২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ১১:৪১:৪৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


একবছরে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার কমেছে
বাংলাদেশের ‘অলৌকিক’ অর্থনীতি ধসের চিত্র
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-১০-২০২২
বাংলাদেশের ‘অলৌকিক’ অর্থনীতি ধসের চিত্র বর্তমানে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার কমে গিয়েছে।


বাংলাদেশের ‘অলৌকিক’ অর্থনীতিতে ধস নামতে শুরু করেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গত বছরের চাইতে বর্তমানে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ১০ বিলিয়ন ডলার কমে গিয়েছে। একবছর পূর্বে যেখানে ৪৫.৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ, সেখানে এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৩৬.৯ বিলিয়ন ডলার। তারপরও বিশেষ ওয়াকিবহাল সূত্র মতে, এর মধ্য ব্যবহারযোগ্য বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয়। 

বাংলাদেশে এখন খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে টিসিবির মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে চাল, ডাল ও পেঁয়াজ ও চিনি। এ অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি। টিসিবি আমদানি করলেও দেশীয় ব্যবসায়ীরা তা বিক্রি করতো। এখন মুদ্রাস্ফীতির কারণে দাম ঠিক রাখতে টিসিবি সরাসরি বিক্রি করছে। অনেকে তারপরও কাক্সিক্ষত মাল পাচ্ছে না। ১৪ বছর বয়সী থেকে ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধাদের লাইনে দেখা যাচ্ছে। বলতে গেলে বাংলাদেশের মিরাকল বা অলৌকিক অর্থনীতি এখন প্রচণ্ড রকমের চাপে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার কৃচ্ছতার কথা বলছেন। প্রেসক্রিপশন আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের। কিন্তু কৃচ্ছতার প্রচার যেভাবে হচ্ছে সরকার নিজের বেলায় কোনো কৃচ্ছতা করছে না। বলছে সবাইকে কৃচ্ছ্রতা মেনে চলতে হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি খরচে চার্টার বিমানে বিদেশ ভ্রমণ। এক সপ্তাহের পরিবর্তে তিন সপ্তাহ বিদেশ কাটানো সরকারি মহলের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। দেশে সাধারণ মানুষ বর্ধিতহারে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছেন। এর জন্য তারা হতাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। 

খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য মানুষ রাস্তায় নামছে। বিরোধী শিবিরের আন্দোলন ও সমাবেশের কর্মসূচিতে মানুষ সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট লঞ্চ বন্ধ রেখেও মানুষের সমাবেশে উপস্থিতি রোধ করতে পারছে না। কারণ মানুষ দ্রব্যমূল্য, বিনাবিচারে খুন, রাস্তাঘাটে ডাকাতি, ‘সোনার ছেলেদের’ অত্যাচারের কারণে অতিষ্ঠ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্রমাগতভাবে চাপ অনুভব করছেন। তিনি দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য আইএমএফের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য চেয়েছেন ৪.৫ বিলিয়ন ডলার। প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন ১.৫ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো নয়। যেখানে প্রেসিডেন্টকে দেশ থেকে পালিয়ে প্রাণে বাঁচতে হয়েছে। সেখানে মানুষ অদ্যাবধি খাদ্য স্বল্পতায় ভুগছে। জ্বালানি ও ওষুধ সরবরাহ নেই। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা না হলেও বাংলাদেশ অনেকটা একই ধরনের সমস্যায় দিনযাপন করছে। কল্পনাবিলাসী ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ, সরকারি মহলের কাছের লোকদের অর্থবিলাসিতা এবং অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাংলাদেশের অবস্থাকে কাহিল করে ফেলেছে। এর মধ্যে মন্ত্রীদের লম্বা কথার তোড় মানুষকে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।

এই ধরনের মাঠের অবস্থা বাংলাদেশের অলৌকিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে হেয় করছে। এরপরও প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন সিএনএনের ফরিদ জাকারিয়ার অনুষ্ঠানে এসে বলেছেন, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সরকারের অবদান তেমন কিছু নেই। তারপরও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, বিষয়টি দেখা দরকার। তিনি সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলোকে জনগণের হাতে পয়সা তুলে দেয়ার মতো প্রকল্পের প্রতি সাধুবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, সরকারের ব্যবস্থাপনা তেমন নাই বললেই চলে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস তৈরির যে শিল্পখাত রয়েছে, তা বস্তুত বেসরকারি খাতের গড়া। আর তার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাঠে-ময়দানে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা সরকারি অব্যবস্থাপনারই লক্ষণ বলে অনেকে মনে করেন। 

