৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৫:৫৯:৩৪ অপরাহ্ন


দেশকে মামুনুর রশীদ
হিরো আলমের মতো লোকেরা তো লুম্পেন
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৪-২০২৩
হিরো আলমের মতো লোকেরা তো লুম্পেন মামুনুর রশীদ


মামুনুর রশীদ। বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে যে কজন মানুষ নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের অন্যতম তিনি। অংশগ্রহণ করেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। তিনি একাধারে নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা ও সংগঠক। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। প্রসঙ্গত এসেছে হিরো আলমের কথা। এসব নিয়ে কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির

প্রশ্ন: শুরুতে জানতে চাই নাটক আর আপনার সম্পর্কের গোড়াটা ঠিক কোথায়? 

মামুনুর রশীদ: টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী থানার পাইকড়ায় মামা বাড়িতে আমার জন্ম। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান ছিলাম। আমার ছোট মামা বেশ রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে ওই প্রত্যন্ত গ্রামে বসেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। গান করতেন তিনি। ফুটবলার হিসেবেও খ্যাতি ছিল তার। মামাকে দেখেই আমার মধ্যে এক ধরনের বহির্মুখী ঝোঁক সৃষ্টি হয়। আমার দাদাবাড়ি ছিল ঘাটাইল থানায়। বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। সে সুবাদেও অনেক জায়গা ঘুরা হয়েছে। যেমন আমার স্কুল শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহের ফুলপুরে। ছেলে বেলার বড় একটা অংশ কাটিয়েছি এলেঙ্গা আর বল্লায়। এই দুই জায়গাতেই প্রচুর যাত্রা দেখার সুযোগ হয়েছে। সোহরাব-রুস্তম ওই বয়সে আমার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল। এলেঙ্গায় ভট্টাচার্যদের জমিদার বাড়িতেও অনেক কিছু দেখেছি। পালা-পার্বণ সেখানে লেগেই থাকত। কালীপূজার সময় তিনদিন ধরে খ্যামটা নাচ হতো। তাদের নাটমন্দির ছিল। সেখানে নাচ হতো, যাত্রা হতো। ওখানেই আমার কৃষ্ণলীলা, রামলীলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কথক ঠাকুর থাকতেন। মহাভারতের গল্প বলতেন, একটি মাত্র লাঠি নিয়ে। এই লাঠিটাই কখনো তরবারি হয়ে যেত, আবার বনে যেত রথের রশি! কী দারুণ সব ব্যাপার-স্যাপার। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। যখন আমার বয়স পাঁচ কী ছয় বছর হবে, তখন সিরাজউদ্দৌলা দেখেছিলাম টাঙ্গাইল করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবে। বেশি কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে, ‘পথহারা পাখি’ গানটা শুনতে শুনতে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এভাবেই ছোটবেলা থেকে নাটকের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

প্রশ্ন: এই অঙ্গন থেকে আপনি অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। অনুভূতি কেমন?

মামুনুর রশীদ: গত চার মাসে পাঁচটি সম্মাননা পেলাম। মমতাজউদ্দীন আহমদ সম্মাননা, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আলী যাকের উৎসবে সৈয়দ শামসুল হক সম্মাননা, শুকচর রেপার্টরি সম্মাননা, কলকাতায় পেলাম অনিক সম্মাননা আর সেদিন বিশ্বনাট্য দিবস সম্মাননা। সম্মাননা পেলে তো ভালোই লাগে। এটা কাজের স্বীকৃতি।

প্রশ্ন: সম্প্রতি ফেডারেশন ছেড়েছে নাট্য সংগঠন ‘ঢাকা থিয়েটার’। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

মামুনুর রশীদ: এটা হওয়া উচিত নয়, আমি এ বিষয়ে প্রকাশ্যেই বলেছি। এটা মিটিয়ে ফেলা উচিত। ঢাকা থিয়েটারের নাসির উদ্দীন ইউসুফ অবশ্য মিটিয়ে ফেলার অনেক উদ্যোগ, অনেক কথা বলেছে। আমি, আসাদুজ্জামান নূর, আব্দুস সেলিম- আমরা সবাই দুই পক্ষের সঙ্গে বসেছি। কিন্তু এক পক্ষ চাচ্ছে একটা নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি হোক। অন্য পক্ষ বলছে, আমরা ফেডারেশনের ৫৩টি দল মিলে যেটা করেছি, সেটাই সঠিক। 

প্রশ্ন: মূল সমস্যাটা কী বলে মনে হয়?

