০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৩৭:৩৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


কামাল ভাইকে যেমন দেখেছি
আহবাব চৌধুরী খোকন
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৪-২০২২
কামাল ভাইকে যেমন দেখেছি


গত ৫ এপ্রিল ছিল বাংলাদেশ সোসাইটি নিউইয়র্ক ইনকের নির্বাচিত সভাপতি কমিউনিটির সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মরহুম কামাল আহমেদের দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকী। বছর দুয়েক আগে বৈশ্বিক মহামারী করোনা আক্রান্ত হয়ে আমাদের নিকট থেকে বিদায় নেন তিনি। কামাল ভাই দীর্ঘদিন যাবৎ উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশি কমিউনিটিকে সুখে-দুঃখে আগলে রেখেছিলেন। দল-মত-নির্বিশেষে হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয় কামাল ভাই। দেশের বাড়ি সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলায়। তিনি ঢাকা কৃষি কলেজ থেকে কৃষি বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি সম্পন্ন করে যোগ দিয়েছিলেন সরকারি চাকরিতে। কিন্তু তাঁর চাকরি জীবনের গৎবাঁধা জীবন ভালো লাগেনি। তাই সরকারি চাকরি ত্যাগ করে ১৯৭৭ সালে নোঙর ফেলেন আটলান্টিক তীরের ব্যস্ততম নগরী নিউইয়র্কে এবং তার পর সাড়ে চার দশকের ও বেশি সময় বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কমিউনিটিতে একটি বিশেষ স্থান করে নিতে সম হয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেও কখনো নিজের জন্য কিছু করতে দেখিনি। আমৃত্যু ভাড়া ঘরে থেকে জীবন অতিবাহিত করলেও কারো বিপদাপদে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতেন। উপার্জনের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করছেন সমাজ বিনির্মাণে। এই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি সংস্কৃতির বিকাশ ও কমিউনিটির উন্নয়ন ছিল তাঁর স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিয়ানীবাজার সমিতি, লিগ অব আমেরিকা জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ সোসাইটি, বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল যখন যে সংগঠনে সময় দেয়া দরকার কিংবা যখন যে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে তা পালনে কখনো কুণ্ঠিত হননি। 

মানবতাবাদী ও পরোপকারী কামাল আহমদ ছিলেন আমার দীর্ঘসময়ের একজন ভালো শুভাকাক্সক্ষী। প্রতি মাসে উনার সাথে যেমন দেখা হতো, তেমনি ফোনে কথা হতো প্রায়ই। যতটুকু মনে পড়ে মৃত্যুর দিন দশেক আগে (২০২০ সালের ২৫শে মার্চ) উনার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল। করোনা ভাইরাস তখন সর্বত্র জেঁকে বসেছে। নিউইয়র্কজুড়ে কারফিউ চলছে। পুরো নগরী পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। কমিউনিটির প্রিয়মুখ ময়নুজ্জামান চৌধুরী, সৈয়দ ইলিয়াস খছরু, আব্দুল হাসিম হাসনু, গিয়াস উদ্দিন, সৈয়দ আল ওয়াহিদ নাজিম, শাহ বদরুজ্জামান রুহেলসহ চারিদিকে পরিচিতজন অনেকেই তখন অসুস্থ। ভয়ে শ্বাসরুদ্ধকর একটি সময় অতিক্রম করছি তখন। এমনি সময় উনার ভগ্নিপতি জনাব ফারুক চৌধুরীর নিকট থেকে শুনলাম কামাল ভাই অসুস্থ। খবরটি শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। এক রিং হতেই ফোন ধরেছেন। কামাল ভাই কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই ভাঙা কণ্ঠে উত্তর, ‘আমি ভালো আছি। তবে একটু কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছি। তোমার ভাবী বেশি অসুস্থ। উনার জন্য দোয়া করো। ভাবছি না কমলে উনাকে দিন দুয়েকের মধ্যে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবো। সাবধানে থেকো এবং যদি দেখা না হয় মা করে দিও। ‘কামাল ভাই সেদিন আমার সাথে ফোনালাপে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খছরু ভাইয়ের খবর জানতে চেয়েছিলেন। সাথে একটি দায়িত্বও দিলেন। বললেন, করোনা আক্রান্ত মানুষের জন্য বাংলাদেশ সোসাইটির প থেকে ১০০০ প্যাকেট গ্রোসারি সামগ্রী তৈরি করে রাখা আছে। সাদি ভাইকে বলেছেন ব্রঙ্কসে ২৫০ প্যাকেট পাঠাতে। আমি যেন বিলি বণ্টনে একটু সহযোগিতা করি। তারপর থেকে আমি ফোনে আর তাঁকে পাইনি। তবে ফারুক ভাই ও সাদি ভাইয়ের মাধ্যমে নিয়মিত খবর রেখেছি। তখন থেকে উনার শরীর ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। ভাবীকে লংআইল্যান্ড হাসপাতালে পাঠিয়ে ২৮শে মার্চ নিজে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তিনি এলমাস্ট হাসপাতালে গেলেন। আমরা খুব উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটাচ্ছিলাম। পরীায় ধরা পড়ে কোভিড-১৯ পজিটিভ। তারপর ৫ই এপ্রিল দিবাগত রাত ৪ ঘটিকায় সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। উনার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় বাকা ও জালালাবাদ অ্যাসোসিয়শনসহ বিভিন্ন সংগঠন তাৎণিক ভার্চুয়াল দোয়া মাহফিলের আয়োজন করলেও আমরা এতোটা ভাগ্যাহত যে করোনা ভাইরাসের বিধিনিষেধের কারণে প্রিয় এই মানুষটির বিদায় বেলা কবরে দু’মুঠো মাটি দেয়ারও সুযোগ পাইনি। উনার জন্ম হয়েছিল বোধকরি কেবল দেয়ার জন্য। শুধু দিয়েই গেলেন। যাওয়ার সময় কাউকে একটু ঋণ পরিশোধেরও সুযোগ দিলেন না। 

