০৮ অক্টোবর ২০২৫, বুধবার, ০৩:১৫:২৬ অপরাহ্ন


হাসিনা ও নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানে হতাশ আ’লীগ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-১০-২০২৫
হাসিনা ও নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানে হতাশ আ’লীগ আওয়ামী লীগের লগো


বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে ভারতের সর্বশেষ অবস্থানে বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। একইসাথে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়ে কোনো ধরনের ইতিবাচক বক্তব্য না পাওয়ায় হতবাক এবং হতাশ হয়েছে দলের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে বাংলাদেশে থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর ধরপাকড় নিয়ে মহা আতঙ্কে। একিই সাথে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়াদের বাংলাদেশে অবস্থানরত পরিবার পরিজনদের মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। 

ভারতের সর্বশেষ অবস্থান কি?

গত ৬ অক্টোবর সোমবার দিল্লির সাউথ ব্লকে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ডিকাব) সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। এতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ডিকাবের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে ভারত সফর করছে। মতবিনিময়কালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধির জয়সওয়াল, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারবিষয়ক ডেস্কের যুগ্ম সচিব ভি শ্যাম, ডিকাবের সভাপতি এ কে এম মঈনউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান মামুনসহ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। 

কি বললেন বিক্রম মিশ্রি

ডিকাব সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, পানিবণ্টন ইস্যু এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থান করা বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেখানে থাকা-র উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিক্রম মিশ্রি । তবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে বাংলাদেশে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বাংলাদেশ থেকে জনরোষে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রসঙ্গ। এসব নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের সাফ জবাব ছিল অত্যন্ত পরিস্কার, সাদামাটা কিন্তু অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ। 

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে যেমন বলেছেন, বাংলাদেশে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে ‘অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের’ প্রতি ভারতের সমর্থনের কথা। তেমনি এই অপশন বা ধারাও রেখে অন্যরকম কথাও বলেছেন, যা বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। কেননা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে যখন বলা হয় যে, একটি বড় দলকে বাদ দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়টি। এর জবাবে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার মধ্যে আমি যেতে চাই না। এই নির্বাচন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে কীভাবে দেখা হবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ, জনগণ ও সুশীল সমাজ তাদেরকে নিজেদের মূল্যায়ন করতে হবে।’ এটা শুধু অভ্যন্তরীণ বৈধতার বিষয় নয়, বাইরের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে বিক্রম মিশ্রি সাফ জানিয়ে দেন,‘এসব সিদ্ধান্ত শুধু বর্তমানের ওপর প্রভাব ফেলবে না। মধ্য থেকে দীর্ঘ মেয়াদেও এর প্রভাব থাকবে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ মিশ্রি এসব প্রসঙ্গে আরও পরিস্কার করে দেন বা সাফ জানিয়ে দেন যে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে একটি নির্দিষ্ট ‘ম্যান্ডেট’ আসবে। আর ‘এই ম্যান্ডেটকে কীভাবে দেখা সে প্রসঙ্গেও বিক্রম মিশ্রি উত্তর দেন। এপ্রসঙ্গে জনগণের রায়কে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিক্রম মিশ্রি উত্তর দেন ‘এই ম্যান্ডেটকে কীভাবে দেখা হবে সে প্রশ্ন যখন আসবে তখন ভারত হস্তক্ষেপ করবে না। বাংলাদেশের মানুষই এ বিষয় নির্ধারণ করবে।’

শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে

এরপরে এসে যায় স্বভাবত দেশটিতে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে..। এখানেও সাংবাদিকরা জানতে চান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এর প্রভাব নিয়ে। এমন প্রশ্নের উত্তরেও বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশের আইনের প্রতি সুস্পষ্ট সম্মান দেখান। তিনি বলেন, ‘এটা বিচারিক ও আইনি প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা ও মতবিনিময় প্রয়োজন। আমরা এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এসব বিষয়ে কাজ করার প্রতীক্ষায় আছি। এই মুহূর্তে এ বিষয়ে আর কিছু বলা গঠনমূলক হবে বলে আমি মনে করছি না।’ এছাড়াও আশ্বস্ত করেছেন, নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের রায় নিয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তাদের সঙ্গে কাজ করবে ভারত।

