১৪ ডিসেম্বর ২০১২, শনিবার, ০৩:৩৩:৩৯ পূর্বাহ্ন


২৮ অক্টোবরের ঘটনায় বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-১১-২০২৩
২৮ অক্টোবরের ঘটনায় বাড়ছে আন্তর্জাতিক চাপ ২৮ অক্টোবরের সমাবেশে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন নয়াপল্টন


২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ধীরে ধীরে সোচ্ছার হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। বাংলাদেশে থাকা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিকট ২৮ অক্টোবরের প্রসঙ্গে সরকার পক্ষের ব্রিফিংয়ে উপস্থিত রাষ্ট্রদূতদের পিনপতন নীরবতা নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যে দুশ্চিন্তার ভাজ পরিলক্ষিত হওয়ার পর বিদেশী বিভিন্ন মাধ্যম থেকে একে একে আসছে বিবৃতি। যেখানে বিএনপির ওই সমাবেশে ঘটে যাওয়া বিষয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদেরই। এ ব্যাপারে প্রথম বিবৃতি দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রবিষয়ক ও সিকিউরিটি পলিসি প্রধান এবং ইউরোপীয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বরেল। একদিন পর বরেলের বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত। একই সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভেদান্ত প্যাটেল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। আমরা এক দলের ওপর অন্য দলকে প্রাধান্য দেই না। আমাদের মনযোগ বাংলাদেশে আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের দিকে এবং নির্বাচনের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছি।” মুখপাত্র আরো বলেন, “আমরা সরকার, বিরোধীদল, সুশীল সমাজসহ সব অংশীদারদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ করে যাচ্ছি এবং আহবান জানাচ্ছি তারা যেনো জনগণের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করেন।” সেখানে বাংলাদেশের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টিও আসে।

এরপরই বিবৃতি দিয়েছে রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসসহ আট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। ৬ নভেম্বর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসসহ আট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। সোমবার ওই বিবৃতিতে সংগঠনগুলো বাংলাদেশের চলমান বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন ও বিক্ষোভে সহিংসতা এবং গ্রেপ্তার নিয়ে গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করে।

এদিকে ইইউ’র প্রতিনিধির বিবৃতি নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারল সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতিতে তথ্যঘাটতি রয়েছে। তারা সেটি (তথ্যঘাটতি) সংশোধন করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

তবে এক এক করে বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিবৃতি ইশান কোনে মেঘ জমতে শুরু করেছে। কেননা সংগঠনগুলোর কেউ যখন সূচনা করে, অন্যসংগঠনগুলোর রিচার্জ উইংও সেগুলোর মতের সঙ্গে মিল রেখে একাত্মতা প্রকাশ করে। এটা ২৮ অক্টোবরের ঘটনার মোর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন যেভাবে বিএনপির উপর দায় চাপানোর যৌক্তিকতা দেখাচ্ছেন, সেটা যে আদৌ সঠিক নয় প্রকারান্তে সেটার প্রমাণ দেয়ার অবকাশ রাখে। ফলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এমন বক্তব্য ক্রমশ জোরালো হলে এটাতে বিএনপি ও সমমনা দলসমূহ যে ভূমিকায় রয়েছে সেটাকেই বরং সমার্থন করবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল প্রকারান্তে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরো বেশি কোনঠাসা হয়ে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

রবার্ট এফ কেনেডি ও ৮ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের যে বিবৃতি  

রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসসহ আট আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পদত্যাগ এবং একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের  দাবিতে গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপি ঢাকায় একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে। কিন্তু নির্ধারিত তারিখের আগেই ১২০০ জনেরও বেশি বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে তাদের বাড়িঘরসহ শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) ২৮শে অক্টোবর সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। 

