০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৯:২১:৫৬ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশের রাজনীতির নাটাই কোথায়
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-১২-২০২২
বাংলাদেশের রাজনীতির নাটাই কোথায় বিএনপির প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশের অ্যাকশন


পল্টনের ঘটনায় রীতিমত তোলপাড়! বিএনপি গোলাপবাগে তাদের পূর্ব নির্ধারিত বিভাগীয় সমাবেশটা করেছে বটে, কিন্তু নয়া পল্টন থেকে গোলাপবাগে যাবার আগে যে ঘটনাগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে, সেটাতে বিস্ময় জেগেছে। বিস্মিত এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই জন্য- ওই ঘটনার রেশ চলছে বিশ্বব্যাপী। বন্ধুভাবাপন্ন প্রভাবশালী দেশসমূহ, যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী তাদের কাছে প্রশ্ন জেগেছে- নয়া পল্টনের ঘটনা কেন, এবং কী কী ঘটছে, সেটা। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী মিশনসমূহ সরকারের কাছে ওই প্রসঙ্গে আসল চিত্রটা জানতে চেয়েছিল কি-না সেটা না জানা গেলেও সরকার এ ব্যাপারে তাদের (বিদেশী মিশনগুলোতে) ব্যাখ্যা দিয়েছে। যা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেছে কি না, তেমন রেফারেন্স মিলছে না। 

আসলে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলসমূহ বিদেশী মিশনসমূহে ধর্ণা দেয়ার রেওয়াজ পুরানো। বিএনপিও এর বাইরে যাবে কেন? বিশেষ করে টানা তিন টার্ম ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও দলটির উপর যেমন দমন পীড়ন, নির্যাতন হয়েছে বাধ্য হয়েই তারা বন্ধু দেশসমূহের কাছে ধর্ণ দেবে এটা স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে অভিযোগও আছে। দিনে দলীয় কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ত থেকে, রাতে দুতাবাসসমূহে ধর্ণা দিয়ে বেড়ায়- এমন অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের। এমনকি বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যাপারে যাতে নাক না গলায় সে জন্য বারবার সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীগণও আহ্বান জানিয়ে আসছেন প্রকাশ্যে। ১০ ডিসেম্বরের পরও একটি প্রভাবশালী দেশের নাম উচ্চরণ করে ইশারা ইঙ্গিতেও অনেকেই বক্তব্যও দিয়েছেন। 

বিভিন্ন ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ঢাকায় অবস্থিত বিদেশী রাষ্ট্রদূতসমূহকে জেনেভা কনভেনশনের কথাও মনে করিয়ে (সতর্ক) দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় থেকে মিডিয়াকে ইনফর্ম করা হয়েছে। কিন্তু এমতাবস্থায় সেই বিদেশী রাষ্ট্রদূতসমূহে কেন চিঠি দিয়ে জানাতে হবে ঢাকার নয়া পল্টনে বিএনপি ও পুলিশের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তার আদিঅন্ত। বিষয়টা কিছুটা হলেও স্ববিরোধী কি-না এ নিয়ে এখন তোলপাড় রাজনীতিঅঙ্গন।  তাহলে কী সত্যি সত্যি বাংলাদেশের রাজনীতির ইস্যুতে বিদেশীদের ইচ্ছাশক্তির প্রভাব রয়েছে? 

নয়া পল্টনে গত ৭ ডিসেম্বর যা ঘটেছে সেটা গত দেড় দশকের মধ্যে তেমন উল্লেখ করার মত নয়। এর চেয়েও বড় ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে রয়েছে। কিন্তু সে সময়ে বিদেশী বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্রসমূহ তেমন কোনো টু শব্দ করেনি। তাহলে হঠাৎ নয়া পল্টনের ঘটনায় সবার টনক নড়লো। সবাই এক যোগে এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিদান শুরু করলো এটা এখন বড় প্রশ্ন। 

নয়া পল্টনে ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ দুতাবাস, ১৫টি উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র একযোগে বিবৃতি দেয়। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতিদানের পর সর্বশেষ বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিটা নজীরবিহীন। এমন ছোটখাট ঘটনা কেন হোয়াইট হাউস বড় করে দেখলো। এ ব্যাপারে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, এসব (পল্টনের) ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘খুব, খুবই নিবিড়ভাবে’ পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের ভয়ভীতি, হুমকি, হয়রানি ও সহিংসতামুক্ত শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার অধিকারের দাবি যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে জানিয়ে আসছে।

জন কিরবি আরও বলেন, ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে এবং সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে বাংলাদেশের সব পক্ষের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা চাই, তারা হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকবে। কোনো দল কিংবা প্রার্থীকে হুমকি, অন্য কোনো দলের বিরুদ্ধে উসকানি বা সহিংস আচরণ করা যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।’ জন কিরবি বলেন, ‘সহিংসতার ঘটনা পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে তদন্তের’ জন্যও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায় ওয়াশিংটন। 

এর আগে মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। সব মিলিয়ে বিষয়টি আর ছোটখাট নয়। এর দিকে তীক্ষ্ণ নজর বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সেটা এ ঘটনার পরে বিভিন্ন দেশের উদ্বেগের কারণ থেকে প্রতীয়মান। 

