বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে বন্দিমুক্তি বিনিময় চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ফেরত চাইতে পারে সরকারিভাবে। যাতে তার বিচার করা যায়, মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ বা সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার প্ররোচনা দেওয়ার জন্য। আর ইতিমধ্যে শেখ হাসিনা শুরু করেছে বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে শেখ হাসিনা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। উসকে দিচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য।
বাংলাদেশ ও ভারত ২০১৩ সালে যে বন্দিবিনিময় চুক্তি (extradition treaty) সই করেছিল, তার আওতায় বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি এখন ভারতের আশ্রয়ে আছেন, তাকে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসন করা যায়। কিন্তু এ বন্দিবিনিময় চুক্তিতে কি এমন কোনো ধারা রয়েছে, যা দিয়ে বন্দিবিনিময়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যায়? আর তা যদি করা হয় তাতে প্রচ্ছন্ন কি ধরনের প্রভাব বা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে তা নিয়ে ভারতের সরকার ও গণমাধ্যম বিচার বিশ্লেষণ করে দেখছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ক্রাইমস ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি)-এর প্রধান প্রসিকিউটর প্রতিবেশী ভারত থেকে বিতাড়িত শেখ হাসিনাকে বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফেরত আনার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু প্রধান অপরাধী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তাকে ফিরিয়ে আনার আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ২০১০ সালে এ আইসিটি স্থাপন করেছিলেন শেখ হাসিনা, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে গত আগস্ট মাসের ৫ তারিখ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হাসিনা ভারতে আশ্রয় চেয়েছিলেন। তার পালিয়ে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ও তার কুকর্মের দোসরদের বিরুদ্ধে খুন, নির্যাতন, গুম, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার মতো কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অসংখ্য ক্রিমিনাল মামলা রুজু করা হয়। তর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা অদ্যাবধি ১১৩টি বলে জানা গেছে। এ সংখ্যা আরো বাড়বে, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে। তাছাড়া এখন ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় এক্সট্রাডিশন চুক্তি বলবত রয়েছে, যাতে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য তাকে ফেরত আসতে হবে বাংলাদেশে।
দেখা যাক, বন্দিবিনিময় চুক্তিতে কী বলা হয়েছে:
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কিংবা সংসদ সদস্যদের দেখার জন্য কখনো এ চুক্তি প্রকাশ করেনি। এখন এই প্রতিবেদক ভারতের বিভিন্ন সূত্র ও গণমাধ্যম থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করেছে তাতে যা বলা হয়েছে, তা দেখলে যা বোঝা যায়, তাহলো নিম্নরূপ :
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ক্রাইম (ট্রাইব্যুনাল) আইন অনুসারে বাংলাদেশ কোর্ট শেখ হাসিনার অবর্তমানেও অপরাধ মামলার বিচার করতে পারে। যা হোক, তাতে অবশ্য বিচারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থেকে যায়। তা বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া বা ডিউ প্রসেসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তাছাড়া বিচার বিভাগীয় আদেশ বাস্তবায়নেও তা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। অতএব শেখ হাসিনার এক্সট্র্যাডিশনকে জরুরি বা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে।
২০১৩ সালের ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার বন্দিবিনিময় চুক্তি উভয় দেশের সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কৌশলগত ব্যবস্থা হিসেবে সম্পন্ন করা হয়েছিল। ২০১৬ সালে তা আবার সংশোধন করে উভয় দেশের পলাতক ব্যক্তিদের বিনিময়ের পথ সহজ করা হয়েছিল। কয়েকজন উল্লেখযোগ্য রাজবন্দিকে বিনিময় করতে এ চুক্তি সহায়ক হয়। যেমন ২০২০ সালে শেখ হাসিনা শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত দুই ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর করার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। বিনিময়ে ভারতে ফেরত দেওয়া হয় অনুপ চেটিয়াকে, যিনি অধুনা নিষিদ্ধ ঘোষিত উলফার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অনুপ চেটিয়ার ঢাকায় ১৮ বছর সাজা হয়েছে এমন ব্যক্তিকেও ফেরত দিতে হয়েছে। বন্দিবিনিময়ের একটি মৌলিক শর্ত হচ্ছে যে, যে অপরাধ করেছে বন্দি তা উভয় দেশের আইনে শাস্তিযোগ্য হতে হবে। আর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভারতের আইনেও বিচারযোগ্য এবং তার কথিত অপরাধের জন্য শাস্তিরও যথেষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে, সেজন্য তাকে এ নিধানে ফেরত পাঠানো যায় বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুসারে। তাছাড়া চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে যে, চুক্তির পরিধি অনুযায়ী অপরাধী অপরাধ যেমন করেছে, তেমনি অপরাধ করতে, অপরাধে টোপ দিতে, অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ করতে অথবা অপরাধ সংগঠনে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে।
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২০১৬ সালে চুক্তি সংশোধনকালে অপরাধীর অপরাধ সম্পর্কিত নজির প্রদানে প্রয়োজনীয়তার শর্তকে শিথিল করা হয়েছে। ভারতীয় পত্রিকা দ্য হিন্দুতে চুক্তির আর্টিকেল ১০-এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, কোনো একটা যথাযোগ্য কোর্ট থেকে জারিকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানা এক্সট্র্যাডিশন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য যথেষ্ট।
বিনিময় করা কি অস্বীকার করা যায়?
