২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৪:১১:৫৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান


চূড়ান্ত লক্ষ্যে দেখেশুনে এগোচ্ছে বিএনপি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৮-২০২৩
চূড়ান্ত লক্ষ্যে দেখেশুনে এগোচ্ছে বিএনপি


ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ‘এক দফা’ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ের পানে ছুটছে বিএনপি ও সমমনা দলসমূহ। ক্রমশ দাবি আদায়ে কঠোর হচ্ছেন তারা। এ পর্যায়ে ক্ষমতাসীন ও প্রশাসনের রক্তচক্ষু থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিএনপি খুব কৌশলে এগোচ্ছে কর্মসূচি নিয়ে। বেশ ধীর লয়ে রয়ে-সয়ে এগোচ্ছেন তারা। এর বহুবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে অতীতে বিএনপি যে মাত্রায় আন্দোলন করে আসছে, এবার বিএনপিকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। বারবার মুখে বলছেন তারা ‘অহিংস’ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা এগোতে চায়। মাঠেও তাই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে যে নির্দেশনা তৃণমূলে সেটা পালিত হচ্ছে। কারণ বিগত সময়ের মতো মারদাঙ্গা বা বেপরোয়া হয়ে আন্দোলন করলে সেখানে শুধু কর্মীরা থাকবে, রাজপথে মারও জুটবে। বিএনপি এখন চায় কর্মীদের হেফাজত ও সাধারণ মানুষ যাতে আস্থা পায় আন্দোলেনে শরিক হতে।  এজন্য বিএনপির কর্মসূচি বিপুল পরিমাণ মানুষের উপস্থিতি ঘটছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যা এর আগে এরশাদবিরোধী সম্মিলিত আন্দোলনে চোখে পড়েনি। 

বিএনপির আন্দোলনের গতিপথ  

বিএনপি ‘এক দফা’ দাবি দিয়েছে বটে। অনেকেই মনে করেছিলেন বিএনপি সম্ভবত আর মাঠ থেকেই ফিরবে না, লাগাতার কর্মসূচিতে থাকবে, কিন্তু না। বিএনপি চলছে ধীর লয়ে। পূর্বের প্ল্যান। নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ নিয়ে শেষ মুহূর্তে চূড়ান্ত লক্ষ্যপানে এগোবে। একদফা ঘোষণার পর থেমে থেমে কর্মসূচি পালন করা তার প্রমাণ। বংলাদেশের রাজনীতিতে কী ঘটছে এ ব্যাপারে বিশ্বের উন্নত সব দেশের কঠোর নজরদারি। পশ্চিমাজোট বা উন্নয়ন সহযোগী কখনই আন্দলনের নামে সহিংসতা পছন্দ করে না। আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ। যা তাদের নিজেদের দেশেও হয়, তদ্রুপ। বিএনপি তাদের সমর্থন ধরে রাখতে ভাঙচুর, আগুন, মারধর এসবে যাচ্ছে না। 

অবশ্য এ প্রক্রিয়ায় যে তারা নতুন তা নয়, দীর্ঘদিন অহিংস আন্দোলন করেছেন বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামেরা যে কর্মসূচি করতেন অনেকটা সে আদলে। একসময় বাম রাজনীতির সাপোর্টার কম হওয়ায় তাদের ওইসব আন্দোলনের ধরন যেমন-পদযাত্রা, মোমবাতি প্রজ্বালন, লিফলেট বিতরণ, মাইকিং, মানুষকে বোঝানো  এ ধরনের কাজগুলো করতো। বিএনপি দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ওই টাইপের কর্মসূচিই করেছে। কিন্তু এ টাইপের কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায় হবে না, এটা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যারা সামান্য খোঁজখবরও রাখেন তারাও বলবেন, বিএনপিও জানে। তবু সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিদেশিদের পছন্দশীল হতে পূর্বধারা পাল্টে ফেলেছে। 

বিভাগীয় সম্মেলনে উপচেপড়া ভিড় দেখেছে বিশ্ব। এরপর বড় সমাবেশের মধ্যে সোহরাওয়ার্দীতে তারুণ্যের বিশাল সমাবেশ। পল্টনের সমাবেশ। যা প্রমাণ করে দেশের তরুণদেরও তারা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তাদেরও ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে। গত দুই টার্ম ২০১৪ ও ২০১৮ সনে কোনো তরুণ ভোট দিতে পারেনি। যেভাবে হোক তারা বঞ্চিত থেকেছে। এবার তাদের সে ভোট দেওয়ার বাসনা জেগেছে। অধিকার আদায়ে বিএনপির ডাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে এসেছিলেন তারা। 

