২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ৬:৩৪:০৯ অপরাহ্ন


জাতীয় পার্টি, জামায়াত কোন পথে?
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৮-২০২৩
জাতীয় পার্টি, জামায়াত কোন পথে?


দ্বাদশ নির্বাচনের তফসিল, সময়ক্ষণ নির্ধারণের প্রস্তুতি চলছে। বিরোধীদলসমূহ রাজপথ কাঁপাচ্ছেন দাবি আদায়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জোট পূর্বধারা বা সংবিধান মেনে নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দেশের বৃহত্তম বিরোধীদল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলসমূহ ক্রমাগত রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছেন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে। অহিংস থেকেই তাদের ওই আন্দোলন ক্রমশ জনদাবি হয়ে উঠছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের ঘুম হারাম। তারাও সরকারের প্রচারণা চালিয়ে বিরোধীদের দাবি যে অহেতুক ও নিষ্ফলা সেটা প্রমাণে মরিয়া। রাজপথে আওয়ামী লীগ ও তাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দলের নেতাকর্মীরাও বিরোধীদলের আন্দোলন ঠেকাতে গিয়ে মার খাচ্ছেন। রক্ত দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলও। বিরোধীদলের তো এ আন্দোলনে বেশ কয়েকজনকে জীবন দিতে হয়েছে। প্রতিনিয়ত মামলা খাচ্ছেন। যার সংখ্যা বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যে ৪০ লাখের মতো। জেলহাজতে যাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় নেতাদেরও বেধড়ক পেটানো হচ্ছে, মামলা খেয়ে জেলে যাচ্ছেন। 

এভাবেই চলছে বিএনপি সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি। প্রায় প্রতিদিনই দিচ্ছেন তারা কর্মসূচি। মানুষের ঢল নামছে সেসব প্রোগ্রামে। সরকারি দল বলেই চুপ করে বসে নেই। তারাও মাঠে ময়দানেই। বিএনপির অবস্থান ধর্মঘট ঠেকাতে মাঠে থাকায় এক ছাত্রলীগ শীর্ষনেতা তার বোনের বিয়েতে পর্যন্ত উপস্থিত থাকতে পারেননি। এজন্য তারও ভীষণ কষ্ট। তবু ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দল তো বড়। তিনি দায়িত্বশীল। কিন্তু দেশের এমন মুহূর্তে জাতীয় পার্টি ও জাময়াতে ইসলামী কোথায়? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র। 

কেন আন্দোলনে নেই দল দুটি। স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিকভাবে দুই ধারায় চলে আসছে দেশ। একটি বিএনপি নেতৃত্বে, অন্যটিতে আওয়ামী লীগ। বাকি সব রাজনৈতিক দলসমূহ কোনো না কোনোভাবে এ দুইয়ের একটিতে মিশে একাকার। কিন্তু দেশের ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার আন্দোলন, পাল্টা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনো এ দুইয়ের নীরবতা ওই প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। 

ভেতরে ভেতরে এসব দল কী করলো, কোথায় কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সাপোর্ট দিচ্ছে বা দেনদরবার করছে সেটা ভিন্ন বিষয় হতেও পারে, কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ওই দুই দলকে অজ্ঞাত কারণে নীরবতা অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে। 

প্রসঙ্গ জামায়াত 

জামায়াতকে নিয়ে অনেক রহস্যময় খবর বের হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একটা দল মাঠে নেমে যদি তাদের কর্মসূচি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিকমতো জানান না দেয়, তখন তাদের নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াবে এটাই স্বাভাবিক। এটা ঠিক, দীর্ঘদিন থেকেই মাঠে নামতে দিতো না প্রশাসন। কিন্তু হঠাৎ ইঞ্জিনিয়ার্স ইউনিস্টিটিউটে দলটির এক কার্যক্রম নিয়ে তোলপাড় হয়। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী অনেকেই সন্দেহের তীর ছুড়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের দিকে। অনেকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৈরি হওয়া ভিন্ন এক পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এ পরিস্থিতির কারণেও হয়তো সরকার দলটিকে প্রকাশ্যে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তবে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার পাশাপাশি দলটির সঙ্গে সরকারের কোনো বোঝাপড়া হয়েছে কি না এ প্রশ্নও সামনে এসেছে। 

