২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ১১:৪১:০৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


দেশকে অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম
সংবিধানে যতটা অপূর্ণতা আছে তার অনেক বেশি স্ববিরোধিতা
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৩-২০২৩
সংবিধানে যতটা অপূর্ণতা আছে তার অনেক বেশি স্ববিরোধিতা অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম


সাতদলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের নতুন সমন্বয়ক রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেছেন, এ সংবিধানের যতটা অপূর্ণতা আছে তার চেয়ে অনেকবেশি আছে এর স্ববিরোধীতা। সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অধ্যায়ে যেসব মূলনীতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রয়েছে, সেই একই সংবিধানে সরকারের ক্ষমতা কাঠামোকে এমনভাবে বিন্যস্থ করা হয়েছে, যা এইসব মূলনীতির পরিপন্থী।

এই সময়ে দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে সংবিধান বা রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামতে বিভিন্ন বিষয় জানতে নিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গ জানতে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুমের মুখোমুখি হয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ। 

দেশ : কেন সংবিধান সংশোধনের কথা বলছেন? 

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম : প্রকৃতপক্ষে আমরা সংবিধান সংশোধনের কথা বলছি না। আমরা বলছি সংবিধান সংস্কারের কথা। সংবিধান সংশোধন একটা আইনী প্রক্রিয়া। জাতীয় সংসদ যেমন আইন প্রণয়ন করতে পারে, তেমন তারা সংবিধান সংশোধনও করতে পারে। সংসদ সদস্যরা যদি উপলব্দি করে যে সংবিধানে ছোট খাটো কোন অসঙ্গতি কিংবা অস্পষ্টতা রয়েছে, তাহলে তারা সংবিধান সংশোধন করতে পারে। তবে এইসব সংশোধনী সংবিধানের মূলের অনুগামী, নাকি মূল চেতনার পরিপন্থী, তা পরখ করার অধিকার দেয়া আছে উচ্চ আদালতকে। উচ্চ আদালত যদি মনে করে যে, কোন সংশোধনী সংবিধানের মূলচেতনার পরিপন্থী, তাহলে তারা তা বাতিল করে দিতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, সংবিধানের ১৩শ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ প্রতিষ্ঠা এবং দীর্ঘদিন পরে তা উচ্চ আদালতের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণার বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে।   কিন্তু সংস্কার তা নয়, সংস্কার একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। জনগণ যদি সংবিধান সংস্কার করার জন্য ‘সংবিধান সংস্কার সভা’র নির্বাচনের ব্যবস্থা করে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি সংবিধানের সংস্কার করে তাহলে আদালত তা বাতিল করতে পারে না বরং আদালতের দায়িত্ব হয় সংস্কার করা সংবিধানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা এবং তাকেও পাহাড়া দেওয়া। 

আমরা মনে করি সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো অংশের অনেকগুলো বিষয় পরিবর্তন করতে হবে এবং এই ধরনের পরিবর্তন করার অধিকার সংসদের থাকে না। কারণ সংসদ গঠিত হয় সংবিধান মেনে, সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্য। যারা সংবিধানসৃষ্ট তারা সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। 

দেশ : এ সংবিধানের অপূর্ণতা কি?