এরপর পল্টনের মহাসমাবেশ। গত ২৮ জুলাইয়ের এ সমাবেশেও বরাবরের মতো দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোক জড়ো হয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির পরও। সঙ্গে কিছু ব্যতিক্রম চিত্রও চোখে পড়েছে। সেটা ছিল বেশ কিছু ফ্যামিলি এসেছিল কোলের বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আগের দিন রাতে তারা রাতযাপন করেছে পল্টনের ফুটপাথে। এটা ছিল বিরল দৃশ্য। সবাইকে নিয়ে কেন এসেছেন, তার জবাবে অকপটে বলেছেন, নির্বাচনে ভোটের অধিকার ও পছন্দসই প্রার্থী বেছে নেওয়ার যে নাগরিক অধিকার, সেটা ফিরে পেতেই তাদের ফ্যামিলিসহ ওই আগমন। 

পশ্চিমাজোটের অনুকম্পা লাভ 

বিএনপি মূলত ওই (২৮ জুলাই) মহাসমাবেশ থেকে ‘সমাবেশ কর্মসূচি’ থেকে বেরিয়ে অবস্থান কর্মসূচি যা প্রকারান্তে অবরোধ টাইপের মতো শক্ত কর্মসূচির দিকে এগুলোর ইঙ্গিত দিয়েছিল। যার প্রথম কর্মসূচিই উত্তাপ ছড়িয়েছে। আসলে বিএনপি যে কর্মসূচি দিয়েছিল সেটা অবরোধ নয়। কিছুটা টেকনিক খাটিয়ে অবস্থান বলেছিল, যা কার্যত বড় কোনো কিছু ছিল না। বিএনপির মহাসচিব এটাও বলেছিল, যেহেতু আশুরার দিন। ছুটির দিন। ফলে এমন কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ না হওয়ারই কথা। কিন্তু বিএনপির ভাষা বোঝেনি তারা। কঠোর হয়েছে প্রশাসন। 

কিন্তু এ কর্মসূচির পর জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশন ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে যে বিবৃতি এসেছে সেটা মোটেও বিএনপি বিরোধীদের জন্য সুখকর নয়। পুলিশের কী আচরণ হওয়া উচিত আর কী নয়, সেটা তারা অক্ষরে অক্ষরে বলে দিয়েছেন উপদেশের ছলে। কী করা যাবে, কী করা যাবে না। কীভাবে কী করতে হবে সেটাও তারা ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করে দিয়েছেন। পুলিশ সেটা না মানলে কী হবে, সেটা তারা বলেননি। তবে পরিণতি ভালোর দিকে যায় না এটা সবারই জানা। বিএনপি এরপর আরো কর্মসূচি করেছে সেগুলো জেলা পর্যায়ের। সেখানেও বিপুল উপস্থিতি। 

বিএনপি দেখছে প্রশাসনে ভিসানীতির প্রভাব

গত ২৯ জুলাইর কর্মসূচিতে পুলিশের ভূমিকার কিছু কিছু অংশের ব্যাপারে বিএনপিতেও স্বস্তি। এটাতে সরকার ও প্রশাসন ওই ভিসানীতির যে প্রভাব সেটার কার্যকরিতা দেখতে পেয়েছে তারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেটাই বলেছেন। 

তিনি উদাহরণ দিয়েছেন, এর আগেও গত ডিসেম্বরে যখন ঢাকা বিভাগীয় সম্মেলন। তখন মির্জা ফখরুলসহ বেশকিছু কেন্দ্রীয় নেতাদের তুলে নিয়ে যায় পুলিশ ডিবিতে। সেখান থেকে সরাসরি আটক দেখিয়ে কারাগারে পাঠায়। এটাই দীর্ঘ ১৪ বছরের অধিক সময়ের কালচার। ডিবি বা পুলিশ থানা থেকে কোটের মাধ্যমে কারাগারে বিএনপির নেতাদের পাঠিয়ে আসছেন। কিন্তু এবারই ব্যাতিক্রম। আমানউল্লাহ আমানকে আটক করে পুলিশের ভ্যানে তুলে নিয়ে যেয়ে পুলিশ। গয়েশ্বর চন্দ্র দু’হাত প্রসারিত করে কর্মীদের সামাল দিচ্ছিলেন। পুলিশের সঙ্গে কোনোরকম সংঘর্ষে না জড়াতে। কিন্তু এ সুযোগে পুলিশ তার নিকটে যেয়ে তাকে ঘিরে ফেলে এবং বেড়ধক পেটায়। তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার পরও তাকে পেটানো হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেছেন, কোমর থেকে পা পর্যন্ত তাকে পেটানো হয়েছে। বর্ষীয়ান এ নেতাকে প্রথম একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রেখে পরে হাসপাতাল হয়ে সেখান থেকে নেওয়া হয় ডিবিতে। চার ঘণ্টা ডিবিতে রেখে তাকে আপ্যায়ন করে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