বিরোধীদল বিএনপিও সন্দেহ করছে, সরকারের সঙ্গে একধরনের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে হয়তো জামায়াত নতুন করে মাঠে নেমেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে সরকারের মন্ত্রীরা যেভাবে যুক্তি দিচ্ছেন, তাতে সন্দেহ আরো বাড়ছে আর বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও ঘটনাটি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। 

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে জামায়াতের সমাবেশের পর দিন সরকারের অন্তত চারজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এ বিষয়ে কথা বলেছেন। যদিও সাংবাদিকদের প্রশ্নে তারা বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তাদের সবার বক্তব্য প্রায় একই রকম। মন্ত্রীরা জামায়াতের সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে নানা যুক্তি দিয়েছেন। 

আইনমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচারের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী যেহেতু নিষিদ্ধ দল নয়, তাই তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের একজন আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অবশ্য সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

কিন্তু এসব কথাকে আমলে নেয়নি বিএনপি। কারণ বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সখ্য ভালো নয়। বিএনপির সঙ্গে কিছুটা রহস্যজনক আচরণ করায় বিএনপি মহাসচিব সরাসরি জামায়াত নিয়ে কথা বলেছেন এবং জামায়াত যে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনেও নেই এবং তারা হয়তো ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দেনদরবারে মগ্ন প্রকারান্তে সেটাও তিনি উল্লেখ করেছেন। 

এছাড়াও জামায়াতের নেতাদের কিছু গোপন মিশন নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচারিত হয়। সব মিলিয়ে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ বিরোধী জোটে জামায়াত থাকলেও এবার এ আন্দোলনে জামায়াত যে বিএনপির সঙ্গে নেই সেটা স্পষ্ট। থাকলে বিএনপির এতোগুলো কর্মসূচিতে জামায়াতেরও কর্মসূচি থাকতো। বামপন্থীসহ অনেক দলের সঙ্গে বিএনপির সখ্য থাকলেও জামায়াতের সঙ্গে সেটা আর নেই। 

বিএনপি আরো একটি বিষয়ের প্রমাণ দিয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে একটা ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে, আন্দোলনের মাঠে জামায়াত ছাড়া অচল বিএনপি। কিন্তু এবারের আন্দোলনে সেই বিভাগীয় সম্মেলন থেকে শুরু করে প্রতিটা মহাসমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচিতে জামায়াত নেই। বিএনপি এতো লোক কোথায় পেলো? 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিরোধী সব দল এক হয়েও এতো লোক কখনো একসঙ্গে দেখা যায়নি, যা বিএনপির ডাকে নেতাকর্মীরা যেভাবে বের হয়ে রাজপথে এসেছেন। ফলে বিএনপি এখন জামায়াতের ব্যাপারে উদাসীন। নিজ থেকে আন্দোলনে যোগ দিলে ভালো, নতুবা প্রয়োজন নেই। বিএনপি এখন এমন মুডে। 

তবে জামায়াতকে বিএনপি ছাড়া যদি করেই ফেলতে পারে, সেটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্রেডিট। বাধ্য হয়ে জামায়াত হয়তো আওয়ামী লীগকেই সমর্থন দেবে তাদের একতরফা নির্বাচনে। বিএনপি এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তবে আপাতত জামায়াত একা একা বিভিন্ন স্থানে মিছিল করে চলছে। এর মাধ্যমে তাদের যে লোকজন রয়েছে, সেটার একটা প্রদর্শনী মাত্র। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছুই বলছে না। যদিও পুলিশ একেবারে ছেড়ে কথা বলছে না। বিভিন্ন স্থানে সমাবেশের অনুমতি চাইলে পুলিশ সেটা নাকচ করে দিচ্ছে। সর্বশেষ গত পহেলা আগস্ট বায়তুল মোকাররম মসজিদ গেটে সমাবেশের অনুমতি চাইলেও পুলিশ সেটা নাকচ করে দেয়। যদিও দলটি আলাদা হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন চায়। কিন্তু একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের সঙ্গে তাদের ওঠাবসাও অনেকের মধ্যে সন্দেহ কাজ করছে। 

