২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ১১:৫৪:১৮ অপরাহ্ন


বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৩-২০২৪
বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে


অঙ্গীকার সত্ত্বেও পুরোনো সরকার নতুন টার্মে এসে সিন্ডিকেটের কবল থেকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণমুক্ত। মূল্যস্ফীতি উদ্বেগজনক। খেটে খাওয়া মানুষ, সীমিত আয়ের চাকরিজীবীদের নুন আন্তে পান্তা ফুরোনোর জীবনে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। শুরু হয়েছে সেচ মৌসুম, আসছে রোজা, সঙ্গে সঙ্গে আসছে গ্রীষ্মকাল। বাস্তবতার কারণেই জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে গভীর চিন্তা সর্বত্র। সরকার জ্বালানি-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে সাবসিডি কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের মন্ত্রীর ঘোষণায় নিয়মিত বিরতিতে মূল্যবৃদ্ধি করে ঘাটতি মিটানোর ইঙ্গিত আছে। তবে ঠিক এই মুহূর্তে মূল্যবৃদ্ধি যথাযথ হয়নি। জ্বালানি বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি চক্রাকারে সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবে। সরকারের কিন্তু কোনো কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেকের মতে সরকার ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেটদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। এমনিতেই জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পখাত বিপর্যস্ত। গ্যাসের অভাবে বিপুল বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ডলার সংকটের কারণে কয়লা, গ্যাস আমদানি বাধাগ্রস্ত। বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা, বিপিসির মতো সরকারি সংস্থাগুলো দেউলিয়া প্রায়। সরকার সময়মতো সাবসিডির অর্থ ছাড় করছে না। তাই মূল্য বাড়িয়েও মানসম্মত বিদ্যুৎ-জ্বালানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ২০২৪ গ্রীষ্ম মৌসুমে বড় ধরনের লোডশেডিংয়ের আশক্সকা আছে। জ্বালানি-বিদ্যুতের বেহাল অবস্থায় শিল্পমালিকরা স্বাভাবিক শিল্প উৎপাদন বজায় রাখতে পারছে না। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে অশুভ প্রভাব পড়েছে। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠগুলোতে তারল্য সংকট, পুঁজিবাজার লুটপাট হয়েছে। সরকারেরও এখন কূল রাখি না, শ্যাম রাখি অবস্থা। 

জ্বালানি-বিদ্যুৎ মূল্যবৃদ্ধি বা সমন্বয়ের একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। সরকার নিজেই জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে ব্যবসা করে। আছে বেসরকারি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে হেয়ারিং করে সুষ্ঠু পন্থায় মূল্যবৃদ্ধি করা হলে তবুও কিছু সম্পৃক্ততা এবং জবাবদিহিতা থাকে। একটি নির্দিষ্ট ফরমুলার ভিত্তিতে মূল্য সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা হলে কারো কিছু বলার থাকে না। সরকারি সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা থাকে। কিন্তু সরকার এককভাবে ঘোষণা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি অবশ্য স্বার্থের সংঘাত বলে বিবেচিত হয়। 

কেন কোন পরিস্থিতিতে নিয়মিত মূল্যবৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে সবাই জানে। সরকারি পরিকল্পনায় দূরদৃষ্টির অভাব, বাস্তবায়ন দুর্বলতা, দুর্নীতি, অপশাসন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা বৈষয়িক কারণে অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি। 

মাটির নিচে স্বল্প গভীরতায় উঁচু মানের কয়লাসম্পদ। নানা তালবাহানায় মাটির নিচে রয়ে গেছে। অথচ প্রতিবেশী দেশের প্রভাবশালী কোম্পানি কয়লা আমদানি করে সেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিদ্যুৎ রফতানি করছে বাংলাদেশে। জলে-স্থলে বিপুল তেল-গ্যাস আবিষ্কারের সম্ভাবনা থাকলেও ২০০০-২০২৩ বাংলাদেশ নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে আহরণ এবং উত্তোলন করতে। এখন প্রতিবেশী দেশে এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশে পাইপলাইনে রফতানির আয়োজন জোরেশোরে এগিয়ে চলছে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও একমাত্র তেল শোধনাগারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়নি। দ্বিতীয় শোধনাগার স্থাপন দূরের কথা। কিন্তু ভারতের তেল শোধনাগার থেকে পাইপলাইন দিয়ে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য আমদানি চলছে। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ নিজেদের জ্বালানিসম্পদ আহরণ না করে আমদানির পথে ছুটে বর্তমান সংকট সৃষ্টি করছে। আর নিজেদের ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দিচ্ছে ভোক্তাদের ওপর। 

