ফেঞ্চুগঞ্জে উপজেলার সামাজিক সংগঠনের মাতৃ প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ চলতি বছরের এই ডিসেম্বরে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছে যা একটি সামাজিক সংগঠনের জন্য অনেক গর্বের। সেই গর্বিত প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্য হিসাবে নিজেও গর্ব অনুভব করছি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের শপথ নিয়ে ১৯৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ কেবল মানবিক কর্মকান্ডে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি অঙ্গনে সরব রয়েছে ঐতিহ্যের ধারক বাহক ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ। বিশেষ করে নাট্যাঙ্গনে ফেঞ্চুগঞ্জে যুবসংঘের রয়েছে সোনালী ঐতিহ্য।
পঞ্চাশ- ষাট দশকে গ্রামীণ জনপদের খেটে খাওয়া মানুষজনকে নাটকের মাধ্যমে বিনোদিত করে আসছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ নাট্যগোষ্ঠির পূর্বসূরিরা। যুগ থেকে যুগে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হাত ধরাধরি করে সগৌরবে ইতিহাসের সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ। ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের সাফল্যের পালকে অনেক সফলতা যুক্ত হলেও সব চেয়ে বড় সফলতা নিজস্ব অর্থায়নে সরকারি অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন করা। দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে জাতীয় দিবসে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের সরকারি কর্মসূচির অংশ হিসাবে প্রতিবছর নাট্যানুষ্ঠান সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করে থাকে ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ। স্থানীয় প্রশাসনের এই আস্থা ও বিশ্বাসের গর্বিত অংশিদার ফেঞ্চুগঞ্জ যুবসংঘের প্রতিটি সদস্য। নাটক দিয়ে, নাটকে অভিনয় করে ফেঞ্চুগঞ্জ যুবসংঘ নাট্যগোষ্ঠীর অনেক অভিনেতা দর্শকদের কাছে তারকা ইমেজ সৃষ্টি করেছেন। শুধু ফেঞ্চুগঞ্জ নয়, পার্শ্ববর্তী উপজেলা গুলোতেও আমাদের নাট্যগোষ্ঠির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
আমার দুরন্ত কিশোর বেলা থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের নাট্যশিল্পীদের মধ্যে অনেকেই তারকা, মহা তারকা হিসাবে স্বপ্নপুরুষ ছিলেন । মনে পড়ে সেই দিন গুলোর কথা। আশি / নব্বই দশক ছিলো ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের নাট্যাঙ্গনের স্বর্ণ যুগ। প্রতিবছর ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ ডিসেম্বরে নাটক মঞ্চস্থ করতো চন্ডী প্রসাদ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। নাটক মঞ্চস্থ করার পূর্বে কয়েক মাস ধরে মহড়া দিয়ে নাট্যশিল্পীরা অসাধারণ টিমওয়ার্ক গড়ে তুলতো। মনে পড়ে আমার বাড়ির পাশে কাসিম আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমে রাতে রিহার্সেল হত। পরে ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের কার্যালয়েও মহড়া হয়েছে। অভিনেতাদের সংলাপগুলো রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে রাজা, উজির আর নাজিরের ভরাট কন্ঠগুলো আমাকে আকৃষ্ট করত প্রচন্ডভাবে। অতিথি শিল্পীদের নিয়ে চুড়ান্ত মঞ্চায়নে অভিনয় শিল্পীদের অভিনয় দেখতে এলাকার নারী পুরুষ দর্শকদের সরব উপস্থিতিতে মাঠ ভরে উঠতো। ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ নাট্যশিল্পীদের মাঝে কয়েকজন তারকা থেকে মহা তারকা হয়ে উঠছিলেন। তাদের মধ্যে যিনি স্বপ্নের নায়ক ছিলেন, যার কথা বলার ধরণ, অভিব্যক্তি অনুকরণ করতাম তিনি হলেন ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের নাট্যব্যক্তিত্ব ফয়জুল ইসলাম মানিক। সকলের প্রিয় মানিক স্যার। মানিক স্যার উনার অভিনয় দিয়ে অনেকের স্বপ্ন পুরুষ হয়ে উঠছিলেন প্রতিটি নাটকে মানিক স্যার সুনিপুণ অভিনয় দিয়ে দর্শক হৃদয় জয় করেছিলেন। চিরসবুজ মানিক স্যার দীর্ঘ চার দশক নায়কের চরিত্রে সফলতার সাথে অভিনয় করেছেন। তারকা থেকে মহা তারকার ইমেজ যারা সৃষ্টি করেছিলেন তার মধ্যে কয়েকজন হলেন বাদশাহ, সম্রাট চরিত্রে মোঃ ফরমান আলী, খল অভিনয়ে মোতাহির আলী ফুরুক, ইসরাইল খান কলু, শাহেদ আলী শাহ, লক্ষী প্রসাদ, সুনির্মল কুমার দেব বিমল, কৌতুক অভিনয়ে কুটু চান্দ, আব্দুল আহাদ, রাজু আহমদ রাজা, আতাউর রহমান চিনু অন্যতম। অভিনয় দিয়ে তারকা ইমেজ সৃষ্টি করেছেন আবুল হোসেন শাহ, আব্দুল হামিদ মনোয়ার, ওসি সোরহাব হোসেনসহ আরো অনেকেই।শক্তিমান অভিনেতা মোতাহির আলী ফুরক বিয়ের কয়েকমাস পর নববধূর বিয়ের কাতান শাড়ি কেটে অভিনয়ের জন্য জরির পোশাক তৈরি করেছেন তেমনি অভিনেতা আবু মিয়া বিয়ের রাতে নববধূকে বাসরঘরে একা রেখে মঞ্চে অভিনয় করেছেন। অভিনয়ের প্রতি তাদের এই ভালবাসার কথা যুবসংঘের নাটকের মহড়ায় উচ্চারিত হয় পরম শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায়। ফেঞ্চুগঞ্জ যুবসংঘ নাট্যগোস্ঠীর অনেক অভিনয় শিল্পী অভিনয়কে ভালবেসে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।আজো তাদের অভিনয়ে কিশোরবেলার সেই স্বপ্ন পুরুষদের অনেকের সাথে যুবক বেলায় এক মঞ্চে অভিনয় করতে পেরে একজন নগণ্য নাট্যকর্মী হিসাবে আমি গর্ববোধ করি। সময়ের পরিক্রমায়, দিন বদলের ডাকে ২০১৪ সালে নবীন প্রবীনদেন সমন্বয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। আমি সংগঠনের সহ সাধারণ সম্পাদক হই। সময়ের আহবানে সাড়া দিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ যুবসংঘের তরুণরা আরো গতিশীল করে তুলে ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের কার্যক্রম।
ফেঞ্চুগঞ্জ যুবসংঘের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাঝে সবচেয়ে ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান হলো নাট্যনুষ্ঠান। ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রায়হান ধর্মীয় বাধ্যবাদকতার কারণে শুধুমাত্র নাট্যানুষ্ঠানের কার্যক্রমে সক্রিয় না থাকায় নাট্যানুষ্টান সফলভাবে বাস্তবায়ন ছিল আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ সফলতার সাথে ব্স্তবায়ন করতে পেরেছি। নতুন কমিটি গঠনের পর প্রতিবছর নাট্যানুষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব ক্লাবের সাধারণ সভায় উপস্থাপন করে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে তরুণদের কারণেই। তরুণরাই আমাদের সমাজের প্রাণ । যারা লোভ, মোহের উর্ধ্বে উঠে নিজেকে জয় করে নিয়েছে। সুবর্ণ জয়ন্তীতে ফেঞ্চুগঞ্জ যুবসংঘের সকল কর্মকর্তা ও সদস্যদের ধন্যবাদ জনাচ্ছি।
লেখকঃ জুয়েল খান, নাট্যকর্মী ও সহসাধারণ সম্পাদক ফেঞ্চুগঞ্জ যুব সংঘ।