২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৬:১০:৩৯ পূর্বাহ্ন


দেশ’কে সাঈদ হাসান কানন
ফুটবলে জোয়ার ফিরছে
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৭-২০২২
ফুটবলে জোয়ার ফিরছে


বাংলাদেশের ফুটবল বিশ্ব লেবেলে তো নয়ই, এশিয়ান লেবেলেও অনেক নিচে। সাফেও অস্থিত্ব সঙ্কটে ছিল তারা- এ সেদিনও। অথচ এ সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। সেগুলো এখন স্মৃতি। বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে পার্শ্ববর্তি দেশসমূহ। সেই বাংলাদেশের ফুটবলে এখন জোয়ার ফিরতে শুরু করেছে। স্বপ্ন দেখছে, খুব বেশি দিন নয়, ফুটবল তার হারানো স্থান ফিরে পাবার সাথে সাথে এগিয়ে যাবে বহুদূর। দেশ পত্রিকার  সঙ্গে সে কথাই বলেছেন, জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক সাঈদ হাসান কানন।  

দেশ: আপনি বলছেন, ফুটবলে জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু কিভাবে?

সাঈদ হাসান কানন: ২-৩ বছর আগেও আমরা খেলোয়াড় সঙ্কটে ভুগতাম। গ্রাম গঞ্জের যেখানে গিয়েছি, দেখতাম ব্যাট-বল নিয়ে ক্রিকেট খেলছে ছেলেরা। ফুটবলে পা-ই রাখতো না। ছেলেরা বলতো আমরা ক্রিকেটার হবো। এখন সেই গ্রামগঞ্জে ফুটবল নিয়ে উম্মাদনা শুরু হয়েছে। আমি বললো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন, বিশেষ করে সালাহউদ্দিন ভাই , যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, তাতে তৃণমূলে শিশু কিশোরদের মাঝে ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে। ছেলেরা ফুটবলে ফিরছে। তাদের ধ্যানধারণায় ফুটবল নিয়েছে। তারা পাইওনিয়রে খেলছে। বড় কথা, এসকল খেলোয়াড় খুবই ট্যালেন্ট। এমনটা আগে হয়তো দু’চারজন। এখন প্রচুর। এটা কল্পনাতীত। আপনি যখন তৃণমূলে এমনটা দেখবেন, তখন বিশ্বাস করতেই হবে দেশের ফুটবল অবশ্যই ভাল কিছুর দিকেই এগুচ্ছে।  

দেশ: কী সব উদ্যোগ সেটা?

সাঈদ হাসান কানন: আপনি হয়তো জানেন ফুটবল শিখতে হলে এর পারফেক্ট বয়স ৮ থেকে ১০। এ বয়সে যারা ফুটবল তাদের ধ্যান-ধারণায় নিয়ে সঠিক নিয়মে বা আধুনিক সিস্টেমে নিজেকে গড়তে পারবে, তারাই সাকসেস। আমরা এগুলো পাইনি। আমরা বড় হয়ে ফুটবল খেলেছি। যার শিখিয়েছেন, তারাও গতানুগতিক ধারায় শিখিয়েছেন। ফুটবলে অধিক আগ্রহের কারনে আমরা জাতীয় পর্যায়ে খেলেছি। কিন্তু এর আগে অনেকেই তো হারিয়ে গেছে। এবং সে তালিকায় অনেক ট্যালেন্ট রয়েছে।

এখন যা হচ্ছে সেটা- বিএফএফ গ্রাসরুট কোচ, সি লাইসেন্স কোচদের ট্রেনিং করাচ্ছে। এএফসির উদ্যোগে ওই ট্রেনিং হচ্ছে। এতে সাবেক খেলোয়াড় বা যারা কোচিংয়ে অভিজ্ঞ বিভিন্ন এলাকার এমন প্রায় সাড়ে সাতশ ‘এ’ ‘বি’ ও ‘সি’ কোচেস ডিপ্লোমাধারী, পর্যায়ক্রমে আধুনিক কোচেস ট্রেনিং দিয়ে তৃণমূলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে অন্তত ৬৩ টি একাডেমি রয়েছে। এসব ডিপ্লোমাধারীরা  সেখানে এসব খেলোয়াড়দের ট্রেনিং করাচ্ছেন। যেহেতু ট্রেনাররা আধুনিক সিস্টেমে ট্রেনিং করাচ্ছে, তাই তৃণমূল থেকে মানসম্মত খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে। গত দুই তিন বছর ধরে এ ক্ষুদে ফুটবলাররা বেরুচ্ছে। যাদের বয়স বিভিন্ন লেবেলের।