শেষমেষ কি দাঁড়ায়

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ডিকাবের ২৩ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদলের ভারত সফরের পাশাপাশি সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে মতবিনিময়টি এমনিতেই কোনো কারণ ছাড়া অনুষ্ঠিত হয়নি। আর সেই মতবিনিময়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির বক্তব্যকে হালকা করে দেখার সুযোগও নেই। তাই মতবিনিময়ে চলে আসা বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান দেশের ভেতরে বাইরের পাশাপাশি পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া আ’লীগ নেতাকর্মীরা হতাশায় পড়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন। কেননা তাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল প্রতিবেশী দেশটি তাদের সাবেক সভাপতির ব্যাপারে শক্ত ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। 

হতাশার আরো কারণ

সম্প্রতি একজন বাংলাদেশী সাংবাদিক সম্প্রতি একটি তথ্য তুলে ধরেছেন বাংলাদেশ থেকে জুলাই বিপ্লবের কতজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ওই সাংবাদিক ভারতীয় সাংবাদিক থেকে তথ্য পেয়ে জানান যে, ভারতে আওয়ামী লীগের প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী অবস্থান করছেন। এদিকে আরও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে জুলাই বিপ্লবের আওয়ামী লীগ নেতা, আমলা, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পদস্থ কর্তাব্যক্তি ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এক হিসাবে দেখা গেছে ৭৩৪ জন বাংলাদেশির বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়েছে দেশটির একটি সংস্থা। এই তালিকায় ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। 

অন্য এক খবরে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মামলা-হামলা ও রোষাণলের ভয়ে সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন দলটির কয়েকশ’ নেতাকর্মী। গোপনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা ভারতে প্রবেশ করেন। পালিয়ে যাওয়া নেতাকর্মীরা ভারতের গৌহাটি, শিলং, ডাউকি, জোয়াইসহ কয়েকটি এলাকায় বসবাস করছেন। 

কিন্তু আতঙ্ক কেনো?

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে, ভারতের কারাগারগুলোয় থাকা বিদেশি বন্দির মধ্যে সর্বাধিক রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আর এই বিদেশি জেলবন্দির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশিরা। সম্প্রতি ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘প্রিজন স্ট্যাটিস্টিকস অব ইন্ডিয়া ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কারাগারে ছয় হাজার ৯৫৬ বিদেশি নাগরিক বন্দি আছে। এর মধ্যে দুই হাজার ৫০৮ জন, অর্থাৎ প্রায় ৩৬ শতাংশই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কারাগারে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই বিদেশি বন্দির মধ্যে ৮৯ শতাংশই বাংলাদেশি নাগরিক। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের অভিযোগে বিভিন্ন সময় তাদের আটক করা হয়। তবে এটা ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পরের হিসাব না। কিন্তু আতঙ্কের কারণে হলো এই হিসাবে বাংলাদেশ থেকে জুলাই বিপ্লবের পর না, তাই এটা হয়তো আরও বেশি হবে ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপটে। কারো কারো মতে, বাংলাদেশ থেকে জুলাই বিপ্লবের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের একটি অংশ ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের পরিবারবর্গের ধারণা ভারতে আশ্রয় নেওয়া হলে সেদেশটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কাউকে অন্ততপক্ষে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী হলে আটক বা গ্রেফতারা করা হবে না। কিন্তু প্রিজন স্ট্যাটিস্টিকস অব ইন্ডিয়ায় তা বলে না। এজন্যই বাংলাদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আতঙ্কিত। এদিকে চলতি বছরের মার্চে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবৈধভাবে বসবাসের অভিযোগে অন্তত ২৪ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লি ও দক্ষিণ দিল্লিতে পৃথক অভিযান চালিয়ে দিল্লি পুলিশ ওই বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তার করেছে। ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। 

একটি সূত্র মনে করেন, বাংলাদেশের নির্বাচন আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়ে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান ভবিষৎ এ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কোন বিপদে ফেলে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কেননা অতি সম্প্রতি দৃশ্যত বেসরকারি মোড়কে ভারতে বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকেও বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান আওয়ামী লীগের জন্য নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে। ওইসব বৈঠকে বার্তা ছিল ঠিক এরকম যে, ‘এই মুহূর্তে কোনও ’প্ররোচনায়’ পা না দিয়ে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের নির্বাচনে কী ফলাফল হয়, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করা।

শেয়ার করুন