২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৭:১২:০১ পূর্বাহ্ন


তফসিলের পর যথাসময়ে নির্বাচনও
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-১১-২০২৩
তফসিলের পর যথাসময়ে নির্বাচনও নির্বাচন কমিশন ভবন


বহুদিন থেকেই নির্বাচনের একটা দিনক্ষণ আলোচিত হচ্ছিল। তার আগে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের সম্ভাব্য সময়সূচিও। বহু আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু সে ধারাবাহিকতাই থাকলো বাংলাদেশ। ফলে এবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পালা। সেটাও হয়ে যাবে যথারীতি, তথা জানুয়ারি ৭, ২০২৪। 

এদিকে নির্বাচন তফসিলকে অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করেছে কিছু বিদেশি দল এবং ঘোষিত সময়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত তথা, প্রতিহত করার প্রক্রিয়ায় রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মুখোমুখি অবস্থানের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ, সংঘাত আর কিছু না হোক জনজীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। নির্বাচন কমিশন তাদের ওপর আরোপিত সাংবিধানিক দায়িত্বের আওতায় নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। এখন থেকে সরকার শুধু নিয়ম রক্ষার দায়িত্ব পালন করার কথা। নির্বাহী বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগসমূহকে এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে কাজ করতে হবে। সরকারি মন্ত্রী এবং সাংসদরা কিন্তু সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা না। অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব কিছু নির্মোহভাবে করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। যদিও ক’জন উপদেষ্টা ও টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। সেটাও সরকার তার নিজস্ব নীতি অনুসারেই করছেন। 

দেশি-বিদেশি মিডিয়া, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক মিশন, দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সরকারের এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপ। দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিদের প্রত্যাশা একটি সত্যিকারের অবাধ, সুষ্ঠ, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হবে। নিরপেক্ষ পরিবেশে জনগণ ভোট প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের বৈধ প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় যোগ্য, দক্ষ, দেশপ্রেমিক প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ অর্জন সম্ভব হবে না। ২০১৪ এবং ২০১৮-এর মতো নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। মেধা সম্পন্ন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যাদের অনেকেই এখন প্রথমবারের মতো ভোটার তারা কিন্তু অনেক সচেতন। তারা সাদা-কালোর পার্থক্য সঠিকভাবেই করতে পারে। তাই যে মানুষগুলো তৃণমূলে সত্যিকার অর্থেই জনসম্পৃক্ত জনগণ সুযোগ পেলে তাদের নির্বাচিত করবে। এমতাবস্থায় হঠকারিতা বাদ দিয়ে সব গণতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নির্দষ্ট জনঘনিষ্ঠ কর্মসূচির ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত। 

বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে সব দলকে শর্তহীনভাবে ডায়ালগের অনুরোধ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া বিদেশি অন্যান্য দেশসমূহও রয়েছে। নির্বাচন বাংলাদেশের আর ডায়ালগের প্রস্তাব দেয় বিদেশি দূতাবাস। জানি না, রাজনৈতিক দলগুলোর লজ্জা হয় কি না। এখন তো আর এক দফা দাবি বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। আমি মনে করি, ২০০৮ নির্বাচন বয়কট করে প্রধান বিরোধীদল ভুল করেছিল। তৃণমূলে প্রধান বিরোধীদলের অনেক নেতা-নেত্রী নির্বাচনে আগ্রহী বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর আসছে। এটা ঠিক, যদি সঠিক নেতৃত্ব নির্ধারণ করে নির্বাচনে গেলে বিদ্যমান অবস্থায় প্রধান বিরোধীদল সরকারি দলকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলবে। জনগণ ভোট দেওয়ার পরিবেশ পেলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। বাস্তব অবস্থার কারণেই প্রশাসনের কোনো বিশেষ দলের পক্ষে কাজ করা সহজ হবে না। নির্বাচন ছাড়া কোনো গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ নেই। বিরোধী দলগুলোর উচিত বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়ন, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরা। নির্বাচন বিরোধী সব কর্মকা- পরিহার করে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা। 

