২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন বাংলাদেশ মানব ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা চালায়, তখন ভারত, রাশিয়া এই দুই একটি দেশ ছাড়া কোনো সরকার বাংলাদেশের সংগ্রামী মুক্তিকামী মানুষের পাশে সক্রিয়ভাবে দাঁড়ায়নি। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে সরাসরি সহযোগিতা করে। চীন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানকে সমর্থন করে। ৫২ বছর পরে বাংলাদেশ যখন প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উন্নয়নের পথে দৃঢ় পদে এগিয়ে চলেছে তখন সেই যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের ছবক দিচ্ছে।
নিজেরা বিশ্ব জোড়া মানবাধিকার হরণ করেও বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে মায়াকান্না করছে। কেন রক্তমূল্যে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশ কারো প্রভুত্ব মেনে নেবে? এদেশের ১৭ কোটি মানুষের অধিকার আছে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজেদের সরকার বেছে নেওয়ার। মানছি দেশের ২০১৪, ২০১৮ দুটি নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ নানাভাবে সংকুচিত ছিল। বিরোধী দলগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু সেই অজুহাতে ২০০৯-২০২৩ পর্যন্ত বদলে যাওয়া বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
২০০৯-২০২৩ পর পর তিন টার্মে সফলতা এবং ব্যর্থতা মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কিন্তু বাংলাদেশকে অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত করেছে। করোনা অতিমারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক দেশের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দিলেও বাংলাদেশ অন্তত সেই পরিস্থিতি হয়নি। নানা বাস্তবতার কারণে আগ্রাসী দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে সমঝোতা করার কারণে ফাঁকফোকর গলে কিছু মানুষ বা গোষ্ঠী বিশাল দুর্নীতি করে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। সরকার ক্ষেত্রবিশেষে সুবিধাবাদী আমলা আর দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথা সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। সেই দুর্নীতি লব্ধ অর্থের এক অংশ এখন সরকারবিরোধী কর্মকা-ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ক্ষণে ক্ষণে বিরোধী শক্তি এবং ফ্রন্টগুলো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের কাছে নালিশের জন্য ছুটে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যেই না প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারত তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে স্থিতিশীল বাংলাদেশ বিষয়ে তাদের মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রকে জানালো, অমনি শুরু হলো ভারতবিরোধী কোরাস। বিশ্বায়নের যুগে সংযুক্ত বিশ্বে সব দেশ সব দেশের ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। আর প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণসহ অবস্থান উভয় দেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই ভারত চাইবে বাংলাদেশে যেন ভারতবিরোধী কোনো শক্তি যেন ক্ষমতায় না সে যারা বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেবে।
আমি বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তায় বিশ্বাসী। আমি ভারত বা কোনো দেশ বাংলাদেশের প্রভু হোক সেটি চাই না। আমি দেখেছি ভারতের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ কীভাবে বাংলাদেশে চীন, জাপান, কোরিয়া, পশ্চিমা দেশগুলোকে উন্নয়নে সম্পৃক্ত রেখেছে। আমি বঙ্গবন্ধু কন্যার সাহসী উচ্চারণ সমর্থন করি। কিন্তু একই সঙ্গে কথাবার্তায় আরো একটু কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বনের অনুরোধ করি। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সামর্থের মাধ্যমে সমাধান করে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক সেটি প্রত্যাশা করি।
মনে আছে, পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার শাসনকাল বিষয়ে ’প্রভু নয় বন্ধু’ একটি বই লিখেছিলেন। গণ আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক ক্ষমতা হারালেও বইটি পড়েছিলাম কয়েকবার স্কুল জীবনে। বাংলাদেশের জন্য অন্তত বইটির শিরোনাম এখন ভীষণভাবে প্রযোজ্য। উন্নয়নের যাত্রাপথে বাংলাদেশের প্রয়োজন প্রভু নয়, বন্ধু সহযাত্রী।