গণমাধ্যমগুলোর রিপোর্টের বরাত দিয়ে ওই বিবৃতিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্টে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে- ২৮শে অক্টোবর সমাবেশের সময় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছিল। এতে অন্তত তিনজন নিহত হন। (নিহতদের মধ্যে আছেন একজন পুলিশ সদস্য, একজন বিএনপি কর্মী ও সাংবাদিক রফিক ভূঁইয়া)। ৩১শে অক্টোবর সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ সম্পর্কিত সহিংসতায় অন্তত ১১ জন নিহত হন এবং শতাধিক মানুষ আহত হন। যদিও বিক্ষোভকারীরাও সহিংস আচরণ করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব সহিংসতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভিন্নমত দমন করতে নেয়া চরম পদক্ষেপের একটি উদাহরণ। বিবৃতিতে বলা হয়, বিক্ষোভ চলাকালীন প্রাণহানি এবং সহিংসতা নিয়ে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। বিক্ষোভ শেষে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসায় অভিযান চালায়।

এদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া বিএনপির ৫ শতাধিক সদস্য ও সমর্থককে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করে এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনগুলো। বিবৃতিতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে, আটক ব্যক্তিরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে পারেন বলে আমরা আশঙ্কা করছি। নিরাপত্তা বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের হাতে নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহারের অভিযোগ গত কয়েক সপ্তাহে বহুগুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার ভিন্নমত দমন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শাস্তি দিতে কম প্রাণঘাতী অস্ত্রসহ ব্যাপক শক্তি ব্যবহার করেছে। এটি গণতন্ত্রের নীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকারকে আরও ক্ষুণ্ণ করে। বিবৃতিতে বলা হয়, রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর এই তীব্র দমন-পীড়ন অগ্রহণযোগ্য এবং এ কারণে বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং মৌলিক স্বাধীনতার অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। সম্প্রতি পুলিশের গুলিতে অন্তত দুই শ্রমিক নেতা প্রাণ হারিয়েছেন এবং বিক্ষোভের সময় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আমরা অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও অতিরিক্ত শক্তির ব্যবহার বন্ধ করতে এবং মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতাকে সম্মান ও সুরক্ষিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। 

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে এবং এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাই। মানবাধিকার রক্ষা ও প্রচারে নিজেদের অঙ্গীকার বজায় রাখা এবং বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই বাংলাদেশের ওপর ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউতে (ইউপিআর) এই উদ্বেগগুলি উত্থাপন করতে হবে। আগামী ১৩ই নভেম্বর এটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে, আমরা বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত, গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সহিংসতা, দমন-পীড়ন এবং হুমকির চলমান চক্রের অবসানের পাশাপাশি স্বেচ্ছাচারিভাবে গ্রেপ্তার হওয়া সকলের অবিলম্বে মুক্তির আহ্বান জানাচ্ছি। 

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী সংগঠনগুলো হচ্ছে, অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক, ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, ইন্টারন্যাশনাল রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল ফর টর্চার ভিক্টিমস, ওমেগা রিসার্চ ফাউন্ডেশন, রেডড্রেস, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার।

ইইউ’র প্রতিনিধির বিবৃতি ও মার্কিন দূতাবাস যেটাতে সমার্থন দেন

এর আগে গত ৫ নভেম্বর - বাংলাদেশে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করায় সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রবিষয়ক ও সিকিউরিটি পলিসি প্রধান এবং ইউরোপীয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বরেল। সেই সাথে সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপায় খুঁজে বের করার তাগিদও দিয়েছিলেন তিনি। রবিবার (০৫ নভেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (টুইটার) জোসেফ বরেল লিখেছিলেন-

“বাংলাদেশে আট হাজারেরও বেশি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করায় (আমি) উদ্বিগ্ন। সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার জন্য সহায়ক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে বের করাটা গুরুত্বপূর্ণ।”

সোমবার (০৬ নভেম্বর) সকালে ইইউ পররাষ্ট্রবিষয়ক ও সিকিউরিটি পলিসি প্রধানের ওই টুইট পোস্ট করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস নিজেদের অফিসিয়াল এক্স হ্যান্ডলে লিখেছে “আমরাও একমত।”

শেয়ার করুন