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম : এ সংবিধানের যতটা অপূর্ণতা আছে তার চেয়ে অনেকবেশি আছে এর স্ববিরোধীতা। সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অধ্যায়ে যেসব মূলনীতি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রয়েছে, সেই একই সংবিধানে সরকারের ক্ষমতা কাঠামোকে এমনভাবে বিন্যস্থ করা হয়েছে, যা এইসব মূলনীতির পরিপন্থী। অপূর্ণতা যদি বলেন, তাহলে বলতে হবে এ সংবিধানে জনপ্রতিনিধি বলে কিছু নেই। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে জনপ্রতিনিধিরা দলীয় প্রতিনিধিতে এবং আরো স্পষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ প্রতিনিধিতে পরিণত হয়। সংবিধানে শান্তিপূর্ণ পথে বা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সরকার এবং সরকার প্রধানের জবাদিহিতার কোন ব্যবস্থা নেই। রাষ্ট্র, সরকার এবং সরকারি দলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। স্থানীয় সরকার বলে কোন প্রতিষ্ঠান নেই। রাষ্ট্রের আয়-ব্যায় তথা জনগণের সম্পদের হিসাব রাখার মতো স্বাধীন অডিট বিভাগ নেই। সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে তোয়াক্কা না করে বিচার করার মত বিচার বিভাগ গড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পুলিশ এবং প্রশাসনকে সরকারের দলীয় প্রতিষ্ঠানের বদলে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেয়নি। অর্থনৈতিক আইন-কানুন- প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকার এবং সরকার সংশ্লিষ্টদের লুটপাট-অপচয় এবং পাচারের সহায়তা ছাড়া স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে দেয়নি। জনগণের মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার ভোগের কোন নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি, এমন অজ¯্র অপূর্ণতার উদাহরণ দেওয়া যায়। 

দেশ : যে সব দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন বিশেষত বিএনপিকে কি আপনাদের মতামত গ্রহণ করাতে পেরেছেন?

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম : দেখুন আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের সংস্কার কিংবা রাষ্ট্রের মেরামতের বিষয়ে কথা বলার অর্থ আমাদের বিশ্লেষণ গ্রহণ করা কিংবা আমাদের সাথে একমত হওয়া নয় বরং জনগণের মুক্তির জন্য যে রাজনৈতিক কর্তব্য সমাজে হাজির হয়েছে তাকে স্বীকার করে জনগণের পক্ষে কাজ করা। এ কর্তব্য আমরা যেমন অনুভব করি অন্যরাও করতে পারে এবং স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেই করতে পারে। তবে আমরা যেহেতু আগে থেকে এই রাজনীতিকে অগ্রসর করার চেষ্টা করে আসছি সেজন্য অন্য কেউ একই ধরনের রাজনীতির কথা বললে আমরা তাদের সাথে স্বাভাবিক কারণেই নৈকট্য বোধ করি। এই নৈকট্য বোধের পথ ধরেই আমরা ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র শরীক হয়েছি। এবং বিএনপি যখন রাষ্ট্রের মেরামতের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছে তখন নানাবিধ রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও আমরা তাদের সাথে ‘সরকার এবং শাসন ব্যবস্থা’ বদলের জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে যুগপৎ ধারায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছি। প্রশ্নের মধ্যে যে ইঙ্গিত আপনি করেছেন, সে সম্পর্কে যতদূর বুঝেছি, তা থেকে বলতে পারি, আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যে ৭ দফা নিয়ে কাজ করছি তার সবগুলি প্রস্তাবে, অন্যান্য সংগঠন আমাদের সাথে পুরোপুরি এখনি একমত হবে তা আমরা মনে করি না। আমরা মনে করি রাষ্ট্রের সংস্কারের জন্য যে দল বা সংগঠন যতদূর মাত্রায় এগিয়ে আসবে আমরা তাদের সাথে ততটুকু কাজই ঐক্যবদ্ধভাবে করার চেষ্টা করবো, বাকিটুকু আমরা দলীয়ভাবে আমাদের মতো এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো। সে নীতির ভিত্তিতেই আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে এবং বিএনপির সাথে ঐক্যবদ্ধ না হয়েও ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির ভিত্তিতে যুগপৎভাবে আন্দোলন করার জন্য কাজ করছি। 

দেশ : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের সাথে বিএনপির অতীত সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের বর্তমান অবস্থান কি?  তারা কি তা স্পষ্ট করেছে?