সরকারি দলের কার্যক্রম মূল্যায়ন 

কারো ভালো লাগুক, নাইবা লাগুক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার পর পর তিন টার্মে ১৫ বছর সরকার পরিচালনা করে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নিয়ে গেছে। যোগাযোগ খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষি খাত, বস্ত্র খাত বহুমুখী উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক খাত উন্নয়নে কিছু ভুল পরিকল্পনার কারণে গুণমান উন্নয়ন হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে পেশাদারী সংস্থাসমূহ রাজনৈতিক প্রভাবে সিন্ডিকেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্য জনগণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। একই সংকট জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতেও। ভুল পরিকল্পনায় দেশের প্রকৃত চাহিদার প্রকৃত প্রাক্কলন না করে এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে আমদানির দিকে ঝোঁকায় ক্রমাগত জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট কাটাতে পারছে না সরকার। ডলার সংকটে জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্রয়ের মূল্য পরিশোধ সময়মতো করতে পারছে না সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলো। এখানেও আমলা নিয়ন্ত্রণ মূলত দায়ী। ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহেও সিন্ডিকেটের দাপটে ধস নেমেছে। কোটি কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে প্রতিনিয়ত খবর বের হচ্ছে। 

দুর্নীতির বিভিন্ন তথ্য মিডিয়ায় নানা সময়ে প্রকাশিত হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন নানাভাবে বিতর্কিত থাকায় দুর্নীতিবাজরা পার পেয়ে গাছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে দেশ পরিচালনায় নানা সংকট, মোকাবিলা করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা কতটা কঠিন, কতটা দুরূহ তার বাস্তব ধারণা থেকেই বলছি সাফল্য-ব্যর্থতার সমীকরণে সরকারের অর্জন প্রশংসা না করলে নিজেকে বঞ্চিত করা হবে। সাধারণ মানুষ এটা করছেনও। আমি বর্তমান সরকারের সমালোচনাকারীদের বলবো একটু উপলব্ধি করুন ২০০৮ সালের তৎকালীন পরিস্থিতি কোথায় ছিল আজ ২০২৩ সালে কোথায় এখন বাংলাদেশ? আর্থসমাজিক পরিস্থিতি, গ্লোবাল জিও পলিটিক্স, রিজিওনাল জিও পলিটিক্স, স্বাধীনতাবিরোধী, দেশবিরোধী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস, বিশেষ মহলের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি মোকাবিলা করে দেশ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেটি বজায় রাখতে আগামী সরকারকে অবশ্যই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে হবে। সরকারি দলের অসামান্য সাফল্যের পাশাপাশি ভুলভ্রান্তি, ব্যর্থতার তালিকাও কিন্তু কম না। তবে ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে সরকার প্রধান অবশ্যই উন্নয়নের ফাক ফোঁকর দিয়ে একশ্রেণীর দুর্নীতি পরায়ণ সিন্ডিকেটের কার্ক্রমের বাস্তব চিত্র দেখেছেন। এখন সরকার প্রধানের উচিত হবে সাফল্য ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে দেশের মালিক সাধারণ জনসাধারণের বর্তমান সমস্যা সংকটগুলো সমাধানের পরিকল্পনা করা। 

বর্তমান সরকার কেন দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে ব্যর্থ হলো তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা জরুরি। বিশেষত দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকান্ড দারুণভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। আর সেই কারণেই অনেক মন্ত্রণালয়, সরকারি বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারি অবাধে দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। সরকার প্রধান কেন নির্বাচিত পার্লামেন্ট এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও অনির্বাচিত উপদেষ্টাদের দিয়ে বিশাল আকারের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সাজিয়েছেন তার কারণ অনুসদ্ধান জরুরি। অনেক ক্ষেত্রেই নির্ধারিত মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হয়েছে, দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। 

সরকার পেশাদার অবহেলা করে অতিরিক্ত আমলানির্ভর হয়ে পড়ায় অনেক ক্ষেত্রেই লাগসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ব্যাহত হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত হয়েছে, দুর্নীতির প্রসার ঘটেছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে। 

আশা করি সরকার প্রধান বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সকল দুর্নীতিবাজ এবং দুর্নীতির সিন্ডিকেট বিষয়ে অবহিত। সরকারি দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দুর্নীতি নির্মূল বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার এবং পথ নকশা থাকতে হবে। 

বাংলাদেশের জন্য ২০২৪-২০২৮ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধেয়ে আসছে অর্থনৈতিক সংকট। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সৎ, নিবেদিত, দেশপ্রেমিক সরকার রাষ্ট্রপরিচালনায় থাকা অত্যাবশ্যক। আশাকরি সরকারি দল এবং বিরোধী দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করবে।

শেয়ার করুন