কামাল ভাই ভালো একজন মানুষ ছিলেন। তাকে ঘিরে পুরো থ্রাই স্টেটে একটি শক্তিশালী গ্রæপ গড়ে উঠেছিল। তিনি ছিলেন এই গ্রুপের মধ্যমণি। মানুষের বিপদাপদে তিনি নিরন্তর কাজ করে গেছেন। উনার সাথে কাজ করার অনেক স্মৃতি আমার রয়েছে। তিনি প্রথমবার যখন বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন, আমিও তাঁর সাথে একই কমিটিতে ছিলাম। তখন দেখেছি সোসাইটিকে শক্তিশালী করতে তাঁর উদ্যোগ। তিনি বাংলাদেশি সংস্কৃতির বিকাশে সোসাইটির প্রথম বৈঠকে বারোমাসে তেরোটি অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব করেছিলেন। সোসাইটি ভবনে নিজহাতে গঠন করেছিলেন একটি লাইব্রেরি। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কম্পিউটার ও বাংলা স্কুল। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা স্কুল চালু হলে আমাদের নতুন প্রজন্ম যেমনি বাংলা ভাষা পড়া ও লেখা শেখার সুযোগ পাবে, তেমনি নতুন অভিবাসী কম্পিউটার শিখে নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আসতে তিনি যেমন প্রচুর লোককে স্পন্সর করেছেন, তেমনি দেশ থেকে নতুন আসা লোকদের কর্মসংস্থান ও আবাসন সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করতেন। কারো অসুস্থতা কিংবা মৃত্যুসংবাদ শুনলে সর্বাগ্রে এগিয়ে যেতেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন। দেশে নিজ এলাকায় যেমনি প্রচুর মসজিদ ও স্কুল স্থাপনে সহযোগিতা করেছেন, তেমনি এই যুক্তরাষ্ট্রে এমন কোনো মসজিদ নেই যেখানে কামাল আহমেদ আর্থিক সহযোগিতা করেননি। তিনি ছিলেন এলমাস্ট মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি ও একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রমজান মাসে বিভিন্ন জায়গায় যেমন ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন, তেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা-পার্বণে মিষ্টি পাঠিয়ে মহৎ হৃদয়ের পরিচয় দিয়েছেন। মৃত্যুর আগে তিনি করোনায় মৃত্যুবরণকারী সকল বাংলাদেশিকে বিনামূল্যে সোসাইটি কবরস্থানে দাফন কবার সিদ্ধান্ত দিয়ে গিয়েছিলেন। সোসাইটি সভাপতি হিসেবে এটাই ছিল তাঁর শেষ দায়িত্ব। দেখেছি দেশে অসচ্ছল মানুষের একটি দীর্ঘ তালিকা তাঁর নিকট সবসময় থাকতো। যাঁদেরকে তিনি প্রতি মাসে অর্থ পাঠিয়ে সহযোগিতা করতেন। নিউইয়র্কে এমন কোনো সংগঠন নেই যে, তিনি আর্থিক সহযোগিতা করেননি। আমাদের বাংলাদেশি আমেরিকান কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি আমাদেরকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। কামাল ভাই ছিলেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশি মানুষের নিকট মানবতার এক ফেরিওয়ালা। ফেরিওয়ালা যেমনি পণ্য সামগ্রী ফেরি করে বেড়ায়, তেমনি তিনি নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে সেবা ও মানবিকতা ফেরি করে বেড়াতেন। উনার অকাল মৃত্যুতে আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে কখনো তা পূরণ হবার নয়। দোয়া করি আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। 

লেখক : কলাম লেখক ও কমিউনিটি নেতা, নিউইয়র্ক

শেয়ার করুন