মামুনুর রশীদ: প্রসিডিউরগত কিছু ত্রুটি আছে। কামাল বায়েজিদ সেক্রেটারি জেনারেল থাকাকালীন যে টাকা খরচ করেছে ফেডারেশনের জন্য, তার সঠিক রেকর্ড রাখা উচিত ছিল। এবং সে যখন টাকাটা নেয়, তখন যদি চেয়ারম্যানের দস্তখতটা নিত, তাহলে আজ এমন পরিস্থিতি হতো না। আরেকটা বিষয় হলো, সেক্রেটারি জেনারেলকে যদি অব্যাহতি দিতে হয়, তাহলে কিছু লিখিত এবং অলিখিত প্রসেস মানতে হয়, যেটা ফেডারেশন করেনি। অবশ্য তারা বলছে, তারা মেনেছে। 

প্রশ্ন: সম্প্রতি রুচির দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে আপনি হিরো আলমের কথা বলেছেন। বিষয়টি একটু খোলাসা করবেন?

মামুনুর রশীদ: যাঁরা বুঝদার তাঁরা বুঝেছেন, যাঁরা বোঝেননি তাঁরা তর্কে জড়িয়েছেন। এখানে হিরো আলম একটা উদাহরণমাত্র। এই যে এখন হিরো আলম নিজেও অবতীর্ণ হয়ে গেছে ফেসবুকে। সে বলছে, আত্মহত্যা করবে। ‘আমাকে মারি ফেলান, আমি তো শিখি নাই’-তো শিখতে হয় তো! এটা তো এমন একটা বিদ্যা না, যেটা শেখা যায় না। 

প্রশ্ন: শিল্পী কি তৈরি করা যায়? নাকি চর্চার মাধ্যমে শিল্পী হয়ে উঠতে হয়?

মামুনুর রশীদ: অবশ্যই চর্চার মধ্য দিয়ে তৈরি হতে হয়। আমরা শিখেছি। পৃথিবীর সবাই শিখেছে।

প্রশ্ন: অনেকেই শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলছেন?

মামুনুর রশীদ: এই একটা বিশ্রী ব্যাপার এসেছে, অনেকে শ্রেণিসংগ্রামের একটা ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে সে (হিরো আলম) দরিদ্র বলে। আরে, একটা দরিদ্র লোক ডাকাত হবে, এটা সমর্থনযোগ্য? এটা সমর্থন করব? তার মানে কী? কাজী নজরুল ইসলাম কি কোটিপতি ছিলেন? তিনি তো ওর চাইতেও দরিদ্র ছিলেন। তাঁর বাবা মারা গেছেন, তিনি লেটোর দলে যোগ দিয়েছেন, তাঁর যে আকুতি লেখাপড়ার জন্য! রুটির দোকানে কাজ করে লেখাপড়া শিখেছেন, ফারসি শিখেছেন, আরবি শিখেছেন, গান শেখার জন্য যে কত লোকের কাছে গিয়েছেন, এভাবে তিনি নিজেকে তৈরি করে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লিখেছেন।

প্রশ্ন: আপনারাও তো দীর্ঘদিন চর্চা করে অভিনয়ে এসেছেন?

মামুনুর রশীদ: আমরা তো গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। এই শহরে এসে কত লোকের বারান্দায় বসে থেকেছি শেখার আশায়। খান আতাউর রহমানের সঙ্গে একটু দেখা করার জন্য গুলিস্তানে তিনি যে অফিসে আসতেন, সেই অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমজাদ হোসেনের বাসার দরজায় কত বসে থেকেছি, তাঁর কাছে জানার চেষ্টা করেছি কী করে নাটক লিখব, কী করে একটা ভালো স্ক্রিপ্ট লিখব। অভিনয় শেখার জন্য যাঁরা ভালো অভিনয় করেন, তাঁদের পেছন পেছন ঘুরেছি। এভাবে কাজ শিখে তবে কাজ করতে এসেছি। কতটা পেরেছি সেটা এখনো পরীক্ষাযোগ্য।

প্রশ্ন: এই যে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছেন, এটা কী কেবল মিডিয়াতেই ঘটেছে?