গত মাসে সরকার জ্বালানি মূল্য ৫০ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে। তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারি খরচ কমানোরর জন্য তাই করা হয়েছে। জীবনযাপনের ব্যয় তাতে দ্বিগুণ বেড়েছে। এ কারণে কর্তৃপক্ষ সরকারি নিয়োজিত ডিলারদের মাধ্যমে চাল ও অন্যান্য প্রধানসামগ্রী বিক্রির নির্দেশ দিয়েছে। সরকার গত সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে এ কর্মসূচি চালু করে। তাতে সরকার মনে করে ৫ কোটি লোক উপকৃত হবে। 

সরকার বলছে, এই অবস্থার উন্নতিকল্পে এ ব্যবস্থা সাময়িক। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে এবং করোনা ভাইরাস থেকে উত্তরণের কষ্টসাধ্য শ্রমের কারণে অনেক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও লাওসের মতো দেশগুলোতে ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রামান দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাতে ডলার দিয়ে আমদানিকত তেল ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। 

জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার বৃহৎ ও নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন সাশ্রয় করেছে, অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ রেখেছে। যাতে মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমে। অফিসের সময় কমিয়ে দিয়েছে, যাতে জ্বালানির ওপর চাপ কমে। বিলাসিদ্রব্যের আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আইটেম যেমন সিডার ও এসইউভি আমদানি বন্ধ করেছে। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির পালে ঘূর্ণিঝড় হানা দিয়েছে। হঠাৎ দেশ জ্বালানি সাশ্রয়ের অবস্থায় ফিরে গেছে। বিদেশি মুদ্রা ভা-ারে চাপ পড়েছে। অনেক পরিবার মাছ-মাংস খাওয়া ভুলে যাচ্ছে। কাপড়-চোপড় রফতানিতে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার ৮০ শতাংশ আয় হতো, কিন্তু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ডিজেলচালিত প্রকল্পসমূহ বন্ধ করায় ৬ শতাংশ গার্মেন্টস প্রস্তুত করা বন্ধ হয়ে পড়েছে। দৈনিক পাওয়ার উৎপাদন দেড় হাজার মেগাওয়াট কমে গেছে।

২০২২ সালের জুন মাসে গত অর্থবছরের আমদানি ৮৪ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। রফতানি কমেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের জন্য আরো চ্যালেঞ্জ এগিয়ে আসছে। যেমন অন্তত ২০টি বৃহৎ প্রকল্প কাঠামোর জন্য গৃহীত বিদেশি ঋণের অর্থ পরিশোধের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। তাছাড়া ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের পদ্মা সেতু তৈরিতে চীনের অর্থ পরিশোধেরও সময় ঘনিয়ে আসছে। তাছাড়া ঘনিয়ে আসছে রাশিয়ার নির্মিত আনবিক পাওয়ার প্ল্যান্টের অর্থ পরিশোধের সময়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ২০২৪ সাল থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থ পরিশোধের সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। 

বাংলাদেশ যে আইএমএফ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য চেয়েছে তা নিয়ে আইএমএফ কাজ করছে। এরপরও বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের চাইতে অনেক বেশি অর্থনৈতিক আঘাত সহ্য করতে পারবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার তিনগুণ আর তা পর্যটনের ওপর নির্ভর নয়। এ বছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ জিডিপির ২০ শতাংশ মাত্র। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় ছিল ১২৬ শতাংশ ২০২২ সালের গোড়ার দিকে। কিন্তু তারপর বাংলাদেশে বর্তমানে যে ব্যবস্থায় জীবন ধারণ চলছে তা নিয়ে মানুষ কখনো অভ্যস্ত ছিল না। শ্রীলঙ্কায় কৃচ্ছতা যেমন অর্থনৈতিক সফলতা আনতে পারেনি। বাংলাদেশে তা কি করে সম্ভব কৃচ্ছতাসাধন করে। লাইনে মানুষ দাঁড় করিয়ে সাময়িক যন্ত্রণার উপশম পাওয়া যায়, তবে স্থায়ী সমাধান হয় না। শ্রীলঙ্কার জন্য আইএমএফের প্রেসক্রিপশন এমন এক উপশম, যা রোগের চাইতেও খারাপ বলে অনেকে মনে করেন। আসলে সেখানে মানুষ আরো দারিদ্র্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বাংলাদেশেও কি সে ব্যবস্থার প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে?

শেয়ার করুন