সাধারণ নেতাকর্মীদের পেটানো ও আটক আগের মতোই 

কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন স্পট থেকে অনেক নেতাকর্মীকে বেড়ধক পিটিয়ে আটক করা হয়। মামলা দেওয়া হয়। তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এ কার্যক্রমটা গতানুগতিক। অর্থাৎ আমান ও গয়েশ্বরের ছেড়ে দেওয়া ও আপ্যায়নের ঘটনা ছাড়া বাকি সব আগের মতোই। 

পুলিশের এমন আচরণটা অনেকেই কিছুটা সহনীয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং এমনটা করার কারণ হিসেবে মির্জা ফখরুল বলেছেন মার্কিন ভিসানীতি। এছাড়াও ১৪ কংগ্রেসম্যানের জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূতের নিকট জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান, উপনির্বাচনে হিরো আলম প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উইরোপীয় ইউনিয়নের মোট ১৩ জনের যৌথ বিবৃতি সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে চাপ তার প্রতিফলন ঘটছে বলে মনে করছেন। 

আওয়ামী লীগের শান্তি কর্মসূচির দিকেও 

বিএনপি যেহেতু প্রতিনিয়ত এখন বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শুরু করে কঠোর ও চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে, সেখানে বসে নেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম অঙ্গসংগঠনও। তারাও বিএনপির কর্মসূচি প্রতিরোধে কখনো শান্তি সমাবেশ ও কখনো নিজেদের কর্মসূচি পালনের নামে পাশাপাশি থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও একটা বাড়তি টেনশন, বড় কোনো সংঘর্ষ না হয় সেই দুশ্চিন্তায়।      

বিএনপি তাদের আন্দোলনের ধরন বদলে দিয়েছে। যাচ্ছে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও সরকারের পদত্যাগ দাবি তাদের। সে লক্ষ্যে ক্রমশই সোচ্চার হচ্ছে তারা। একই সঙ্গে বিএনপিকে মোকাবিলা করতেও আওয়ামী লীগ মাঠে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। পুলিশও নিজেদের বদলে ফেলে চেষ্টা করছে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে পরিস্থিতির মোকাবিলা। কারণ ক্ষমতাসীন দলের মুখ্য বিএনপিকে প্রতিরোধ। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও দুশ্চিন্তা, ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের হুকুম পালন সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন রক্তচক্ষু। সব মিলিয়ে তারাও প্রেসারে, যা বিএনপির ওই (২৯ জুলাই) অবস্থান কর্মসূচিতে কিছুটা হলেও আভাস দিলো বৈকি!   

সাধারণ মানুষের ভাবনা 

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন এলেই সাধারণ মানুষের বাড়তি এক টেনশন! রাজনীতিতে জড়ানো নয়, সরকার পরিবর্তনে অনেকেরই কিছু আসে যায় না। বলতে শোনা যায়, অধিকাংশ মানুষকেই আওয়ামী লীগ এলো না বিএনপি, তাতে কিছুই যায় আসে না। আমাকে আমার কাজ করেই তো খেতে হবে, চলতে হবে। ক্ষমতার পরিবর্তনে ভাগ্য পরিবর্তন হয় কিছু মানুষের। তাদেরকে চেনা যায়। কিন্তু আপামর মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। 

এরপরও সেই সব সাধারণের মনে কখনো বিরক্তিভাব, ক্ষমতাসীনে। যাদের সমর্থন করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বা ক্ষমতার দাপটে নাভিশ্বাস বা অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগতে হয়, তখন তারাও শামিল হয়ে যান সরকার পতনের আন্দোলনে। দীর্ঘ তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে কেমন একটা বিরক্তি ভাব। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার এসবকে নিরুৎসাহিত করে কঠোরতা দেখালেও দীর্ঘ একযুগের ওপরে ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন ও প্রশাসনকে যখন অনুকূলে পাওয়া যায়, তখন ওসব শীর্ষনেতাদের কথা কর্তপাত করতে চায় না। যে অভিযোগ তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের মুখে শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায়। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নাকি তারা মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধেও। 

এবার বিএনপি ও সমমনা দলসমূহের সরকার পতনের আন্দোলন বেশি কার্যকরি হওয়ার পেছনে এসব যুক্তি খুব কাজে লাগছে।

শেয়ার করুন