মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গত ১৬ মে গুরুত্বপূর্ণ আদেশে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনকে টেক্সাসের উত্তরাঞ্চলে আটক ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের ওপর ‘অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ প্রয়োগ করে তাদের বহিষ্কারের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে বলেছে। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, সরকারকে অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেওয়ার আগে সংবিধানসম্মত পর্যাপ্ত নোটিশ দিতে হবে, যাতে তারা ফেডারেল কোর্টে প্রতিকার চাইতে পারেন। এই আদেশের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট এপ্রিল মাসে জারিকৃত অস্থায়ী স্থগিতাদেশকে বহাল রাখলো। আদালত জানিয়েছে, এই মামলাটি এখন ৫ম সার্কিট কোর্ট অব অ্যাপিলসে ফেরত যাবে, যেখানে দুটি প্রশ্নের নিষ্পত্তি হবে। প্রথমত. প্রেসিডেন্ট শান্তিকালে ‘অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ প্রয়োগ করতে পারেন কি না এবং দ্বিতীয়ত. অভিবাসীরা ঠিক কতটুকু নোটিশ ও আইনি প্রক্রিয়ার সুযোগ পাওয়ার অধিকার রাখেন।
৫ম সার্কিট কোর্ট এখন মামলার গভীরতর মূল্যায়ন করবে। সেখানে এটি নির্ধারণ করা হবে, আদৌ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই আইন প্রয়োগ করতে পারেন কি না এবং যদি পারেন, তাহলে লক্ষ্যবস্তু অভিবাসীদের কতটুকু নোটিশ, আইনি সহায়তা ও আদালতের অধিকার থাকা উচিত। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অভিবাসী অধিকার আন্দোলনকারীদের জন্য এক বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এটি শুধু বিদ্যমান বিতাড়ন ঠেকানোর কাজ করেনি, বরং একটি বড় সাংবিধানিক প্রশ্নও সামনে এনেছে: একক নির্বাহী আদেশে একজন প্রেসিডেন্ট কতদূর যেতে পারেন।
এই আদেশটি উত্তর টেক্সাসে বসবাসরত বেশ কিছু ভেনেজুয়েলান অভিবাসীর পক্ষে এসেছে, যারা শঙ্কা করছিলেন, যে কোনো মুহূর্তে তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। এই রায় ট্রাম্পের জন্য এক বড় রাজনৈতিক ধাক্কা। কারণ তিনি চাচ্ছিলেন, এই ১৮ শতকের যুদ্ধকালীন আইন ব্যবহার করে প্রচলিত আইনি পর্যালোচনা ছাড়াই অভিবাসীদের তাড়াতাড়ি দেশ থেকে বহিষ্কার করতে। তবে সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশ আপাতত অস্থায়ী। মূল আইনি প্রশ্নগুলোর নিষ্পত্তি এখন বিভিন্ন ফেডারেল আদালতে চলমান থাকবে। ট্রাম্প প্রশাসন গত মার্চ মাসে ‘অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ কার্যকর করে ভেনেজুয়েলার ‘ট্রেন দে আরাগুয়া’ গ্যাংয়ের সন্দেহভাজন সদস্যদের দ্রুত বহিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। একপর্যায়ে শত শত ভেনেজুয়েলান অভিবাসীকে এল সালভাদরের উদ্দেশে বিমানযোগে পাঠানো হয়।
তবে মার্কিন নাগরিক অধিকার সংগঠন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ ) দ্রুত আইনি চ্যালেঞ্জ জানায় এবং হ্যাবিয়াস করপাস রুলের আওতায় আদালতের দ্বারস্থ হয়। মূল দাবি ছিল, এসব অভিবাসীকে যথাযথ নোটিশ এবং আইনি সুযোগ না দিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে, যা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এই মামলা আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন এবং আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন অব টেক্সাসের যৌথভাবে দায়ের করা একটি আবেদনের ভিত্তিতে শুরু হয়। মামলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শতাব্দী প্রাচীন যুদ্ধকালীন আইন ‘অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’-এর প্রয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে মার্চ মাসে এই আইন প্রয়োগ করে শতাধিক ভেনেজুয়েলান অভিবাসীকে ‘ট্রেন দে আরাগুয়া’ নামের অপরাধী চক্রের সদস্য দাবি করে তাদের এল সালভাদরের এক কুখ্যাত কারাগারে প্রেরণ করেন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ফেডারেল কোর্ট এই বিতাড়নের ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার এক অস্বাক্ষরিত আদেশে জানায়, এই অভিবাসীদের বিষয়ে নিম্ন আদালত যথাযথ বিচার না করে তাদের বহিষ্কার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে টেক্সাসের বিচারক জেমস হেনড্রিক্সের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে আদালত উল্লেখ করে, ১৪ ঘণ্টা ২৮ মিনিটের নীরবতায় কার্যত বিচার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আদালত আরো জানায়, এই অভিবাসীদের স্বার্থ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একবার কেউ বেআইনিভাবে নির্বাসিত হলে, তার পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও আদালত অভিবাসীদের যে মাত্র ২৪ ঘণ্টার নোটিশ প্রদান করা হয়েছে, সেটিকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং ন্যায্য বিচার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মতো’ বলে রায় দিয়েছে।
