যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম শহর শিকাগোতে অভিবাসন দমনের নামে ফেডারেল এজেন্টদের হেলিকপ্টার, টিয়ার গ্যাস, স্মোক গ্রেনেড ব্যবহার ও সামরিকধর্মী কৌশল ব্যবহারের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া এই কঠোর অভিযানে ইতিমধ্যেই এক হাজারেরও বেশি অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে। তবে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু অনথিভুক্ত অভিবাসীই নয়, বরং মার্কিন নাগরিক, বৈধ অভিবাসী ও শিশুরাও রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।গত ৪ অক্টোবর রাতে দক্ষিণ শিকাগোর ৭৫০০ সাউথ শোর ড্রাইভ একটি পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে এই পাঁচতলা আবাসিক ভবনটিতেই গত ৪ অক্টোবর রাতে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি (ডিএইচএস) ও তাদের বিশেষ এজেন্টরা ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে অভিযান চালায়। এজেন্টরা ‘ব্ল্যাক হক’ হেলিকপ্টার থেকে র্যাপেল করে ভবনে প্রবেশ করে, ভবনটি ঘিরে ফেলে এবং ঘুমন্ত বাসিন্দাদের জাগিয়ে তোলে। অনেককে জিপ টাই দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরা জানান, এজেন্টরা কোনো ধরনের ওয়ারেন্ট ছাড়াই দরজা ভেঙে অভিযান চালায়।
৬৭ বছর বয়সী মার্কিন নাগরিক রডরিক জনসন বলেন, তারা আমার দরজা ভেঙে ঢোকে, আমাকে বেঁধে ফেলে। আমি ওয়ারেন্ট দেখতে চাইলে বা আইনজীবীর কথা বললে তারা কোনো উত্তর দেয়নি। এলাকাবাসীর দাবি, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে শিশুরাও ছিল, যাদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন ইলিনয় কোয়ালিশন ফর ইমিগ্র্যান্ট অ্যান্ড রিফিউজি রাইটস এবং সাউথসাইড টুগেদার ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযোগ সংগ্রহ করেছে। সংগঠনের সদস্য ডিকসন রোমিও বলেন, অনেকের দরজা ভেঙে ফেলা হয়েছে, সবাই আতঙ্কে আছে। এটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য নয়। ইলিনয়ের গভর্নর জেবি প্রিটজকার ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বলেন, ফেডারেল এজেন্টরাই এখন শিকাগোকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তারা টিয়ার গ্যাস, স্মোক গ্রেনেড ব্যবহার করছে। এটি যেন কোনো যুদ্ধ চলছে। গভর্নর অভিযানের পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, বিশেষত শিশুদের তাদের বাবা-মা থেকে আলাদা করে আটক রাখার অভিযোগের বিষয়ে।
ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দাবি করেছে, অভিযানটি পরিচালিত হয়েছে ভেনেজুয়েলান গ্যাং ‘ট্রেন দে আরাগুয়ার’ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ধরার উদ্দেশ্যে। তবে কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বা শিশুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্য দেয়নি সংস্থাটি। ডিএইচএস সেক্রেটারি ক্রিস্টি নোম ৪ অক্টোবর এক্স এক মিনিটের সম্পাদিত ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায় হেলিকপ্টার উড়ছে, এজেন্টরা দরজা ভেঙে প্রবেশ করছে এবং লোকজনকে বেঁধে ফেলছে। তবে ভিডিওটিতে সংগীত যুক্ত থাকায় প্রকৃত শব্দ বা সংলাপ শোনা যায়নি। অভিযানের দিন থেকেই শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ শিকাগোর পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লোগান স্কয়ার এলাকাতেও গত সপ্তাহে ফেডারেল এজেন্টদের কেমিক্যাল এজেন্ট ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে। ওই এলাকায় একটি স্কুলের পাশে রাসায়নিক ক্যানিস্টার নিক্ষেপ করা হলে ফানস্টন এলিমেন্টারি স্কুল কর্তৃপক্ষ সেদিন শিক্ষার্থীদের ইনডোরে রাখার নির্দেশ দেয়। অভিযানের দিনই শহরের অ্যাল্ডারপারসন জেসি ফুয়েন্তেসকে একটি হাসপাতালে হাতকড়া পরিয়ে আটক করা হয়। তিনি জানান, হাসপাতালে গিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন যে, আইস এজেন্টদের ধাওয়ায় পা ভেঙে যাওয়া এক অভিবাসী চিকিৎসা নিচ্ছেন কি না। কিন্তু তিনি ওয়ারেন্ট দেখতে চাইলে তাকে হাতকড়া পরানো হয়। অভিযানের সময় এক মহিলাকে গুলি করার ঘটনাও ঘটে। ফেডারেল এজেন্টদের দাবি, ওই নারী অস্ত্রধারী ছিলেন এবং গাড়ি চালিয়ে এজেন্টদের দিকে ধেয়ে আসছিলেন। পরে তাকে এবং আরো এক ব্যক্তিকে ‘ফেডারেল অফিসারকে বাধা ও হামলার’ অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তবে অধিকারকর্মীরা বলছেন, এজেন্টরাই রাস্তা বন্ধ করে দুর্ঘটনার পরিস্থিতি তৈরি করেছিল এবং গুলিবিদ্ধ নারী আসলে একজন মার্কিন নাগরিক।