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম : বাংলাদেশে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ-বিপক্ষ হিসাবে যেভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয় সেটাকে আমাদের বিভ্রান্তিমূলক মনে হয়। আপনি জানেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিলো ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার’ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসাবে ‘গণতন্ত্র’কে গ্রহণ করা হয়েছিলো। কিন্তু এখনকার বাস্তবতায় মুক্তিদ্ধের চেতনা এবং মূলনীতির পরিপন্থী দল হিসাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে সক্রিয় হলো এক সময় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বর্তমান সরকারী দল অওয়ামী লীগ।

আমার মনে হয়, আপনারা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির অতীতের সম্পর্র্ক প্রসঙ্গে বর্তমানে কি অবস্থান নিয়েছে, সে সম্পর্কে জানতে চাইছেন। জামায়াতের সাথে মেলামেশার ইতিহাসও এখানে খুব গোলমেলে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই জামায়াতকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করেছে। তবে ছাত্র তরুণদের আন্দোলনের চাপে এবং নির্বাচনে জামায়াত বিরোধী কার্ডকে ব্যবহারের লোভে বেশ আগেই আওয়ামী লীগ জামায়াতকে প্রকাশ্যে ছেড়ে এসেছে এবং দেখা যাচ্ছে বর্তমানে বিএনপিও তাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। বাকিটা বোঝার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।

দেশ: কেমন সংবিধান চান? ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে যাবেন কি না?

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম : আমরা একটা গণতান্ত্রিক (ক্ষমতা) সংবিধান চাই। আমরা সংবিধান, রাষ্ট্র পরিচালনার আইন-কানুন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে এমনভাবে বিন্যস্থ করতে চাই যাতে এদেশে সাম্য-মানবিক মর্যাদা এবং সমাজিক ন্যায় বিচারের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধান সরকারকে যেসব ক্ষমতা দিয়েছে, আমরা সেই ক্ষমতার পুণর্বিন্যাস করতে চাই। আমরা সরকারের এবং প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহিতা চাই। সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের স্থায়ী ব্যবস্থা চাই। সংসদ, বিচার বিভাগ, পুলিশ-প্রশাসনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকারের কাছ থেকে স্বাধীন করে জনগণের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে চাই। তার জন্য এইসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বদলীয় কমিশন গঠন করার বিধান যোগ করতে চাই। আমরা রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখা এবং অর্থনৈতিক আইন-কানুনে সরকার সংশ্লিষ্টরা যাতে ইচ্ছেমত হস্তক্ষেপ না করতে পারে তার জন্য সর্বদলীয় কমিটি গঠন, স্বায়ত্ব শাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে যাতে কোন বাধা না থাকে সংবিধানকে তেমনভাবে সংস্কার করতে চাই। আমরা সংবিধানের মূলনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে চাই না, তাই কোন কিছু থেকে সরে যাওয়ার প্রশ্ন উঠে না ।

দেশ : এই সংবিধানে কি দেশের সংখ্যালঘুরা নিরাপদ থাকবে?

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম : গণতন্ত্রের একটি মূলনীতি যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন তেমনি আরেকটি মূলনীতি হলো সংখ্যালঘুদের অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা বিধান। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠরা শাসন করার অধিকার পায় কিন্তু এই শাসনের মূল লক্ষ্য হতে হয়, কারো অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্র থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়, তার নিশ্চয়তা বিধান করা। সে জন্যেই সংবিধানে মৌলিক অধিকারকে নিরংকুশ অর্থাৎ শর্তহীন করতে হয়। আমরা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করতে চাই এবং স্বীকৃত সকল মৌলিক অধিকারকে বিদ্যমান নানা শর্তের জাল থেকে মুক্ত করতে চাই, যাতে সংখ্যাগুরুর এবং সংখ্যলঘুর রাজনৈতিক অধিকারে কোন পার্থক্য তৈরি না হয়।

দেশ: আপনাকে ধন্যবাদ 

অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম : আপনাকে এবং দেশ পত্রিকার পাঠকদেরকেও আমার ধন্যবাদ।

শেয়ার করুন