২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৩:০৫:২৮ অপরাহ্ন


উপনির্বাচনে হামলার ঘটনায় সরকার বিব্রত
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধের উপক্রম
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৭-২০২৩
প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধের উপক্রম ঢাকায় হিরো আলমের ওপর হামলা


আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর ওপর হামলার ঘটনায় আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তুমুল আলোচনার ঝড় বইছে। একদিকে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় সরকার মারাত্মক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশে আগামী দিনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।  

ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে ধাওয়া দিয়ে বাইরে আনার পরে রাস্তায় ফেলে ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমকে পিটিয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকেরা। গণমাধ্যমের খবের বলা হয়, হামলাকারীরা নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরে ছিলেন। ১৭ জুলাই সোমবার বেলা সোয়া তিনটার দিকে রাজধানীর বনানী এলাকার বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে হিরো আলমের ওপর এ হামলা হয়। মারধর থেকে বাঁচতে একপর্যায়ে  হিরো আলম দৌড়ে পালান। হামলাকারীরা এ সময় তাঁকে পেছন থেকে ধাওয়া দেন। হিরো আলম একপর্যায়ে বনানীর ২৩ নম্বর সডকে গিয়ে একটি রিকশায় ওঠেন। পরে গাড়িতে করে চলে যান । স্কুলের প্রাঙ্গণ থেকে বেরুনোর পরে হিরো আলমের পাশে পুলিশ সদস্যরা ছিলেন না। স্কুল থেকে বের হয়ে ফটকের সামনে দিয়ে সোজা ১৬ নম্বর সড়কের দিকে দ্রুত এগোতে থাকেন হিরো আলম। একপর্যায়ে হামলাকারীরা হিরো আলমকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেন, তখন তাঁকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন তারা। হিরো আলমের সঙ্গীরা তাকে রক্ষা করে সামনের দিকে নিয়ে যান। ২৩ নম্বর সড়কের এ ব্লক পর্যন্ত তাঁকে পেছন থেকে ধাওয়া করে হামলাকারীরা। অভিযোগ উঠেছে ঘটনাস্থলের আশপাশে পুলিশের বেশ কয়েক সদস্য উপস্থিত থাকলেও তাঁরা ছিলেন ‘দর্শকের’ ভূমিকায়।

প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ নিন্দা  

হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ধরনের ঘটনায় নিন্দা জানান।  হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত। ১৭ জুলাই সোমবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বনানীতে নিজ নির্বাচনী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আরাফাত বলেন, ‘আমি শুনেছি একজন প্রার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। যদি তারা আমাদের দলের কর্মী হয়, তাহলে দলের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি চাই সত্যটা উন্মোচিত হোক।’

জাতিসংঘের উদ্বেগ

ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেনের (হিরো আলম) ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। ১৮ জুলাই মঙ্গলবার জাতিসংঘের বাংলাদেশ কার্যালয়ের পক্ষ থেকে এ উদ্বেগ জানানো হয়। হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে টুইট করেছেন বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস। উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি গোয়েন লুইস টুইট বলেন, সহিংসতা ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের যে মৌলিক মানবাধিকার, তা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করতে হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়েও 

এদিকে হিরো আলমের ওপর হামলার বিষয়টি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস ব্রিফিংয়েও উঠেছে। ১৭ জুলাই সোমবার প্রেস ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। তাঁরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার যেকোনো ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, স্বচ্ছভাবে ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে উৎসাহিত করেন। আর যারা এ হামলার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে বলেন।

বিএনপি’র বিবৃতি

আওয়ামী লীগ হিরো আলমকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারছে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার (১৭ জুলাই) বিকেলে খুলনা বিভাগীয় তারুণ্যের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তারা হিরো আলমকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারছে না। হিরো আলম ভোটকেন্দ্রে গেলে তাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বের করে দেয় এবং মাটিতে ফেলে মারধর করেছে। ফখরুল বলেন, আমরা বলেছি শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। 

