০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ৬:৩৫:১৩ অপরাহ্ন


দেশকে মাহমুদুল হাসান মানিক
তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারই দায়ি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৬-২০২২
তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারই দায়ি


বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুল হাসান মানিক বলেছেন, তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে ভারতের কেন্ত্রীয় সরকারই দায়ি। শুধু একা পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপধ্যায়ের দায়ি করলে চলবে না। অতিসম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রি একে আব্দুল মোমেন ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি না হওয়াটাকে লজ্জাজনক বলে অভিহিত করার পর আবারও আলোচনায় ওঠে ইস্যুটি। 

বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে দেশ পত্রিকাকে এসব কথা বলেছেন মাহমুদুল হাসান মানিক।  

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ৫০ বছরপূর্তিতে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের কমসূচিতে পরিবেশ দিবস উপলক্ষে “গঙ্গা, তিস্তা, যমুনা, মেঘনা নদীর ব্যবস্থাপনা ও পানির উপর কৃষক ও আদিবাসীর অধিকার” শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজনও করেছিল। দেশের বেশ কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল এই ইস্যুতে লংমার্চসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। অন্যদিকে  ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদী বাংলাদেশের আর্থ সামাঝিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীর পানির ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু তিস্তার নদীর পানি বণ্টন চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি । আর অতি সম্প্রতি তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। দীর্ঘ ১১ বছর ধরে তিস্তা চুক্তি আটকে থাকাকে লজ্জাজনক বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। ২০০৭ ও ২০১১ সালে দু-দুবার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মমতার আপত্তির মুখে শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি আর স্বাক্ষরিত হয়নি বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। এসব বিষয়গুলি মিলিয়ে মাহমুদুল হাসান মানিকের সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়। এটি নিচে তুলে ধরা হলো। 

দেশ: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আর্ন্তজাতিক নদীগুলির ন্যায্য হিস্যার কী হবে বলে আপনি মনে করেন। 

মাহমুদুল হাসান মানিক: সম্প্রতি আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করলেও এই পঞ্চাশ বছরেও আন্তর্জাতিক নদীসমূহের ওপর আমাদের অধিকার, ন্যায়সঙ্গত পানির হিস্যা, আন্তর্জাতিক নদীসহ নদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একমাত্র গঙ্গার পানির চুক্তি ছাড়া ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনায় কোনই অগ্রগতি সাধন করতে পারি নি। বরঞ্চ এই পঞ্চশ বছরে উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায়, উজানে বহু বাধ নির্মাণ, জলবিদ্যুৎ স্থাপনার কারণে এ সকল নদীর পানির অধিকার থেকেই আমরা বঞ্চিত হচ্ছি না কেবল, খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া, আর বর্ষা মৌসুমে উপুর্য্যপুরি বন্যার দ্বারা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি এবং এখনও হয়ে চলেছি।

দেশ:কিন্তু গঙ্গা চুক্তিতো হয়েছে। একেবারে সফলতা হয়নি তাতো না।

মাহমুদুল হাসান মানিক: গঙ্গার পানিচুক্তির জন্য আমাদের স্বাধীনতার পর পঁচিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার ও ভারতের কেন্দ্রে বামপন্থীদের সমর্থিত যুক্তফ্রন্ট সরকার অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ও কমরেড জ্যোতিবসুর ব্যক্তিগত উদ্যোগের কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। আমি এই সাথে গঙ্গার পানির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও পানির ন্যায্য হিস্যার দাবীতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ স্মরণ করি। তার ঐ আন্দোলনের তীব্রতায় ভারতের তাৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৮ মে ‘৭৬ এক চিঠিতে আশ^াস দিয়েছিলেন, শুকনো মৌসুমে দু’মাসের জন্য কেবল পানি ঘাটতি হয়, উভয় দেশের সমঝোতা ও সহযোগিতার ভিত্তিতে সেই ঘাটতি পুরণ করার ব্যবস্থা অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে স্মরণ করি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের দ্বিতীয় ট্রাক ডিপ্লোমেসীতে বাংলাদেশ-ভারত ডায়ালগের। একইসঙ্গে স্মরণ করি গঙ্গার পানির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ওয়ার্কার্স পার্টি একদিকে আন্দোলন ও অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট নেতাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এই দাবির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করা।

আগেই বলা হয়েছে গঙ্গার পানি চুক্তিতে সেই সমাধান খুঁজে পাওয়া গেছে বহু পরে ১৯৯৬ সনে। কিন্তু ততদিনে উজানে পানি প্রত্যাহার করায় ফারাক্কায় গঙ্গার পানি প্রবাহ নিদারুণভাবে কমে গেছে। এই কারণেই গঙ্গা চুক্তিতে ভুটানোর সংকোশী নদী থেকে পানি এনে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। চুক্তিতে পাঁচবছর পরপর পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছিল, হয়নি। এখন শুকনো মৌসুমে এত পানি প্রবাহ কম যে পদ্মার তলদেশ ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে গেছে। ২০২৬ সনে ৩০ বছর মেয়াদী এই চুক্তি শেষ হবে। বলা আছে চুক্তি নবায়ন না হলেও বাংলাদেশ তাদের প্রাপ্যের ৯০% পানি পেতে থাকবে। তবে গঙ্গার পানি প্রবাহ যদি না থাকে তখন নব্বই কেন একশ ভাগ হিস্যা দিয়েও তো লাভ হবে না। এই চুক্তি নবায়নে বা পর্য্যালোচনা ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কোন উদ্যোগ আছে কিনা জানা নেই।

দেশ: তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কিছু বলুন। 

মাহমুদুল হাসান মানিক: তিস্তার পানি বন্টনের ব্যাপারে চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেও পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপধ্যায়ের আপত্তিতে স্বাক্ষরিত হয়নি, বছরের পর বছর ঝুলে আছে। তবে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কেন্ত্রীয় সরকারই দায়ি। শুধু একা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপধ্যায়কে দায়ি করলে চলবে না। 

দেশ: জনগণ দাবি করলেই ভারত মেনে নেবে? তিস্তা চুক্তি বাসতবায়নের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কুটনৈতিক ব্যর্থতা আছে বলে মনে করেন কি-না?