মামুনুর রশীদ: আমি যে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলেছি, সেটা কেবল মিডিয়াতে নয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, আমাদের রাজনীতিতে, প্রায় সবখানেই। কে নেতা হচ্ছে, কাকে ভোট দিচ্ছে, অর্থ, পেশিশক্তির ব্যবহার হচ্ছে। যেটা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটা শিক্ষা। স্কুলে লেখাপড়া হয় না, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দুর্নীতি-এগুলো আমরা চোখের সামনে দেখছি। একজন ভাইস চ্যান্সেলর, তাঁর দুর্নীতি করার দরকার আছে? একটা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বিপুল টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিচ্ছে। এই টাকা সে তুলবেই চাকরি করতে গিয়ে!

প্রশ্ন: এই কারণেই কী এখন স্যার না বলে ভাই বললে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে?

মামুনুর রশীদ: হ্যাঁ, স্যার বলতে হবে। এসবই তো রুচির দুর্ভিক্ষ।

প্রশ্ন: সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ নানা ধরনের মন্তব্য করছেন। পড়েছেন সব?

মামুনুর রশীদ: সব তো পড়া সম্ভব নয়। অনেকেই আমাকে বলছে আমি শ্রেণিসংগ্রামের মানুষ হয়ে নাকি ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছি। আরে ওকে (হিরো আলম) একা বলব না, ওর মতো লোকেরা তো লুম্পেন। এরা তো কিছু না বুঝে সমাজটাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র হলেই সে শ্রেণিসংগ্রামের লোক হয়ে গেল? তাকে প্রমাণ করতে হবে তার কাজ দিয়ে। যাঁরা মন্তব্য করছেন, তাঁদের অধিকাংশই বলছেন, তার কোনো কাজ দেখেননি। কাজ দেখেননি তো তাকে নিয়ে কথা বলছেন কেন?

প্রশ্ন: তসলিমা নাসরিনও কথা বলেছেন, পড়েছেন সে কথা?

মামুনুর রশীদ: আমি তসলিমা নাসরিনকে বলতে চাই, তসলিমা কি হিরো আলমের কোনো কাজ দেখেছে? কাজ দেখে কথা বলুক! কেবল আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার জন্য এসব করার তো কোনো মানে হয় না। 

প্রশ্ন: এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চান?

মামুনুর রশীদ: আমাদের গ্রামবাংলা হচ্ছে লোকসংগীতের, লোকসাহিত্যের, লোকজ ঐতিহ্যের একটা বিশাল ভান্ডার। এসব নিয়ে গ্রামগঞ্জে কত বড় বড় শিল্পীর জন্ম হয়েছে! পবনদাস বাউল শিল্পপতির ছেলে নাকি? সে খেতে পায় না, অথচ তাঁর গান দিয়ে সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মমতাজের যে কণ্ঠ, মমতাজ কোথা থেকে এসেছে? তার বাবা যাত্রাপালায় বিবেকের গান গাইত, সেখান থেকে মমতাজ নিজেকে পরিশীলিত করে, সাধনা করে আজকের এই অবস্থানে এসেছে। আরজ আলী মাতুব্বর কোটিপতি নাকি? অথচ তথাকথিত কিছু শিক্ষিত লোক আজ ফাজলামো করে বেড়াচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা দরকার। এখন হাতের কাছে একটা ফেসবুক পেয়েছে, সেখানে যখন যা ইচ্ছা লিখে দিল। এই যে ধৃষ্টতা, এটাই তো রুচির দুর্ভিক্ষ।

প্রশ্ন: আপনি তো নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, শ্রেণিসংগ্রামও তো সেক্ষেত্রে স্থির থাকার কথা নয়...

মামুনুর রশীদ: হ্যাঁ, এটা ঠিক। পরিবর্তন তো অবশ্যই ঘটে চলেছে। এক সময় সমষ্টি একটা মুখ্য বিষয় ছিল। তারপর দেখা গেল বিবর্তনের পথ ধরে সমষ্টি থেকে কখনো আমি ব্যক্তিতে ফিরে এসেছি। আবার ‘রাঢ়াঙ’ নাটকে দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে। সাঁওতাল জনগোষ্ঠী, তারাই এই নাটকের নায়ক। মোটকথা, এগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে না। মাঝেমধ্যে অদলবদল ঘটছে। আমিও নতুন অনেক কিছু ভাবছি, নতুন পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অন্তরে শ্রেণি সংগ্রাম রয়ে গেছে।

শেয়ার করুন