ডিএমপি কমিশনারের আস্থাও ভেস্তে গেলো

একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছে হিরো আলম মার খাচ্ছেন, সাপ বা জন্তু-জানোয়ারকে পেটানোর সময় কিছু মানুষের যে দেহভঙ্গি দেখা যায়, সেই একই কায়দায় নৌকার ব্যাজধারী লোকজনকে দেখা গেল তার ওপর চড়াও হতে। তারা হিরো আলমের সাদা পাঞ্জাবি ধরে টানছেন, ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, লাথি মারছেন, মাথার ওপর ধরেছেন উঁচু লাঠি। হিরো আলম ছুটে রিকশায় ওঠার চেষ্টা করলেন, ধাওয়া খেয়ে রিকশা থেকে নেমে আবার দৌড়। এরপর তিনি একটি হাসপাতাল থেকে লাইভ দিয়েছেন। এই হলো ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের নির্বাচনী হালচাল। তবে এসব ছাপিয়ে পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব তথ্য দিয়ে পত্রিকাটিতে বলা হয় যে, এর আগে, ৪ জুলাই নির্বাচন কমিশন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার বিষয় নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকসহ অন্যদের সঙ্গে বসেছিল। আড়াই ঘণ্টার বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দিলাম। আপনারা ১৭ তারিখের নির্বাচন দেখেন। আমাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ পান কি না। যদি না পান, তখন আমাকে বইলেন। তখন আমি ডিএমপি কমিশনার হিসেবে নাকে খত দিয়ে চলে যাব।’ আর তাই এধরনের ঘটনায় সবার মনে প্রশ্ন দেখা দেয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতার শতভাগ নিশ্চয়তা যে দিলেন ডিএমপি কমিশনার-তার কি হবে?

শেষ কথা

সর্বশেষ খবরে যতটুকু পাওয়া গেছে তা হলো ঢাকা-১৭ আসনে ভোট চলাকালে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় করা হত্যাচেষ্টার মামলায় দুজনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিব দুই আসামির তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি গ্রেপ্তার অপর পাঁচ আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। রিমান্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন ছানোয়ার কাজী (২৮) ও বিপ্লব হোসেন (৩১)। তাঁদের বাড়ি গোপালগঞ্জে। কারাগারে পাঠানো পাঁচ আসামি হলেন মাহমুদুল হাসান (২৭), মোজাহিদ খান (২৭), আশিক সরকার (২৪), হৃদয় শেখ (২৪) ও সোহেল মোল্লা (২৫)। এই পাঁচজনের মধ্যে মাহমুদুল, মোজাহিদ ও সোহেলের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। এ ছাড়া হৃদয়ের বাড়ি শরীয়তপুর এবং আশিকের বাড়ি কুমিল্লা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, সরকার হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনার যে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে তা অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। সরকার এধরনের পদেক্ষপ না নিয়ে সময় ক্ষেপণ করলে বিষয়টি নিয়ে দেশে বিদেশে নানান ধরনের প্রশ্ন দেখা দিতো।

 সুষ্ঠু তদন্তে মাধ্যমের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আরাফাতের ভাষায়’ আমি চাই সত্যটা উন্মোচিত হোক- তা সবাই মনে প্রাণে চায়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ীরা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচনে নিরপেক্ষতার শতভাগ নিশ্চয়তা যে গ্যারান্টি দিলেন সেই ডিএমপি কমিশনারের কি হবে?  পুলিশ, গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংস্থা ও উপস্থিত জনতার সামনে কারা তাকে মারল? কেনইবা একজন প্রার্থীর গায়ে এভাবে হাত তুলল? অথচ ঘটনার দিন ১৭ জুলাই সোমবারই দুপুর সোয়া ২টার দিকে বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। দুপুর সোয়া ২টায় ডিএমপি কমিশনার কথা বলে যাওয়া ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেলা ৩টা ১০ মিনিটে ওই কেন্দ্রে হিরো আলমের ওপর হামলা করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তদন্তে কি এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে? জবাব কে দেবে? বিষয়টি কি এমন যে, সরকারকে কঠিন সময়ে তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জনই কি দলের ভেতরে থাকা অতি উৎসাহী কেউ কেউ জড়িত?

শেয়ার করুন