জাতীয় পার্টি 

রাজধানী ঢাকার পুরান টাউনের বাসিন্দাদের মধ্যে একটা কথার প্রচলন রয়েছে। ‘মাইনকার চিপা’। আপাতত মনে হচ্ছে, ওই মাইনকার চিপায় জাতীয় পার্টি। এরশাদের অনুপস্থিতিতে স্পষ্ট দুইভাগে বিভক্ত দলটি। একপক্ষ রওশন এরশাদ প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাত্ম। তিনি বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নেবেন। তত্ত্বাবধায়কে বিশ্বাসী নন তিনি। 

অন্যদিকে জি এম কাদের কথায় এর ভিন্নতা। তিনি সরকারের প্রচণ্ড সমালোচনা করছেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলেও তিনি বলে আসছেন। তবে জাতীয় পার্টিতে বিভক্তির জন্য প্রভাবশালী একটি দলকে দোষারোপ করছে জাতীয় পার্টির অনেকেই। জি এম কাদের তো প্রকাশ্যেই বলেছেন। তিনি দোষ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগকে। রওশন এরশাদ ইতিমধ্যে দলের নেতাকর্মীকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভাষাতেই তারও ওই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। 

সম্প্রতি এর বনানী কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে জি এম কাদের বলেন, দেশে একদলীয় শাসন চালুর পাঁয়তারা চলছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেছেন, ইলেকশনের পরিবর্তে সব সিলেকশনে হবে। কখনো নির্বাচন হলে সুপ্রিম লিডারের নির্দেশেই হবে। দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালুর পাঁয়তারা চলছে। দেশে একজন নেতা আজীবনের জন্য নেতা থাকবেন। জনগণের কোনো অধিকার থাকবে না। দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। 

তবে এটাও ঠিক, তিনি এখনো সংসদে রয়েছেন এবং সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ না দিয়ে মুখেই সমালোচনা করে যাচ্ছেন। তিনি অবশ্য বলেছেন, নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেবেন দল কোন পথে চলবে। ফলে দেশে চলমান আন্দোলন সংগ্রামের ধারকাছ দিয়েও নেই দলটি। এটাতে নেতাকর্মীরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে বারবার। কারণ আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে বা বিএনপির সঙ্গে একদিকে তো মুভ করবে। তাছাড়া নিজেদেরও কোনো আলাদা কর্মসূচি নেই শুধু মৌখিক আলাপ-আলোচনা ছাড়া। 

তবে তারাও চায় গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন, যা হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। কিন্তু সেটা কীভাবে সেটা স্পষ্ট করে না। কারণ গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সরকারের পার্ট যে তারাও ছিল। তাহলে এখন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকতে চাচ্ছে না কেন? হয়তো এটাও একটা কৌশল তাদের। কারণ জাতীয় পার্টি তো বরাবর ক্ষমতার সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করে, থাকছেও। 

ঠিক একইভাবে অনেকটাই নিশ্চুপ হেফাজতে ইসলাম। যদিও তারা অরাজনৈতিক। তবু নীরবেই কাটছে তাদের সময়। এদিক থেকে ইসলামী আন্দোলনের নেতারা সোচ্চার। ক্ষমতাসীন দলের কঠোর সমালোচনা করছেন তারা। যদিও কোনো জোটে নেই তারা। 

সম্প্রতি বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা ও গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছে চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। 

দলটির মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেছেন, সরকার দেশকে পরিকল্পিতভাবে সংঘাতের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ওপর আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলা প্রমাণ করে সরকার ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বেসামাল হয়ে পড়ছে। অন্যদের তুলনায় নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট রেখে চলেছেন তারা।

শেয়ার করুন