আসন্ন গ্রীষ্মে ভয়াবহ জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকটের আশঙ্কা। এতোদিন ঘুমিয়ে থেকে হঠাৎ করে জেগে উঠেছে পেট্রোবাংলা। জোরে শোরে শুরু করেছে তেল গ্যাস অনুসন্ধান। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারে কয়লা তোলার ইঙ্গিত থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। এখন উপায় সর্বস্তরে কৃচ্ছ্রসাধন, অপচয় রোধ, চুরি নির্মূল করা, জ্বালানি-বিদ্যুৎ ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি। এছাড়া যথাযথ প্রণোদনা দিয়ে যতটা সম্ভব সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুতের অবদান বাড়ানো। জ্বালানি সরবরাহের, জ্বালানি ব্যবহারের ব্যবস্থা উন্নত না করে এই মুহূর্তে পর্যায়ক্রমিক মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা জনগণের প্রতি হঠকারিতা হয়েছে। 

এবারের গ্রীষ্মকালের জ্বালানি বিদ্যুৎ চ্যালেঞ্জ 

স্মরণে আছে ২০২৩ গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে তীব্র বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকট হয়েছিল। গ্রীষ্মকালটিও ছিল অসহনীয়। ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১৫৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও ঘাটতি ছিল। কিছু এলাকায় লোডশেডিং করতে হয়েছিল। সবাই বলছে এবারের গ্রীষ্মকাল আরো তীব্র দাবদাহের সৃষ্টি করতে পারে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বলছে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ১৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছেন গ্রিড, অফ গ্রিড মাইল এখন উৎপাদন ক্ষমতা ২৯ হাজার মেগাওয়াটের অধিক। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি পিজিসিবি বলছে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের অবকাঠামো তাদের আছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে চাহিদামাফিক সরবরাহ পেলে গ্রাহক চাহিদা মেটাতে তাদের সমস্যা নেই। মূল সংকট হলো চাহিদামাফিক প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ। গ্যাস ব্যবহারকারী বিদ্যুৎ প্ল্যান্টসমূহের ক্ষমতা এখন ১১ হাজার মেগাওয়াটের অধিক। প্রয়োজন প্রতিদিন ১৮০০-২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। কিন্তু পেট্রোবাংলার পক্ষে সবার চাহিদা মিটিয়ে ১২০০-১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেই ক্ষেত্রে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাস ব্যবহারকারী বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এবার অলস বসে থাকবে। দেশে এখন ৫ হাজার মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা আছে। পুরোটা কাজে লাগাতে হলে চাহিদামাফিক কয়লা আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার লাগবে। পেট্রোবাংলার জন্য এলএনজি আমদানি এবং আইওসির গ্যাস কেনার জন্য ডলার প্রয়োজন হবে। এর বাইরে ভারত থেকে আদানি বিদ্যুৎ মিলিয়ে ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার স্বভাবনা আছে। কেউ চাক বা না চাক তরল জ্বালানি থেকে ৪০০০-৪৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করা হলে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট হবে। প্রয়োজন জ্বালানি তেল কেনার প্রয়োজনীয় টাকা, ব্যাংকগুলো কর্তৃক এলসি খোলার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। 

আমার পর্যালোচনায় আসন্ন গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে নিম্নরূপ 

গ্যাস বিদ্যুৎ : ৬৫০০-৭০০০ মেগাওয়াট (১৩০০ এমএমসিএফডি থেকে জ্বালানি দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহারে সম্ভব) 

কয়লা বিদ্যুৎ : ৫০০০ মেগাওয়াট 

আমদানি বিদ্যুৎ : ২৫০০ মেগাওয়াট (আদানি বিদ্যুৎসহ) 

তরল জ্বালানি : ৪০০০-৪৫০০ মেগাওয়াট পিক সময়ে) 

হিসাবটা লেখা যতো সহজ, বাস্তবায়ন ততোই জটিল। এই ধরনের পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে কন্টিনজেন্সি প্ল্যান থাকতে হবে। যান্ত্রিক সমস্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকবে। জ্বালানি সংকট হবে। তাই গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন, অপব্যবহার রোধ এবং দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। 

জানা গেছে, চট্টগ্রামের মদুনাঘাটের একটি সাবস্টেশনের কিছু কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাতারবাড়ি এবং বাঁশখালীর দুটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্পূর্ণ উৎপাদন জাতীয় গ্রিডে আনা যাবে না। সদ্য সূচিত হয় আলোচনা মতো মেঘনা ঘাটে নির্মিত তিনটি জ্বালানি দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্রেও এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস দেওয়া হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হবে। অধিকাংশ গ্যাস বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো ২৩০ কেভি সিস্টেমে সংযুক্ত। মেঘনাঘাটের নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ৪০০ কেভি সিস্টেমে যোগ করা। সমন্বয়ে সময় লাগবে। সবকিছু মিলিয়ে বলতে হবে জ্বালানি সরবরাহ মূল সমস্যা। ডলার, টাকা প্রাপ্তি অনিশ্চিত। এবারের গ্রীষ্মকালে জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিশ্চয়তার দোদুল্য দোলায় দুলছে।

শেয়ার করুন