২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০১:০০:০৮ অপরাহ্ন


চতুর্মুখী সংকটে সরকার
জ্বালানি তেলের বিশাল মূল্যবৃদ্ধি কেন?
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৮-২০২২
জ্বালানি তেলের বিশাল মূল্যবৃদ্ধি কেন?


অধিকাংশ মানুষকে বিস্মিত,হতবাক করে বাংলাদেশ সরকার এককালীন জ্বালানি তেল (পেট্রল, ডিজেল, অকটেন, কেরোসিনের) মূল্য গড়ে ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা বলে মনে না করার যুক্তি নেই। প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে দেশজুড়ে, নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। এরই মাঝে জ্বালানি সংকটের অজুহাত তুলে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে দেশজুড়ে চরমআকারে। ঢাকা মহানগরীতে লোডশেডিং মোটামুটি সহনীয় হলেও ঢাকার বাইরে অনেক অঞ্চলে লোডশেডিং তীব্র থেকে তীব্রতার হচ্ছে। এরই মাঝে বিশাল মাত্রায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনে বিশাল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

গ্যাস-সারের মূল্যবৃদ্ধি, পানি-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হবে যে কোনো সময়। হয়তো গ্যাসের মূল্য আবারো বৃদ্ধি পাবে অচিরেই। এতোসব মূল্যবৃদ্ধি করোনার অভিঘাতে পিষ্ট মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের জীবনে অভিশাপ হয়ে আসছে। জানি-মানি, বিশ্ব পরিস্থিতির বিবেচনায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি অপরিহার্য ছিল। সরকার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং দায়িত্বশীল হলে এককালীন বিশাল মূল্য বৃদ্ধি না করে ধাপে ধাপে সহনীয় মাত্রায় মূল্যবৃদ্ধি করতে পারতো ইউক্রেন যুদ্ধ সূচনার সময় থেকে। তাহলে জনজীবনে মূল্যবৃদ্ধি মানিয়ে যেতো। 

সবাই জানে, করোনা সময়ে স্থবির হয়ে থাকা পৃথিবীতে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে ধস নেমেছিল।কয়লা, তেল,গ্যাস সবকিছু বিকোচ্ছিলো নামমাত্র মূল্যে। বাংলাদেশের জ্বালানি সংরক্ষণের ক্ষমতা সীমিত। অধিকাংশ নীতিমালায় ভবিষ্যৎ ক্রয়, প্রাইস হেজিং করার সক্ষমতা না থাকায় বাংলাদেশ অবিশ্বস্য কম জ্বালানি মুলা সুযোগ নিতে পারেনি। একশ্রেণির দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠীর প্রভাবে সেপ্টেম্বর ২০২১ সরকার স্পট মার্কেট থেকে ১০ মার্কিন ডলার-এমএমবিটিইউ মুলা এলএনজি ক্রয় করেনি। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই বিশ্ব জ্বালানি বাজারে আগুনলাগে।বাংলাদেশকে কয়েকটি কার্গো ২৮-৩০ মার্কিন ডলার-এমএমবিটিইউ ক্রয় করতে হয়। সরকারপ্রধান একপর্যায়ে এসে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় না করার সিদ্ধান্ত দিলে গ্যাস সরবরাহ সংকট তীব্রতার হয়। ইতিমধ্যেই রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে সব ধরনের জ্বালানি মূল্য আকাশ ছুঁয়ে যায়। 

বাংলাদেশ দীর্ঘসময় নিজস্ব জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ২০০০-২০২২ সময়ে যুক্তিহীন কারণে বাংলাদেশ নিজস্ব গ্যাসসম্পদ সম্প্রসারণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বিকল্প জ্বালানি কয়লা উত্তোলন বিষয়েও নিস্পৃহ থাকে। অপরদিকে আমদানি জ্বালানিনির্ভর কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন্দ্র নির্মাণ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশ ৩-৫ সময়ের জন্য নির্মিত আমদানিকৃত তরল জ্বালানি (ফার্নেস অয়েল, ডিজেল) ভিত্তিক ভাড়ায় আনা কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। ২০২২ সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪০ শতাংশের অধিক জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। অধিকাংশ প্ল্যান্টসমূহের সঙ্গে আবার ক্যাপাসিটি চার্জ মেটানোর চুক্তি থাকায় সরকার পরে উভয় সংকটে।