সাঈদ হাসান কানন/ফাইল ছবি 

এখন যে পাইওনিয়র লীগ, সেখানে এসব খেলোয়াড়ই। ফলে এরা খুবই মেধাবী। ফুটবল নিবেদিত। আমি বাড্ডা জাগরনী ক্লাবেরও হেড কোচ। সেখানে এক সময় ট্রায়ালে খেলোয়াড় পেতাম না। এখন শত শত খেলোয়াড় আসছে। কাকে রেখে কাকে নেব এমন অবস্থা। এমনটা সর্বত্রই। সবাই ট্যালেন্ট। আমি খুবই আশাবাদী। এরাই এক সময় ক্লাবগুলোতে খেলবে। এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশের ফুটবলকে কাংখিত মার্কে। কারণ আধুনিক ট্রেনিং নিয়ে আসা খেলোয়াড়রা সহজেই হারিয়ে যাবে না। তারা যাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিভাবে কতক্ষণ ট্রেনিং করতে হয়। কি খেতে হবে। কতক্ষণ বিশ্রাম। কিভাবে শিখবে। কতক্ষণ। যাবতীয়। যা আগের খেলোয়াড়রা জানতেন না বিধায় একটা সময়ের পর ইনজুরির সঙ্গে লড়তে হতো। হারিয়েও যেতেন তারা এসব কারনে। 

সাঈদ হাসান কানন জাতীয় দলে প্রায় এক যুগ ফুটবল খেলেছেন। মোহামেডান ক্লাবেও খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। ডাকসুর নির্বাচিত ক্রীড়া সম্পাদক পরবর্তিতে মনযোগী হয়েছিলেন ব্যবসাতে। সেটাতে সফল হলেও মন পড়ে থাকে ক্রীড়াঙ্গনেই। এরপর কোচিং পেশার সর্বোচ্চ লাইসেন্স নিয়ে এখন ফুটবল ফেডারেশনের এএফসি’র ট্রেনার। যাদের অধীনেই হচ্ছে গ্রাসরুটের ওই কোচেস ট্রেনিং। একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোটিং ক্লাবেরও গোলকিপার কোচ।

দেশ: ফুটবল ফেডারেশনের এ উদ্যোগে না হয় খেলোয়াড়ের ঘাটতি পূরন হলো। এ সকল খেলোয়াড়রা কোথায় খেলবেন। তাদের গাইড-অর্থ দেবে কে?

সাঈদ হাসান কানন: এটা ভাল প্রশ্ন। এটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমি আবার চ্যালেঞ্জ মনেও করিনা। কারণ এখন বসুন্ধরা,সাইফ পাওয়ার,ফর্টিজের মত বিত্তশালীরা ক্লাব নিয়ে আসছে। প্রচুর অর্থ খরচ করার মন রয়েছে। এখানে আরো বড় বড় কোম্পানীগুলো চলে আসবে। এতে এ সকল খেলোয়াড় ওই সব ক্লাবে ঠাঁই পাবে। যাদের আধুনিক মাঠ,খেলার সরঞ্জাম,অর্থ সব আছে।

ফলে এদেরকে অনেকটাই ইংশিল প্রিমিয়ার লীগের আদলে এগিয়ে নিয়ে যাবে। খেলোয়াড়দের তারাই পরিচর্যা করবেন। এখন বিপিএলে যেমন ১০টি দল খেলে। বসুন্ধরা,সাইফ পাওয়ারটেক,ফোর্টিজদের মত বিত্তশালীরা যদি অন্যদলগুলোতে স্পন্সর বা নিজেরাই ক্লাব নিয়ে আসে তাহলে খেলোয়াড়দের অর্থ ও নিজেদের বেড়ে ওঠার যে পর্যাপ্ত মানসম্মত ট্রেনিং সেটার আর অভাব হতোনা। এরাই জাতীয় দলের খেলোয়াড়,পাইপলাইনের খেলোয়াড় সবই। 

প্রশ্ন : ঢাকা লীগের মানের উপর কতটা আস্থা আপনার?