মাহমুদুল হাসান মানিক: এটা নিয়ে সরকারের দায়ি করার ব্যাপার না। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের জন্য যা যা প্রয়োজন তা সবই করেছে। আর তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে চুক্তিটি কেনো ভারত বাস্তবায়ন করছে না তা নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকেই সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতিবাদ সমাবেশের মধ্যে ভারত বুঝতে পারবে যে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন দরকার। কিন্তু জনগণতো সেভাবে দাবি করছে না, জেগে উঠছে না। ।

বাংলাদেশের জনগণ ভারতের জনগণের কাছে আবেদন জানাবে যে এচুক্তি আমাদের দরকার। আসলে চুক্তি বাস্তবায়নে দু-দেশের জনগণেরও ঐক্য দরকার। মেঘনা অববাহিকার ক্ষেত্রেতো একই ঘটনা ঘটেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং টিপাই মুখে বাঁধের শিলান্যাস করার পর বাংলাদেশের ঘুম ভাঙাতে নানা প্রতিবাদের মুখে সেই প্রকল্প স্থগিত হয় বলে জানা যায়। তবে পরবর্তীতে কি হয়েছে দেশবাসী জানে না। অথচ এদিকে ইতোমধ্যে কখনও তিস্তায় বন্যায় চরের সব ফসল তলিয়ে যাচ্ছে, অন্য সময় শুকনো খটখটে।

আর ভাঙ্গণ হয়েছে নিত্যসঙ্গী। অন্যদিকে তিস্তা খননের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের পরও সরকার কোন আপত্তিতে এটা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না দেশবাসীকে তা জানানো প্রয়োজন। নিজ অর্থে পদ্মা সেতু করতে পারলে তিস্তা খনন করা যাবে না কেন। এবারের বর্ষার আগেই নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় সুরমার বন্যায় সিলেট ডুবেছে। মেঘনা নদীর পরিণতি কি হবে জানা নেই। অন্যদিকে ভারতের পর এবার চীন ব্রহ্মপুত্র নদীতে উজানে বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের উজানে জলবিদ্যুৎ স্থাপনাও তৈরি হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র-যুমনার কি হবে সেটাও উদ্বেগের বিষয়।

উল্লেখ্য, মাহমুদুল হাসান মানিক ১৯৫১ সনের ৩১ ডিসেম্বর দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সনে তিনি দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৭০ সনে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭২ সনে ঐ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ সনে মেনন গ্রুপে যোগ দিয়ে জেলা ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৭১ সনে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন গঠনকালেই তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের জেলা নেতৃত্বে সক্রিয় ছিলেন।

ছোট বেলা থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। মুকুল ফৈজ, রেডক্রস, স্কাউর্টিং ইত্যাদিতে সক্রিয় ছিলেন এবং দিনাজপুর জেলা স্কুলের ৩ বছর ক্যাডেট কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ছোট বেলা থেকে কবিতা আবৃত্তি ও নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটিতে যোগদান করে জেলায় নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা ঘোষণায় দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং মার্শাল ল ৬০ ধারায় মামলা হলে আত্মগোপনে চলে যান।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পার্টির নির্দেশে আত্মগোপন অবস্থায় গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। ২৭ এপ্রিল দিনাজপুরে পাক আর্মির বিরুদ্ধে ইপিআর বিদ্রোহে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত দিনাজপুরকে মুক্ত রাখেন। ১০ এপ্রিল পাক আর্মির আক্রমণকে ১০ মাইন যুদ্ধে ইপিআরএর সাথে তার সহকর্মীদের নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে বহু হতাহত হলে অল্পের জন্য তার প্রাণ রক্ষা হয়। 

ইপিআর-এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বিরল এবং পাকুড়া ক্যাম্পের যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। রাধিকাপুর সীমান্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারতে গমন এবং ৭নং সেক্টরের অধীনে ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা আনেন। স্বাধীনতার পর পল্টনে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের সম্মেলনেও তিনি সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সনে ১৭ মে লেনিনবাদী পার্টির জন্মলগ্নের কনভেনশনে জন্ম সদস্য এবং দিনাজপুর জেলা পার্টির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৪ সনে তিনি লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গঠনের সময় তিনি কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। অপরদিকে ছাত্র রাজনীতি থেকেই তিনি কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় হন। এবং জাতীয় কৃষক মুক্তি সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় কৃষক সমিতিতে সক্রিয় হন। এবং সক্রিয় কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে আজ পর্যন্ত জড়িত। বর্তমানে তিনি জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর অন্যতম সদস্য হিসেবে বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন।


শেয়ার করুন