মানিকমিয়া এভিনিউতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের সময় রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে নানা দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য কারণে সার্বিক পরিস্থিতি ততই সংঘাতময় এবং জটিল হয়ে উঠছে। উপদেষ্টারদের সেভ এক্সিট প্রসঙ্গ, পরপর তিন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, এমপিওভুক্ত শিক্ষদের রাজধানীর বুকে বসে লাগাতার আন্দোলনের নামে পেইন তৈরিকরণসহ নানা ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকার দুশ্চিন্তায়।
এরই মধ্যে জুলাইযোদ্ধাদের ব্যাপক লাঠিপেটা ও মামলা দায়েরের মধ্য দিয়ে সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশসমূহ সমন্বিত করে সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বিএনপি, জামাত এবং কিছু প্রান্তিক দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়ন করেছে। সনদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে বিএনপি মূলত এবং কিছু দলের নোট অফ ডিসেন্ট আছে। কিছু বিষয় দেশে বিদ্যামন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
১৭ অক্টোবর ২০২৫ জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হলো। স্মরণে রাখতে হবে তৃণমূলে সুসংগঠিত আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টির বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী কিন্তু প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন বিষয়ে বিএনপি, জামাত এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট এনসিপির মধ্যে তীব্র বিরোধ আছে। পিআর পদ্ধতি, তথাকথিত গণভোটের সময় নিয়ে আছে মতবিরোধ।
জামাত এবং সমমনা কিছু দল কৌশলগত পরিকল্পনায় পিআর আর গণভোট বিষয়ে আন্দোলন করছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনগত বাদ্ধবাধকতা নিশ্চিত না থাকার অজুহাতে এনসিপি বেঁকে বসেছে। সরকারের অনুঘটক এবং সরকারের অংশীদার এনসিপি কিছু উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং নিরাপদ প্রস্থানের ষড়যন্ত্রের গুরুতর অভিযোগ তুলেছে। দেশে বিদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রচন্ড চাপ আছে।
বর্তমানে স্থগিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে থাকা আওয়ামী লীগ এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ রেখে আদৌ নির্বাচন করা হয়ত কঠিন হবে। আর আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখলে সংঘাত সামাল দেওয়া দুরূহ হবে। আবার আওয়ামী লীগ তাদের মতে অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনে আসবে বলে মনে হয় না। এতো গেলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
অন্যদিকে তড়িঘড়ি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গঠন করে গুম, খুন, গণহত্যার বিতর্কিত অভিযোগের বিচার প্রক্রিয়ায় শেখ হাসিনা এবং অপসারিত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিচারকাজ শেষ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভারতে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় থাকা শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজব। যাই হোক বিদ্যমান অবস্থায় হাসিনা বা তার সরকারের কোনো ব্যক্তিকে প্রবেশ থেকে দেশে এনে বিচারের কোনো সুযোগ দেখছি না।
এরপর বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের অন্যতম মূল স্টকহোল্ডার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন সম্প্রতি সংকটে রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল গুম-খুনের অভিযোগে বেশকিছু চাকরিরত এবং অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করে গ্রেফতার আদেশ জারি করেছে। নড়েচড়ে বসে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সেনা ছাউনি। জানা গেছে কিছু অভিযুক্ত ইতিমধ্যে দেশত্যাগ করেছে।
বাকিদের সেনা ছাউনিতে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। পক্ষে এবং বিপক্ষে বিভক্ত মতামত থাকায় সেনাপ্রধান আছে চাপের মুখে। সবাই জানে জুলাই আগস্ট ২০২৪ সরকার পরিবর্তনের প্রধান অনুঘটক ছিল বর্তমান সেনাপ্রধান। প্রথম ঘোষণাটি এসেছিলো তার তরফ থেকেই। সেনাবাহিনী এখনো সরকারের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে রাজপথে। আগস্ট ২০২৪-এর পর মব সন্ত্রাসসহ নানা ঘটনা সামাল দিতে ব্যর্থতার দায় ভার সেনাবাহিনীর ওপর বর্তায়। এখন মূল বিষয় হলো, ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার হবে কোন আইনে?
কেন সাধারণ নাগরিকদের মতো বেসামরিক আদালতে বিচার করা যাবে না সেটি এখন বহুল চর্চিত। শেষকথা হলো, সেনা ছাউনির পরিস্থিতি শান্ত নেই। অগোছালো পুলিশ বাহিনী, সুযোগসন্ধানী বেসামরিক প্রশাসন এমতাবস্থায় দ্বিধাবিভক্ত সেনাবাহিনী থাকলে কাদের সহায়তায় অর্থবহ নির্বাচন হবে?
এদিকে দেশে নানা বিষয়ে আন্দোলন হচ্ছে, পরপর তিন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, সীমান্ত পরিস্থিতি অস্থির, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বেকার সমস্যা প্রকট। নুন আনতে পান্তা ফুরানো নিম্ন বিত্ত, মধ্যবিত্তের জীবন অসহায় হয়ে পড়ছে। অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নমুখী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক।
সার্বিক বিষয় অনেক জটিল হয়ে পড়েছে। দেশে এবং বিদেশে ক্রমাগত বিতর্কিত হতে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জগুলো ঘনীভূত হতে থাকায় নির্বাচন নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন পরিস্থিতি পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিদিন নতুন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ছাড়া বিকল্প নেই।