এমতাবস্থায় সরকারপ্রধান জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছ্রতার কথা বলা মাত্রই আমলা নিয়ন্ত্রিত বিদ্যুৎ প্রশাসন চটজলদি কিছু গণবিরোধী সিদ্ধান্তসহ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দেশব্যাপী ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা আসে। পরিকল্পনামাফিক দৈনিক এক থেকে দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ের মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বলা হয়, শিল্পকারখানাগুলোর স্বার্থেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত। দুনিয়ার অধিকাংশ দেশের মতো বাংলাদেশেও বহু আগে সন্ধ্যা পিক ঘণ্টার সময় থেকে বাণিজ্যবিতান বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু জ্বালানি সংকট (গ্যাস সংকটের সময়) কোনো কিছুর বাছবিচার না করে আমলারা কেন সকল ডিজেল প্ল্যান্ট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলো?

দেশের কিছু কিছু অঞ্চল যেমন রাজশাহী, রংপুর বিভাগ একান্তই তিনটি ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল। আর আছে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখানেও কয়লা সরবরাহ মাঝে মাঝে বিঘ্নিত হচ্ছে। জাতীয় গ্রিডের সীমাবদ্ধতার কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা যায় না। আর তাই আমলাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হলে রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে ৫-৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হতে থাকে।  সরকারের ঘোষণায় মসজিদসহ উপাসনালয়সমূহে গরমের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ব্যবহারে কৃচ্ছ্রতার কথা বলা হলেও অভিজাত নাইট ক্লাবসমূহ থেকে শুরু করে  সকল বিনোদন ক্লাবসমূহে যথেচ্ছা ব্যবহার জনমনে খবর সৃষ্টি করে। 

এমনি যখন পরিস্থিতি তখন সবাইকে বিস্মিত করে এককালীন জ্বালানি তেলের গড় ৫১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি দেশব্যাপী অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানিনা, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই ধরনের সিদ্ধান্ত সরকারের জন্য দুর্যোগ বয়ে আনবে কিনা। আবারো বলছি, মূল্যবৃদ্ধি অপরিহার্য ছিল কিন্তু কোনোমতেই সেটি ৫১ শতাংশ করা কোনোমতেই সমীচীন হয়নি। ইতিমধ্যেই ডমিনো ইফেক্ট হিসেবে যানবাহনের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম আরেকদফা। কৃষি,শিল্প সকল ক্ষেত্রেই এই বৃদ্ধি সরকারের জন্য চতুর্মুখী সংকট সৃষ্টি করবে। এমনিতেই স্যারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে,একে মাঝে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি সেচ মৌসুমে কৃষিক্ষেত্রে যাতে সংকট সৃষ্টি না করে তার জন্য কৃষককে সরাসরি প্রণোদনা দিতে হবে। জ্বালানি ব্যবহার সীমিত করতে হবে সরকারি যান ভাঙে। এমনিতেই বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ের সময় অজস্র ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার প্রকৃত পক্ষে ডিজেলের আরো চাহিদা বৃদ্ধি করেছে। একেই হয়তো বলে পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ। 

সবাই প্রশ্ন করছে সরকার কেন জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন অ্যাক্টের ২২ ধারা অনুযায়ী সকল ধরনের জ্বালানি মূল্য নির্ধারণের দায়িত্ব কমিশনের করার কথা। কমিশন থেকে প্রবিধানমালা জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে ১২ বছর আগে পাঠানো হলেও অনুমোদন হয়নি।  কমিশন একই ধরনের ক্ষেত্রে আদালতের আদেশের পর এলপিজির মূল্য নির্ধারণ করছে। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা গৃহীত হলে স্বচ্ছতা আসবে।  এটি করা অপরিহার্য। জ্বালানি তেল ক্রয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ আছে।

সবকিছু মিলিয়ে বলবো সরকারপ্রধান প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সীমিত আয়ের সৎ চাকরিজীবীদের কথা বিবেচনা করে জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি পুনর্বিবেচনা করলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে।


শেয়ার করুন