজ্জায় এর প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রমাণ মিলবে। ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় অ্যালকোহল নিষিদ্ধ থাকাকালেও রেস্তারাঁটি বন্ধ হয়নি। তবে সে সময় আগের মতো প্রকাশ্যে অ্যালকোহল বিক্রি করা হতো না। ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত এর কোনো নাম ছিল না।
আর তারপর এ দুই রেস্তোরাঁর সাফল্যের পথ অনুসরণ করে একে একে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ।
ঘুরে দেখা নিউইয়র্ক
আধুনিক বিশ্বের সমৃদ্ধতম মেট্রোপলিটন শহরগুলোর একটি নিউইয়র্ক। শিল্প, ফ্যাশন, খাবার কিংবা নাট্যকলা-সবদিক থেকেই নিউইয়র্কের আছে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ঠ। গতিশীলতা আর জীবনযাত্রার মানের দিক থেকেও বাকি গোটা বিশ্বের চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে স্বপ্নের এ শহর। এ শহরের স্থায়ী বাসিন্দা যারা, তারা নিঃসন্দেহে দারুণ সৌভাগ্যের অধিকারী। পর্যটকদের জন্য এই শহরের আবেদন কোনো অংশে কম নয়। আপনি যদি ভ্রমণপিয়াসু হয়ে থাকেন, বিশ্বের উল্লেখযোগ্য সব জায়গা ঘুরে দেখতে চান, তাহলে নিউইয়র্ককে আপনার বাকেট লিস্টে রাখতেই হবে।
দর্শক আকৃষ্ট করে এমন অনেক কিছু রয়েছে এ শহরে। মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের অন্যতম। যাকে সংক্ষেপে বলা হয় ‘দ্য মেট’। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শিল্প জাদুঘর। ২০১৬ সালে ৭.০৬ মিলিয়ন দর্শকের সঙ্গে এটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক পরিদর্শিত শিল্প জাদুঘর এবং পঞ্চম সর্বাধিক পরিদর্শিত জাদুঘর। তার স্থায়ী সংগ্রহে ২ মিলিয়ন কাজ রয়েছে, যা ১৭ বিভাগীয় বিভাগে বিভক্ত।
এ মিউজিয়ামের সংগ্রহে রয়েছে ২০ লাখেরও বেশি শিল্পকর্ম যা পৃথিবীর ৫ হাজার বছরের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে ধারণ করে আছে। মিউজিয়ামে ফুল টাইম কর্মচারীর সংখ্যা ৮০০ এবং পার্ট টাইম কর্মচারী ১০০।
আপটাউন ম্যানহাটনে সেন্ট্রাল পার্কের গা ঘেঁষে ফিফথ মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের অবস্থান। অ্যাভিনিউয়ের ওপর ৯৯ স্ট্রিট থেকে ৮৪ স্ট্রিট পর্যন্ত এই মিউজিয়ামে এখন যুক্ত হচ্ছে নতুন উইং, যা পুরোপুরি আধুনিক এবং সমকালীন শিল্পের প্রদর্শনী ও প্রসারে কাজ করবে। সম্প্রতি ৫৫ কোটি ডলার বাজেটে চলমান প্রকল্পটির নকশা প্রকাশ হয়েছে, যার ডিজাইন করেছেন ফ্রিদা এসকোবেডো। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এ জাদুঘরের ১৫৪ বছরের ইতিহাসে ফ্রিদা হলেন প্রথম নারী স্থপতি, যিনি একটি শাখার ডিজাইন করেছেন। সম্পূর্ণ অনুদানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে অংশটি। এর মধ্যে সাড়ে ১২ কোটি ডলার অনুদান দিয়েছেন অস্কার এল ট্যাং ও এইচএম অ্যাগনেস হু-ট্যাং দম্পতি। উইংটি তাদের নামেই পরিচিতি পাবে। ২০২৬ সালে শুরু হয়ে ২০৩০ সালে বিভাগটির নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এ ডিজাইনে কিছু অভিনব বিষয় রয়েছে। মিউজিয়ামের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সেন্ট্রাল পার্ব কমপ্লেক্সের ওপর স্থাপিত হচ্ছে নতুন শাখা। এতে প্রদর্শনীর স্থান বেড়ে যাবে প্রায় ৫০ শতাংশ, মোট গ্যালারি এলাকা হবে ৭১ হাজার বর্গফুট। এতে অন্তর্গত নকশা মেক্সিকোর ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য উপাদান থেকে অনুপ্রাণিত। যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্প্যানিশ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান সংস্কৃতি। উইংয়ে থাকছে ১৮ হাজার ৫০০ বর্গফুট আউটডোর টেরেস এবং তিনতলার মূল আয়োজনের সঙ্গে ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় গ্যালারি, অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ এবং কমিউনিটি স্পেস; যেখান থেকে দেখা যাবে সেন্ট্রাল পার্ক ও নিউইয়র্ক শহরের দৃশ্য। পরিবেশবান্ধব প্রকল্পটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে এলইইডি গোল্ড সার্টিফিকেশন পাওয়া যায় সহজে। দিনের আলোর সঠিক ব্যবহার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ছাদে সবুজায়ন ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উন্নত ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ডিজাইনে। মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টে বর্তমানে আরো কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ৭ কোটি ডলার বাজেটে নির্মাণাধীন মাইকেল সি রকফেলার উইং। আফ্রিকা, প্রাচীন আমেরিকা এবং ওশেনিক আর্টের প্রদর্শনী ও প্রসারে কাজ করবে এ গ্যালারি।
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।