২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৩:২৩:৫০ পূর্বাহ্ন


অস্থির বাজার দায় কার?
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৭-২০২৩
অস্থির বাজার দায় কার? বাংলাদেশের কাঁচাবাজার


দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা, তদারকির অভাব এবং সরকারঘেঁষা সিন্ডিকেটের প্রভাবে বাংলাদেশের জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না তেল, চিনি, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ সব নিত্যপণ্যের দাম।  মুক্তবাজার অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কমলেও প্রতিফলন নেই বাংলাদেশে। দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাম্পার ফলন এবং পর্যাপ্ত মজুত থাকলেও ক্রেতা সাধারণকে উচ্চমূল্য গুনতে হচ্ছে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে। সরকার বাজারে সক্রিয় থাকার কথা ঘোষণা করলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ পণ্য মূল্য। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই বলেন, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে তিনি অসহায়। একে তো করোনার অভিঘাতে অনেক মধ্যবৃত্ত এখন নিম্নবিত্ত হয়ে দরিদ্রসীমার প্রান্তে, তদুপরি সীমিত আয়ের মানুষের এখন নুন আন্তে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। আয় বাড়েনি অধিকাংশ মানুষের, কিন্তু বাজারে মূল্য তিন গুণ-চার গুণ বেড়ে গাছে। পাশাপাশি জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ মূল্য দফায় দফায় বাড়ায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে মানুষের। হয়তো খাদ্য সংকট নেই, দুর্ভিক্ষ নেই। কিন্তু দেশজুড়ে সাধারণ মানুষ নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে সরকারি দল বা বিরোধীদলগুলোর কোনো নজর আছে বলে মনে হয় না। এক দল ক্ষমতা ধরে রাখার আর অন্য দল ক্ষমতায় ফিরে আসার নেশায় মত্ত। 

দেশে কিন্তু কৃষক সমাজ নানাধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য সংকট সত্ত্বেও নানা শস্য এবং পণ্যের বাম্পার ফলন করেছেন।  যাতায়াত ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হওয়ায় দেশজুড়ে পণ্য পরিবহন এখন অনেক সহজ। কৃষকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যায্যমূল্য না পেলেও সীমাহীন মুনাফা লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট। সরকার কেন দেশীয় পণ্য মৌসুমে সংগ্রহ করে গুদামজাত করে যথাসময়ে বাজারে ছেড়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে না। কেন আড়তদার এবং মিলমালিকদের আকাশছোঁয়া মুনাফা লাভের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে? কোথায় আছে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনা? জানি, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মূল্য বাজার নির্ভর।

বিশেষত সংযুক্ত বিশ্বে কিছু কিছু পণ্য মূল্য বিশ্ববাজার নির্ভর। মূল্য বাড়লে মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের বাজারে মূল্য দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মূল্য কমলে বাজারে তার প্রভাব পড়ে না, অর্থাৎ বাজারমূল্য কমে না। দোকানিদের নানা অজুহাতে তিলে তিলে কমে। কিন্তু সেটাও ফেরে না আগের অবস্থানে।

সম্প্রতি বাজারে কাঁচা মরিচের দাম অবিশ্বাস্য মাত্রায় বেড়ে প্রতি কেজি ৮০০-১২০০ টাকা হয়েছিল। ভারত থেকে আমদানি শুরু হতেই নেমে ২০০ টাকার মধ্যে ফিরে এলো। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আবার ৩০০-৪০০ হয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মরিচ চাষিরা এ দামটা পাচ্ছে না। তারা বিক্রি করছে অনেকটাই আগের দামেই। তাহলে এ কারসাজিটা কার? শুধু মরিচই নয়, সুযোগ-সুবিধায় প্রায়ই বেড়ে যায় কাঁচামালের দাম। যেমনটা ৪০ টাকা মূল্যের শশা বিক্রি হলো ঈদের আগে ৯০ থেকে ১২০ টাকায়। ঈদের পর সেটা আবার ৪০ টাকায়। এ বাড়ানোর অর্থটা কী। কারা এ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। এর অগে রমজান শুরুর আগে ব্রয়লার থেকে সব ধরনের মুরগির বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয় কিছু চিহ্নিত গ্রুপ। যে ব্রয়লার বিক্রি হতো কেজি ১২০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে। সেটা কোথাও কোথাও ২৭০ থেকে ৩০০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। এরপর কাজী ফার্ম থেকে শুরু করে ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের লোকজনের বৈঠকের পর সেখানেই কমিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করে। কিন্তু একই সঙ্গে কেজিতে ১২০ থেকে ১৫০, ১৭০ টাকা বাড়ানোর মুরগির দাম কমানো হয় কুড়ি টাকা, ২৫ টাকা। তাহলে বাড়ানো ও কমানোর সামাঞ্জস্যতা কী রইলো। ওভাবেই চলে আসছে। এখনো ব্রয়লারের মূল্য কোরবানির মাংসের ভিড়েও ২০০ টাকার কাছাকাছি এবং এ দাম প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। তেমনটা ডিম। ৮০ থেকে ৯৫ টাকা ডজন বিক্রি চলছিল দীর্ঘদিন। হঠাৎ সেটা দেড়শ টাকায় চলে যায়। এর বেশিও হয়। কিন্তু কিছু কমিয়ে-টমিয়ে এখন দেড়শ টাকার আশপাশেই ডজন চলছে। 

এভাবে সাবান, সাবানের গুঁড়া থেকে শুরু করে প্রতিটা সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের মূল্য অন্তত দ্বিগুণ। কিছু কিছু তার চেয়েও বেশি। গম ইমপোর্টের জন্য গম দ্বারা তৈরি করা সব ধরনের বাচ্চাদের খাবার থেকে শুরু করে বিস্কুট, পাউরুটি থেকে শুরু করে এ জাতীয় পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। মানুষের ইনকাম নিম্নমুখী। আর খরচের পাল্লাটা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। 

এগুলোর প্রকৃত মূল্য তদারক, অবৈধ গুদামজাত নিয়ন্ত্রণে কেন সরকার ব্যর্থ? কেন সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণ গ্রুপ কেন সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?

জানি, মূল্য স্ফীতি এবং ডলার টাকা বিনিময় হারের অজুহাতে আমদানিকারকরা পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করছে। এখন সংকট কেটে যাওয়ার কথা। সরকার শুল্কব্যবস্থা সংস্কার করে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা অত্যাবশ্যক মনে করি। কথায় কথায় রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেওয়া হয়। কিন্তু জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য বিশ্ববাজারে করোনার আগের পর্যায়ে ফিরে এসেছে।  বাংলাদেশের বাজারে কিন্তু প্রতিফলন নেই। বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে এবং জনগণ আসন্ন নির্বাচনে ভোট অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলে কিন্তু সরকার বিপদে পড়তে পারে।

শেয়ার করুন