২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ৬:৩৭:১৪ অপরাহ্ন


প্রফেসর ইউনূস কি রাজনীতিতে আসছেন
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৯-২০২৩
প্রফেসর ইউনূস কি রাজনীতিতে আসছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস


চিন্তার রাজ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশ্ন রাজনীতিতে আসছেন কী, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস? শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রফেসর ইউনূস যদিও রাজনীতিতে আসেনও, সেটাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত দেশের একাংশ মানুষ। প্রফেসর ইউনূসের রাজনীতিতে আসার গুঞ্জন এমন সময়, যখন দেশে বিরাজমান রাজনীতির এক ক্রান্তিলগ্ন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ টানা তিন টার্ম ক্ষমতার শেষ ক্ষণে। চতুর্থ টার্ম ক্ষমতায় যাওয়ার সব বন্দোবস্ত তারা করবেন, এটা স্বাভাবিক। দেশের যে উন্নয়ন করেছে, সেগুলোতে সাধারণ মানুষ উপকৃত। মানুষ আওয়ামী লীগের ওই সাফল্য ও উন্নয়নের জন্য তাদের ভোট দেবেন, এমন আশা ক্ষমতাসীনের। এ সময় নেতাকর্মীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সুফলভোগীরা যেখানে রয়েছেন, সে পর্যায় থেকে দলটিকে আবার ক্ষমতায় আনতে মরিয়া, সুফল প্রাপ্তি অব্যাহত রাখতে, এটাই রীতি। যে কোনো দেশের রাজনৈতিক দল ও তার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এমন করবেন।

কিন্তু সুফল বিমুখ, বঞ্চিতের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে যে ভুলত্রুটি জমা হয়েছে, সেগুলো পুঁজি করে বিরোধীপক্ষ ব্যাপক সোচ্চার, ক্ষমতায় যেন আর না আসতে পারে। তারাও মানুষের দ্বারে ঘুরছে, বোঝাচ্ছেন। প্রথমত ভয়, ২০১৪ ও ২০১৮ সনে যেভাবে অনেকটাই ভোটবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে বা একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতার মসনদ বসা অব্যাহত রেখেছে, সে প্রক্রিয়ায় যদি আবারও হয়, এ শঙ্কায় এখন বিরোধীপক্ষ। সরকারবিরোধীরা বন্ধুপ্রতিম বা উন্নয়ন সহযোগী বা দাতাদেশসমূহকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। এতেই সোচ্চার এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জোট। তাদের প্রত্যাশা ও ভদ্র কথার আড়ালে নির্দেশনা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের, যা হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

প্রশ্ন আসতে পারে, দুই পক্ষের বিরোধের মধ্যে তাহলে প্রফেসর ইউনূস কেন? তিনি তো রাজনীতিই করেন না। এখানেই মূলত রাজনীতিবিদদের কাছে শঙ্কা। আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপি। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের বিরোধী বেশ দুর্বল বা দুর্বল হয়ে আছে। দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগের মতো ক্ষমতার বাইরে আবার বিএনপির শীর্ষ দুই নেতা তারেক জিয়া ও খালেদা জিয়া দ-িত ও অসুস্থ। তারেক জিয়া সুদূর লন্ডনে। ফলে বিএনপি এসব আইনি মারপ্যাঁচ এড়িয়ে কাদের দিয়ে দেশ পরিচালনা করবে এ প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিও রয়েছে অভিযোগ, অভিমান, রাগ, ক্ষোভ বিভিন্ন ইস্যুতে। যেমন তাদের সমর্থিত ব্যবসায়ী আমলাদের দুর্নীতি। দেশ থেকে বিপুল অর্থপাচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও জ্বালানির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি।

এমন প্রেক্ষাপটে কেউ যদি আসতেন বা তৃতীয়পক্ষ যারা ‘নিরপেক্ষভাবে’ দেশ চালিয়ে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে সুন্দন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল করে দিতেন। এ প্রত্যাশা ওই সব মানুষের। 

আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় গেলে চলমান বিষয় অব্যাহত থাকবে। বিএনপি এলেও তারা হয়তো নতুন করে আওয়ামী লীগের পথ ধরবে। এমন শঙ্কা থেকেই সাধারণ মানুষের বড় একাংশের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে ইউনূস ইস্যু। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাজোটের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের সখ্য অনেক। ভীষণ পছন্দ করেন তারা বাংলাদেশের এ নোবেল বিজয়ীকে। ফলে দেশে যখন সরকারবিরোধী পক্ষের একটা বড় দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট, তাহলে সে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার যে যাই বলুক, তার প্রধান হিসেবে প্রফেসর ইউনূস যথার্থ ব্যক্তি ভাবতে শুরু। সাধারণ মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে, মার্কিন মুল্লুকের যে প্রত্যাশা, সেখানে একটি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠাই পারফেক্ট উদ্যোগ। তাছাড়া দেশে একটি নতুন সরকার বা তাদের (মার্কিন ও পশ্চিমাজোট অনুগত) আনার বাসনা আমেরিকারও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন বক্তব্য কয়েকবারই দিয়েছেন, যা থেকে সাধারণ মানুষ এখন ঠাহর করতে পারছেন, কী হতে পারে বা কোনদিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি।  

মার্কিনিরা চায় বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক (তাদের ভাষায়) সরকার, যারা ইন্দো প্যাসিফিক জোনে বিশ্ব মোড়লদের বড় একটা অংশের স্বার্থ যেখানে জড়িত, তাই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশে তাদের মতের একটা সরকার থাকুক। যে কি না বিশ্ব মোড়লদের বর্তমান শত্রু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না। এমন হাজারো প্রেক্ষাপটের আদলে ঘুরপাক খাচ্ছে যখন বাংলাদেশের রাজনীতি, ঠিক তখনই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে একজন দায়িত্বশীল ভাবছেন তারা। সেটা তাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করে হোক আর ইউনূস নেপথ্যে থেকে অমন একটা সরকার গঠন করে হোক। সেটা যেভাবেই। এটাই এখন মুখ্য আলোচনা বাংলাদেশে।

ইতিমধ্যে একবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেও ফেলেছেন, প্রফেসর ইউনূস যদি তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হন, তাতে বিএনপির আপত্তি নেই। এমনকি তিনি যদি সেটা না-ও হন, তিনি যাকে সিলেক্ট করবেন সেটাতেও বিএনপির আপত্তি নেই। এ কথার পর আওয়ামী লীগের বুঝতে কী আর কিছু বাকি থাকে। বাকিটুকুও তো খোলাসা হয়ে গেল। যে বিএনপি প্রফেসর ইউনূসের পিছু নিয়েছে এবং যে কি না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাজোটের প্রিয়পাত্র বা আস্থাভাজন। বিএনপি আগেও ইউনূসকে মৌন সমর্থন দিয়ে আসছে। এবার সেটা প্রকাশ্যে। তাহলে ইউনূস ইস্যু হয়ে গেল দুইয়ে দুইয়ে চার। দেশের বিরাজমান রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও তাদের সমার্থিত জোট, বিএনপি ও তাদের সমর্থিত জোট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাজোট যেখানে রয়েছে ভারতও। কারণ মার্কিনিরা ভারতকে সঙ্গে না নিয়ে এমন উদ্যোগে নামবে না, এটা পরিষ্কার। ভারতও চীন ইস্যুতে বাধ্য হয়েই মার্কিনিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। চীন বিভিন্নভাবে যখন প্রেশারে রেখেছে মোদি সরকারকে তথা, ভারতকে। 

ফলে প্রশ্নটা সামনে এসে যায়, তাহলে এমনি মুহূর্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে পেছনে ফেলতে পারবে কে? তারেক জিয়া লন্ডনে। তিনি দণ্ডিত এ সরকার কর্তৃক। খালেদা জিয়াও দণ্ডিত (এ সরকার কর্তৃক) এবং ভীষণ অসুস্থ। ফলে ফ্রন্ট লাইনে থেকে আপাতত সব সামাল দেওয়ার মতো আস্থাভাজনের বড্ড অভাব বিএনপিতে এবং ক্ষমতাসীন সরকার থাকা অবধি। এমন সময় তৃতীয় পক্ষের কাউকে সিলেক্ট করা এটা সময়ের সিদ্ধান্ত। প্রফেসর ইউনূস সেখানে সম্ভবত অটো চয়েজ। এখন তিনি ফ্রন্টে আসুক বা পেছনে থাকুক। 