সাঈদ হাসান কানন: বর্তমানে নিয়মিত লীগ হচ্ছে। প্রচুর খেলা হচ্ছে প্রতিটা বিভাগে। হ্যাঁ, রেফারিসহ অন্যান্য মান আরো উন্নত হয়ে যাবে এমনিতেই। ফুটবল ফেডারেশন এটা অন্তত নিয়মিত করে যাচ্ছে। ফলে তৃণমূল থেকে বাছাই হয়ে আসাদের স্থানকাল ভেদে খেলতে সমস্যা নেই। যে যারমত লীগ খেলবে। যারা নিজেকে সেভাবে মেলে ধরবে তার ডিমান্ড হবে। এখন তো লীগে ক্লাবগুলো প্রচুর অর্থ দিচ্ছে। পর্যাপ্ত ট্রেনিং ও অর্থ। দুটোই তো বাধা ছিল। এটা পেলে কেন এগিয়ে যাবেনা ফুটবল?

তবে ফুটবল ফেডারেশনকে আরেকটু উদ্যোগী হয়ে বসুন্ধরার মত বড় বড় কোম্পানীগুলোকে উদ্ভুদ্ধ করে ফুটবলে নিয়ে আসতে হবে। ফুটবলের স্বার্থেই। এক সময় মোহামেডান আবাহনী ব্রার্দাসের প্রভাব ছিল। এখন তাদের সে প্রভাব কমে গেছে। আবাহনীকে এখনও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে বেক্সিমকো। মোহামেডানে সেভাবে নেই। তবু চলছে। ব্রার্দাস,আরামবাগ প্রমুখদের সেভাবে নেই। বিত্তশালীরা এসব ক্লাবে ডোনেশন করতে পারে। আবার নিজেরাও ক্লাব করে এগিয়ে আসতে পারে। তাহলেই তো হলো। সেখানেই খেলোয়াড়দের ঠাঁই হবে।

যেমনটা ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগসহ অন্যান্য বড় ক্লাবগুলোতে হয়ে আসছে। যাদের খেলোয়াড় পাইপলাইন ধরে রাখতে জুনিয়র টিমসহ বিভিন্নস্তরের টিম থাকে। যেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে তারা সেরাদের। আজ যারা বিশ্ব ফুটবল মাতাচ্ছেন, তারা কোথাকার? ওই সিস্টেমেই তো বের হয়ে আসা। তারা পারলে আমাদের দেশে হবে না কেন?   

প্রশ্ন:  কোচেস ট্রেনিংয়ে যারা আসছেন বা আসবেন তাদেরকে উৎসাহী করতে হচ্ছে কি-না।

সাঈদ হাসান কানন: সকল খেলোয়াড়েরই দীর্ঘদিনে খেলে যাওয়া বা সাধনা করা ইভেন্ট নিয়ে একটা টান থাকে। আমাদের দেশে আগে এদের মূল্যায়ন হতো না। বহু খেলোয়াড় মূল্যায়ন না পেয়ে ব্যবসাতে বা বিদেশে বা অন্যপেশায় চলে গেছেন। কিন্তু গত ১০-১২ বছর খেলোয়াড়দের বেশ মূল্যায়ন হচ্ছে। ফুটবল ফেডারেশন এটা করছে। ফলে আমি মনে করি তাদের কাজে লাগানো প্রয়োজন। কোচ হওয়ার ক্ষেত্রে একজন সাবেক ফুটবলার যতটানা পারদর্শী বা সহজে শিখবেন, অন্যরা সেটা সময় নেবে। তবে হ্যাঁ, অনেকেরই আগ্রহ আছে।

তারা চায় ফুটবলকে কিছু দিতে। তাইতো এতগুলো কোচ ইতিমধ্যে ট্রেনিং নিয়েছে। ভবিষ্যতে আরো আসবেন। তারা তৃণমূলে চলে যাবেন। সিনিয়ররা আবার অন্য দায়িত্বে যাবেন এটাই রোটেশন। তাছাড়া ক্লাবগুলোও সহকারি বিভিন্ন টাইপের কোচ নিয়োগ দিচ্ছে। হেড কোচ না হয় বিদেশের থেকে নিয়ে আসে। কিন্তু অন্যকোচদের তো দেশ থেকেই নিতে হয়। ফলে তারা সুযোগ পাচ্ছেন। ফুটবল ফেডারেশনেরও বিভিন্ন কোচ প্রয়োজন। সব মিলিয়ে তারাও নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। 

পরিশেষে, আমি বলবো, যেভাবে এখন ফুটবল ফেডারেশন গুছিয়ে এগুচ্ছে, এটাতে দেশের ফুটবলের ভবিষ্যত চমৎকার। যা ইতিপূর্বে হয়নি। আমি ফুটবলে আবারও একটা জোয়াড় দেখতে উদগ্রীব হয়ে রয়েছি।


শেয়ার করুন