এবার বেশ ক’মাস আগ থেকেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যাতে সবার অংশগ্রহণে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোহ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে ব্যাপারে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশী রাষ্ট্রদূতসমূহ তাগাদা দিয়ে আসছিল। একই সঙ্গে বিরোধী দলসমূহ যেন তাদের স্বাধীন মত প্রকাশে সুযোগ পায় সে ব্যাপারেও আহ্বান জানিয়ে আসছে। ফলে ওই ধারাবাহিকতায় বিএনপি ৯টি বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান করতে যেয়ে যেসকল টেকনিক্যাল বাধার সম্মুখীন হয়েছে তারপরও জনসভায় মানুষের ঢল বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষেরও যে আস্থা ও প্রত্যাশা রয়েছে তার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু বিএনপি ৯ বিভাগীয় সম্মেলন করতে যেয়ে বেশ ক’জন নেতা কর্মী হারিয়েছে। এমনকি বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে ও গায়েবী মামলার শিকার হাজার হাজার এমন সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি বিএনপিও দাবি করে আসছে।

এরপরও ঢাকা বিভাগীয় সম্মেলন নয়াপল্টনে অনুষ্ঠান করা নিয়ে যা ঘটছিল সেদিকেও যে তীক্ষè নজর ছিল বিদেশীদের সেটা টের পাওয়া গেল অবশেষে। এমনকি নয় পল্টনের ঘটনায় একজন নিহত হওয়ার ঘটনা ও দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পুলিশ কর্তৃক ‘ক্রাইম সিন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে তল্লাশী, ভাংচুর, মালামাল জব্দ, এবং মহা সচিব, সিনিয়র মহাসচিবসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা করে তাদের গ্রেফতার কারে কারাগারে প্রেরণ সাথে সাধারণ নেতাকর্মী তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে এমন ঘটনায় বিদেশী দেশসমূহ তাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছে এবং সে সঙ্গে হোয়াইট হাউসও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে তা প্রেরণেরও আহ্বান জানানোটা এক রকম কঠিনতর বিষয় বলেই অনেকে মনে করেছেন। 

বিশেষ করে জন বিরবির শেষ উক্তি, ‘সহিংসতার ঘটনা পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে তদন্তের’ জন্যও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি যে আহ্বান জানায় ওয়াশিংটন সেটা ভীষণভাবে কঠরতর হিসেবে দেখা হয়। ওই সূত্র ধরেই কী বিদেশী দুতাবাসসমূহে ঘটনার বিবরণ ও রিপোর্ট প্রেরণ কি-না সেটা সরাসরি না জানা গেলেও অনেকেই বিষয়টা সেভাবেই দেখছেন।

তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগন যতই বলুক না কেন জনগণের ভোটে আমরা ক্ষমতায় এসেছি। বা জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। বা জনগণকে ভরসা করে যে রাজনীতি- সেটা বাস্তবে কতটুকু সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের মতামত যেখানে ব্যর্থ (২০১৩ ও ২০১৮ সনের নির্বাচন প্রমাণিত)। সেখানে দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে, সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিদেশীরা সোচ্চার হলে সেটাকে জনগণ কতটা গ্রহণ করবে সে প্রশ্নটা এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। 

তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশের বিদেশীদের নাক গলানোর বিষয়টা নতুন কিছু নয়। এর আগেও ওয়ান ইলেভেনের ঘটনার আড়ালেও পরাশক্তিদের হাত ছিল বলে বিভিন্ন ব্যাখ্যায় স্পষ্ট। ফলে বিভিন্ন সময় এগুলো হয়ে আসলেও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগন অনেকেই স্বীকার করতে চান না। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এখন এ বিষয়গুলো স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ঘটনায় প্রশ্ন জাগে আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির নাটাই কোথায় বা কার হাতে।

বিদেশী মিশনগুলোতে সরকারের চিঠি প্রদানের ব্যাখ্যা 

১৩ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমরা কূটনীতিকদের জানিয়েছি। কারণ, তারা (বিএনপি) ১০ তারিখের পর থেকে নানা সময়ে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে দেনদরবার করছে। বিএনপির দেনদরবার ঠেকাতেই তথ্যগুলো জানানো হয়েছে।’

এ সময় শাহরিয়ার আলম আরো বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের ব্রিফিং করতে চায় না সরকার। তাই মিশনগুলোতে চিঠি পাঠিয়ে তথ্য জানিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, তারা (বিএনপি) আশ্বাস পেয়েছিল, নতুন করে আরও নিষেধাজ্ঞা আসবে। সেটাকে মিলিয়ে ওই দিন তারা উদ্যাপনের আমেজে বিশাল জনসভা করবে। জনগণ মনে করবে, সরকারের সঙ্গে কোনো বন্ধু নেই। এই পুরো পরিকল্পনাটা তাদের ভেস্তে গেছে।

মিশনগুলোতে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ৭ ডিসেম্বর দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতা কর্মীরা সড়ক অবরোধ করেন। অবরোধের কারণে নয়াপল্টন এলাকায় যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটায় পুলিশ তাঁদের সরে যাওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু বিএনপির বিক্ষোভকারীরা তা অগ্রাহ্য করে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপের পাশাপাশি যানবাহন ভাঙচুর শুরু করেন। তাদের হামলায় পুলিশের ৪৯ জন সদস্য আহত হন, এর মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। শাহরিয়ার আলম বলেন, মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করতেই ডিবি অফিসে নেওয়া হয়েছিল তাঁদের। তাঁদের থেকে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। সে কারণে তাঁদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

শেয়ার করুন