এটাই টের পেয়ে সম্ভবত ক্ষমতাসীন দল প্রফেসর ইউনূসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টারত বলে অভিযোগ। এটা তারা মন থেকে না করলেও রাজনৈতিক কৌশল। কারণ যুদ্ধের ময়দানে ফ্রন্টের যোদ্ধারাই মূল শত্রু নয়। দূরদর্শী সমরবিদরা পেছনের শক্তি ও তাদের সুদূরপ্রসারি প্ল্যান বিশ্লেষণ করেই রণকৌশল সাজান। এটাই বাস্তবতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যা করছে, সেটা হয়তো বেশি নয়। রাজনীতি না করেও একজন অরাজনৈতিক পারসনকে এভাবে সামাল দেওয়া কিছুটা দুর্বলতার লক্ষণ হলেও এ ভিন্ন উপায়ও নেই। টুডে অ্যান্ড টুমরো তো প্রফেসর ইউনূসকে সামাল দিতেই হবে, মোকাবিলা করতেই হবে যদি তিনি রাজনীতির মাঠে চলেই আসেন, তাহলে আগ থেকে সে প্রস্তুতিটা নিয়ে রাখলে এটা দোষের নয়। 

প্রফেসর ইউনূসের রাজনীতির অভিলাষ যে রয়েছে, সেটা এ মুহূর্তে তিনি মুখে না বললেও বিগত একসময়ে তো তিনি বলেছিলেন। আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ফলে একটা সুদূরপ্রসারি চিন্তা থাকলে থাকতেও পারে তার। পরিস্থিতি তেমন ইঙ্গিত করছে। তাছাড়া বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে কেউ একবার বসলে রাজনীতি করার অভিলাষ জেগেও ওঠে। ফলে এমন পর্যায়ে ভবিষ্যতে তিনি যদি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সেটা অসম্ভব কিছু কি?  

এদিকে অনেকটাই হঠাৎই প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো দ্রুত ফ্রন্টে আনা হয়েছে এবং বিশ্ববরেণ্য শতাধিক নোবেল লরিয়েটসহ ১৭০ প্লাস ব্যক্তিত্ব ইউনূসকে হয়রানি না করা ও তার মামলার কার্য স্থগিত চেয়ে বিবৃতি এবং এর বাইরেও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংগঠন, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটনসহ বহু বিশ্বনেতৃত্ব প্রফেসর ইউনূস প্রসঙ্গে বিবৃতি দিচ্ছেন, উদ্বেগ জানাচ্ছেন। কিন্তু অন্তত ইউনূস প্রসঙ্গে সরকার এগুলো থোড়াই কেয়ার। 

আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে এগুলোকে পাত্তা না দিয়ে দেশের চলমান আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার অনুরোধ করে যাচ্ছেন। এখানে তিনি নির্দেশ দেননি। দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে বিচারকার্য চালিয়ে যেতে যাতে এসব বিবৃতি বাধা না হয়, সেদিক খেয়াল রাখতে বলেছেন। যে কথার মর্মার্থ আর খুলে বলার প্রয়োজন পড়ে না। 

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি কঠোর অবস্থানে, নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। দিন যত ঘনিয়ে আসছে, বিএনপি কঠোর হচ্ছে রাজপথে। সরকারের ওপর চাপও বাড়ছে বিদেশিদের একটি অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের, যা বারবার বলছেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ। বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া অমন নির্বাচনের যখন গুরুত্ব নেই। আর বিএনপি যখন তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনেই যাবে না এবং ক্ষমতাসীন দল সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তেমনি মুহূর্তে দেশে একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাজোট যদি কোনো সমঝোতার ফরমুলা (নিরপেক্ষ সরকার, যা প্রকারান্তে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্য যে কোনো নামে) নিয়ে আসে সেটা কী কেউ ফেলতে পারবে? সময়ই সব বলে দেবে বৈকি!

শেয়ার করুন