এই আদেশের পর ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আমাদের দেশ থেকে অপরাধীদের বের করে দিতে দিচ্ছে না! তিনি রায়টিকে আমেরিকার নিরাপত্তা ও অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবেও উল্লেখ করেন। এই আদেশে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি ৫ম সার্কিট কোর্ট অফ অ্যাপিলসে ফেরত পাঠিয়েছেন। যেখানে মামলার মূল বিষয় প্রেসিডেন্টের এই আইন ব্যবহারের বৈধতা এবং লক্ষ্যবস্তু অভিবাসীদের কতটুকু আইনি প্রক্রিয়ার অধিকার থাকা উচিত সে বিষয়গুলো নির্ধারিত হবে।
এই রায় এমন একসময় এলো যখন আমেরিকার একাধিক ফেডারেল আদালত ‘অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’ ব্যবহারে ভিন্ন ভিন্ন রায় দিচ্ছে। টেক্সাস, কলোরাডো, নেভাদা এবং নিউইয়র্কে পৃথকভাবে এই আইনের বিরুদ্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ টেক্সাসের একটি আদালতের ট্রাম্প মনোনীত বিচারক ২ মে রায় দেন, প্রেসিডেন্ট এই আইনের অপপ্রয়োগ করেছেন।
এপ্রিলের মাঝামাঝি, উত্তরের টেক্সাসে অবস্থিত ব্লুবনেট ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি কিছু ভেনেজুয়েলান অভিবাসী হঠাৎ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্বাসনের নোটিশ পান। এদের মধ্যে দুইজন দ্রুত হ্যাবিয়াস পিটিশন দাখিল করেন, কিন্তু বিচারক হেনড্রিক্স তাদের আর্জি প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, সরকার জানিয়েছে তাদের তাৎক্ষণিক বহিষ্কারের পরিকল্পনা নেই। তবে পরে এই মামলাই সুপ্রিম কোর্টে গড়ায় এবং আদালত ১৯ এপ্রিল অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি করে অভিবাসীদের পক্ষে।
এই রায়ে দুই রক্ষণশীল বিচারপতি, স্যামুয়েল আলিটো ও ক্লারেন্স থমাস স্পষ্টভাবে ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সময়ের আগেই মামলায় হস্তক্ষেপ করছে এবং এটি আমাদের মূল বিচারিক এখতিয়ারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আলিটো এক ১৪ পৃষ্ঠার মতামতে বলেন, এটি একটি বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি করবে এবং নিম্ন আদালতকে তাদের কাজ সম্পূর্ণ করার সুযোগ না দিয়েই আমরা তাদের ওপর নির্দেশ জারি করছি। বিচারক ব্রেট কাভানাও আলাদা একটি সংক্ষিপ্ত মতামতে বলেন, তিনি একমত হলেও পুরো মামলাটি এখনই সুপ্রিম কোর্টে গ্রহণ করা উচিত ছিল, যাতে দ্রুত ও চূড়ান্ত সমাধান আসতে পারে।
সংগঠন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের ইমিগ্র্যান্টস রাইটস প্রজেক্টের উপপরিচালক এবং মামলার প্রধান আইনজীবী লি গেলারেন্ট বলেন, এই আদেশ সরকারের একটি গুলাগ-ধাঁচের কারাগারে মানুষ পাঠানোর তাড়াহুড়োর বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ধমক। শান্তিকালে যুদ্ধকালীন ক্ষমতা প্রয়োগ এবং তাতে ন্যায়বিচার না দেওয়া-এটি একটি গভীর সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করে।
সংগঠন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন অব টেক্সাসের আইনি পরিচালক আদ্রিয়ানা পিনোন বলেন, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় স্বাগত জানাই। কারণ এটি নিশ্চিত করে যে, অভিবাসীরাও ন্যায়বিচারের অধিকার রাখেন এবং তা হতে হবে অর্থবহ। সরকারের যৎসামান্য ‘প্রক্রিয়া’ মূলত এসব গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের প্রতি অবজ্ঞাসূচক। এটা শুধু অভিবাসীদের জন্য নয়, সব টেক্সানদের জন্যও একটি বিজয়।
জর্জটাউন লর অধ্যাপক ও সিএনএন বিশ্লেষক স্টিভ ভøাডেক বলেন, এই আদেশ কার্যত উত্তর টেক্সাস থেকে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের বহিষ্কার স্থগিত করেছে। যেহেতু অন্যান্য জেলাগুলোতেও একই আইনের বিরুদ্ধে আদেশ রয়েছে, তাই এখন সমগ্র দেশে কার্যত ‘অ্যালিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট’-এর অধীনে বহিষ্কার প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এই আদেশ পুরো দেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি দেখায় যে সরকার একটি শতাব্দী প্রাচীন আইনকে বর্তমান বাস্তবতায় প্রয়োগ করতে চাইলে তাকে অবশ্যই সাংবিধানিক গাইডলাইন অনুসরণ করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের এই সাময়িক আদেশ অভিবাসীদের মানবাধিকার ও আইনি সুরক্ষার প্রশ্নে এক গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের বিতর্কিত ও তড়িঘড়ি করে নেওয়া বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত যে আইন ও মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে, আদালতের মন্তব্যে তা পরিষ্কার হয়েছে। এখন অপেক্ষা মূল রায়ের, যা নির্ধারণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একজন ‘বিদেশি শত্রু’ কতটা আইনি অধিকার ভোগ করবেন এবং প্রেসিডেন্ট কত দূর পর্যন্ত নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।