২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৮:২৭:০৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


নতুন সরকারের মন্ত্রিপরিষদের হানিমুন করার সুযোগ নেই
গতানুগতিক ধারায় ঘনায়মান সংকট উত্তরণ হবে কী
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০১-২০২৪
গতানুগতিক ধারায় ঘনায়মান সংকট উত্তরণ হবে কী


সুশাসনের অভাব, আগ্রাসী গোষ্ঠীর অবাধ লুটপাট এবং একই সঙ্গে নানা বৈষয়িক সংঘাত যুক্ত হয়ে বাংলাদেশকে গভীর অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অনিয়ন্ত্রিত উচ্চমূল্য এবং সর্বোপরি নজিরবিহীন জ্বালানি সংকটে ফেলেছে। সরকার একতরফা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন জাতীয় নির্বাচনে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে সংকটের গভীরতা এবং ব্যাপ্তি সঠিকভাবে উপলব্ধি করছে কিনা। প্রধানমন্ত্রী কিছুটা আঁচ করতে পারলেও ফুরফুরে মেজাজে থাকা অধিকাংশ মন্ত্রী-সাংসদদের আচার-আচরণে কিন্তু সংকট উত্তরণের প্রতিজ্ঞা প্রতিফলিত হচ্ছে না। 

সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে ম্যাথ পর্যায়ে সারা দেশে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না হলে সংকট দ্রুত ঘনীভূত হয়ে আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। এবার কিন্তু সরকারের মন্ত্রিপরিষদের হানিমুন করার সুযোগ নেই। 

সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ অশুভ সিন্ডিকেট কবলিত নিত্যপণ্যের বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি দেশে অবস্থান করে উপলব্ধি করলাম সরকার কঠোর নীতি অনুসরণ করে বাজার তদারকি করলেই সিন্ডিকেট ভেঙে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। দেশে কিন্তু কোনো পণ্যের সরবরাহ সংকট নেই। কৃষক সমাজ কিন্তু প্রায় প্রতিটি কৃষিপণ্যের বাম্পার ফলন করছে। কিন্তু সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠী, মজুতদার, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সরকার ঘনিষ্ঠ কয়েকটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। পণ্য সরবরাহের সব পর্যায়ে নিবিড় তদারকি নিশ্চিত করা গেলে ২-৩ মাসের মধ্যে নিত্যপ্রয়োনীয় দ্রব্যাদির বাজার মূল্য সর্বসাধারণের আওতায় নিয়ে আসা কঠিন হবে না। সীমিত আয়ের জনগণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সংকটের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে এটি করতেই হবে। সমাজের সব শ্রেণিকে এই বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। 

সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষের কারসাজিতে নিজেদের জ্বালানি সম্পদ উত্তোলন এবং আহরণ উপেক্ষা করে আমদানিকৃত জ্বালানির দিকে ঝুঁকে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই প্রয়োজনের তুলনায় অত্যাধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। জ্বালানি সংকটে সরকার দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সরবরাহ নেটওয়ার্কে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করতে পারছে না। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দণ্ড গুনতে হচ্ছে। গ্যাসসংকটে ভুগছে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পকারখাগুলো তীব্র গ্যাসসংকটে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ডলার-টাকাসংকটে দেউলিয়া হওয়ার পথে বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা, বিপিসি। নিজেদের গ্যাসসম্পদ, কয়লাসম্পদ মাটির নিজে রেখে কয়লা-গ্যাস আমদানির আত্মহত্যামূলক কার্যক্রম সরকারের। শোনা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ, কয়লা, এলএনজি আমদানির পর ভারত থেকে পাইপলাইন দিয়ে আরো এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। অথচ ২০০০ বাংলাদেশের আবিষ্কৃত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে ভারতে গ্যাস রফতানি নিয়ে কত হৈচৈ হয়েছিল। কয়লাসম্পদ মাটির নিচে, সাগরে গ্যাস-তেল অনুসন্ধান আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ফাইলবন্দি। দেখতে হবে কীভাবে নিবিড় সেচ মৌসুম, রোজা, গ্রীষ্মকাল সামাল দেয় সরকার। এই মুহূর্তে যথাযথ কৃচ্ছতা পরিকল্পনা নিশ্চিত করে, নিবিড় মনিটরিং নিশ্চিত করা ছাড়া বিকল্প নেই। জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যবহারে সর্বোচ্চ দক্ষতা, অপচয় রোধ কঠোরভাবে করতে হবে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে অবদান বাড়াতে হবে। শপিং প্যাটার্ন পাল্টাতে হবে। কে করবে এই কাজগুলো? একই সঙ্গে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান এবং জরুরিভিত্তিতে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জ্বালানি মন্ত্রণালয় কিন্তু এখনো চলছে অপেশাদার পলিসি মেকার্সদের নিয়ন্ত্রণে। সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির কোন কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। 

তৃতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জ সর্বস্তরের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ। বাংলাদেশে কস্ট অব বিজনেস এখন শিখরে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই পরিবেশে বিনিয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার ঘনিষ্ঠ মহল লুটপাট করে শূন্য করে ফেলেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে ভিন্নমত আছে। কিছু চুনোপুঁটি ধরা হলেও রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ বাস্তব পর্যায়ে অনুপস্থিত। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনা না হলে উন্নয়নের সুফল জনগণ পাবে না। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গলার কাটা হয়ে বিঁধবে। 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় এক্ষুণি। বিদেশে দেশের সম্পদ পাচারকারীদের চিহ্নিত করে সামাজিকভাবে বয়কট করতে পারে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সরকার কার্যকরিভাবে দুর্নীতি দমন করতে না পারলে কোনো অর্জনই দেশের সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে না। 

সরকারপ্রধান দীর্ঘদিন নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে সক্ষম এটা আর বলার আপেক্ষা রাখে না। আসন্ন চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপ্তি এবং গভীরতা অনুধাবন করেছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য, জ্বালানি, পরিবেশ সর্বত্র সংকট। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক মানুষগুলোকে সঠিক স্থানে পদায়ন করা হয়নি। সর্বত্র চলছে মুখের মালা দেওয়া নেওয়া। বিশেষ পরিস্থিতি কিন্তু গতানুগতিকভাবে মোকাবিলা করা যায় না। শুভ কামনা বাংলাদেশের পুরোনো সরকারের নতুন অভিযাত্রায়।

শেয়ার করুন