চুক্তির ৬ নম্বর আর্টিকেলে বলা হয়েছে যে, যদি অপরাধ ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হয়, তাহলে বিনিময় বা ফেরত পাঠানো অস্বীকার করা যাবে। কিন্তু এ বিশেষ ব্যতিক্রমী ধারায় ব্যাপক লিমিটেশন বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেকগুলো অপরাধ যেমন-খুন, সন্ত্রাস-সম্পর্কিত অপরাধ এবং গুমের ক্ষেত্রে কারণসমূহ রাজনৈতিক বলে বিবেচিত হবে না। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে অভিযোগের কতিপয় বিষয় যেমন- খুন, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিখোঁজ ও নির্যাতন এই ব্যতিক্রমী ধারাভুক্ত নয়। বিষয়টি বিশ্লেষণ করে হিন্দু পত্রিকায় বলা হয়েছে, ভারত এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক সীমালঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করে এক্সট্র্যাডিশন অস্বীকার করতে পারবে বলে মনে হয় না।
বন্দিবিনিময় অস্বীকার করার আরেকটি ধারা আর্টিকেল ৮। এ আর্টিকেলে বলা হয়, যদি ফেরতের দাবি যথাযথ বিচারের নিমিত্তে সরল বিশ্বাসে করা না হয়, তাহল তা মান্য করা অস্বীকার করতে পারে। আর যদি কোনো ক্রাইম সামরিক বাহিনীর আইনে অপরাধ হলেও তা সাধারণ ক্রিমিনাল আইনে অপরাধ নয়। আর ভারত এ গ্রাউন্ডে শেখ হসিনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ‘গুড ফেইথ’-এ করা হয়নি বলে তাকে ফেরত প্রদান না-ও করতে পারে। আর ভারত তাতে মনে করতে পারে, তাকে রাজনৈতিক কারণে নিপীড়ন করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশে ফেরত গেলে তাকে অন্যায় বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। এ ধরনের ভারতীয় উদ্বেগ আরো ঘনীভূত হতে পারে বা ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত না পাঠানোর জন্য ধানাইপানাই করতে পারে। কারণ সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গেছে, শেখ হাসিনার কেবিনেটের মন্ত্রীদের শারীরিকভাবে গ্রেফতার করছে, পাশে অবস্থানরত ব্যক্তিরা। আর তাদের কোর্টে নিয়ে সে অবস্থার শুনানির জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে ভারতের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ শেখ হাসিনার এক্সট্র্যাডিশন-বিরোধী মন্তব্য করেছেন। তারা হসিনাকে ফেরত দেওয়ার আগে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছে।
এপি জিনদাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. শ্রীরাধা দত্ত দ্য হিন্দু পত্রিকাকে বলেন, এ বন্দিবিনিময় চুক্তি শেখ হাসিনাকে ফেরতদানের গ্যারান্টি দেয় না। কারণ এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে কূটনৈতিক দরকষাকষি ও রাজনৈতিক বিবেচনার ওপর। তিনি বলেন, ‘যদি ভারত এক্সট্র্যাডিশন অস্বীকার করে, তা একটি নিছক ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বিরক্তিকর বিষয় হিসেবে প্রতীয়মান হবে। কিন্তু তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আঘাত হানবে না। বিশেষ করে উভয় দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি সহযোগিতার পথ রক্ষা করবে।’
বাংলাদেশ ভারতের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় সর্ববহৎ ট্রেড পার্টনার। আনুমানিক বর্তমান ট্রেড বলিউম ১৫.৯ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২-২৩ সালের হিসাবে দেখা যায়। হাসিনার পতনের আগে উভয় দেশ কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সিইপিএ) নিয়ে অর্থনৈতিক চুক্তির জন্য কাজ করছিল। ঢাকায় আওয়ামী সরকারের বিলুফিতর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে কথা হয়েছে। মোদি সরকার বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে সাহায্য বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে ভারত কতিপয় প্রকল্প নিয়ে নতুন করে সানাই বাজাচ্ছে। যেমন আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থ জোগান। আদানির সঙ্গে এ প্রকল্প চুক্তি বিশ্বের কাছে এক অগ্রহণযোগ্য চুক্তি। ভারত এ চুক্তির অর্থ আদায়ের জন্য বাংলাদেশকে আদানি গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা বলেছেন।