শিকাগো স্টেট প্রতিনিধি লিলিয়ান হিমেনেজ বলেন, আইস আমাদের এলাকায় দখলদার বাহিনীর মতো আচরণ করেছে। হেলিকপ্টারগুলো ঘরের ওপর দিয়ে উড়েছে, বাচ্চারা কেঁদেছে, পরিবারগুলো আতঙ্কিত হয়েছে। এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন। গভর্নর প্রিটজকারসহ ইলিনয়ের ডেমোক্রেটিক সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যরা অভিযানের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এ ধরনের সামরিক কৌশল ব্যবহার সংবিধানবিরোধী ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। তারা অবিলম্বে অভিযান বন্ধ ও একটি স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে শিকাগোর পশ্চিমাঞ্চলীয় উপশহর ব্রডভিউ এলাকায় অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রকে ঘিরে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এ ছোট শহরটি এখন ফেডারেল অভিযানের নতুন কেন্দ্রবিন্দু। এখানে প্রতিদিনই অভিবাসনবিরোধী অভিযান ও প্রতিবাদ হচ্ছে, যার ফলে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। সিটি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি তাদের অনুমতি ছাড়া প্রসেসিং সেন্টারের চারপাশে আট ফুট উঁচু বেড়া তৈরি করেছে, যা দমকল বিভাগের জরুরি প্রবেশাধিকার ব্যাহত করছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ফেডারেল আদালতে মামলা করেছে, বেড়াটি সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ চেয়েছে।
ব্রডভিউর কর্মকর্তারা আরো তিনটি পৃথক অপরাধ তদন্ত শুরু করেছেন, যেখানে ফেডারেল এজেন্টদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। শহর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, এ বেড়া শুধু অবৈধ নয়, জননিরাপত্তার জন্যও তাৎক্ষণিক হুমকি সৃষ্টি করেছে। অভিযানের বিরুদ্ধে নাগরিক অধিকার সংস্থাগুলোও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সংগঠন বলেছে, ফেডারেল এজেন্টরা ইলিনয়ে ২০২২ সালে স্বাক্ষরিত একটি ‘কনসেন্ট ডিক্রি’ লঙ্ঘন করেছে, যা ছয়টি রাজ্যে অভিবাসন গ্রেফতারের সীমা নির্ধারণ করেছিল। যদিও ওই আদেশের মেয়াদ মে মাসে শেষ হয়েছে, আইনজীবীরা আদালতের কাছে এর মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছেন এবং গত এক মাসে অন্তত ৪০টিরও বেশি নতুন লঙ্ঘনের অভিযোগ জমা দিয়েছেন।
ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে সংস্থার সচিব ক্রিস্টি নোম ‘ফক্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’ টকশোতে দাবি করেন, অভিযানগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আমাদের অফিসাররা প্রতিনিয়ত জীবনহানির মুখে কাজ করছেন। তবে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মতে, এ অভিযানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোকে আরো বিভক্ত করে তুলছে। ইলিনয়ের আইনপ্রণেতা ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এই সামরিকধর্মী কৌশল শহরের কালো, লাতিনো ও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্কের জন্ম দিচ্ছে। রোববার দক্ষিণ শিকাগোর অভিযানের স্থানটি ঘিরে শত শত মানুষ মানববন্ধন করেন। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে বাস করছি না, এক বাসিন্দা বলেন। আমরা পরিবার নিয়ে এখানে শান্তিতে থাকতে চাই। আইনজীবীরা বলছেন, এ ধরনের অভিযান চতুর্থ সংশোধনীর অধীনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অযৌক্তিক তল্লাশি-বিরোধী অধিকার লঙ্ঘন করে। তারা ফেডারেল আদালতে গণগ্রেফতার ও কেমিক্যাল অস্ত্র ব্যবহারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
শিকাগো সিটি এলাকায় ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ বাস করেন, যার মধ্যে লক্ষাধিক অভিবাসী। শহরটি অভিবাসীবান্ধব নীতি গ্রহণ করে বহু বছর ধরে স্যাংকচুয়ারি সিটি’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক অভিযানের ফলে এই মর্যাদা কার্যত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। একজন মানবাধিকার কর্মী বলেন, শিকাগোতে এখন মানুষ ঘুমাতে পারছে না। প্রতিটি হেলিকপ্টারের শব্দে মনে হচ্ছে আবার কেউ দরজা ভেঙে ঢুকবে।
বিশ্লেষকদের মতে, অভিবাসনবিরোধী এ অভিযানে ফেডারেল সরকার শুধু অবৈধ অভিবাসীদেরই নয়, বরং বৈধভাবে বসবাসরত অভিবাসী সম্প্রদায়কেও ভীত করছে। এর ফলে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা, সামাজিক সম্পর্ক এবং নাগরিক আস্থার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বর্তমানে ইলিনয়ের স্টেট কর্তৃপক্ষ, শহর প্রশাসন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযানের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবিতে একমত হয়েছে। কিন্তু ফেডারেল সরকার এখনো এ সমালোচনার প্রতি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।