তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের অস্থিরতা। অশান্ত পাহাড়। সচিবালয়ে আমলাদের খাই খাই ভাব বৃদ্ধি ও বিগত সরকারের সুফলভুগীদের কৃতজ্ঞতাদানস্বরূপ অন্তর্বর্তী সরকারে অস্থিরতা তৈরি। পুলিশ বাহিনীর আন্তরিকতার অভাব। গণঅভ্যুত্থানে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র খুঁজতে যৌথবাহিনী তৎপরতা। আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী ও হত্যা মামলার আসামি ধরতে ধীরগতি। ভারত হঠাৎ করে নানা অজুহাতে চাপ দেওয়ার চেষ্টা। কতিপয় উপদেষ্টার দুর্বলতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা। রাজনৈতিক দলসমূহের সহায়তা চাইলেও তাদেরকে খুব কাছাকাছি না রাখা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে দালালশ্রেণি ঢুকে বীরদের অর্জন মলিন করার চেষ্টা। গণঅভ্যুত্থানে নিহতের পরিবার ও আহতদের সুচিকিৎসার চেষ্টায় গড়িমসি। এমন আরো অনেক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে দুই মাস না হওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। এতে কিছুটা দিশেহারা হওয়ার উপক্রম অন্তর্বর্তী। কোনটা রেখে কোনটা করলে ভালো হবে, সেটাতে ঠিক না করতে পারা, সর্বোপরি উপদেষ্টা পরিষদে বিপ্লবী মাইন্ডের লোকের পরিবর্তে রিটায়ার্ট, দুর্বল, প্রশাসন পরিচালনায় অনভিজ্ঞ লোকের সমাবেশে গণঅভ্যুত্থানের যে মুড ছিল সেটা পানসে হওয়াতে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এখন নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জোরালো করছে বা সুযোগ পাচ্ছে।
গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা
গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কারখানা বন্ধ হয়ে বায়ার হারানো শুরু। ঠিক সময়ে শিপমেন্ট করতে ব্যর্থ কেউ কেউ। প্রতিদিন গাজীপুর, সাভার অঞ্চলে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ, অবস্থান কর্মসূচি পালন করায় যে গার্মেন্টসের লোকজন ওই কাজ করছে, তাতে সেটাসহ অন্য আরো শত শত কারখানার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। বড় কথা, ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার যে হাইওয়ে সেটা গুরুত্বপূর্ণ অফিস সময় বন্ধ হয়ে শিল্পাঞ্চল থেকে শুরু করে অন্যন্য কাজেও দারুণভাবে ব্যহত হচ্ছে। এ অঞ্চলে বসবাসকারী ও প্রতিনিয়ত অফিস যাতায়াতকারীদের মধ্যে ক্ষোভও বাড়ছে। বিগত সরকারের সময়ে গার্মেন্টস সেক্টরে প্রচুর ভারতীয় কাজ করেছেন। তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে চলে গেছে। কিছু কিছু এখনো রয়ে গেছেন। তবে কারা এ সেক্টরে অশান্তি তৈরি করে এর সুফল তুলতে চায়, তা কারো অজানা নয়। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকরা এর শিকার। অন্তর্বর্তী সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে, কারখানা বন্ধ হলে দেশ ও শ্রমিক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কিন্তু সেটাতে কান নেই। ইতিমধ্যে ১৮ দফার একটা দাবিনামা পেশ করা হয়েছে। যার অনেকটাই বাস্তবায়ন করা দুরূহ!
পাহাড়ে অশান্তি
যে তুচ্ছ ঘটনায় দুই গ্রুপের মধ্যে ঝামেলা তৈরি হয়েছিল, সেটা সাধারণই ছিল। কিন্তু এটাকে পরিকল্পিতভাবে তিল থেকে তাল করে এখন গোটা পার্বত্য অঞ্চলে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের আগ থেকেই পাহাড়ি জনবসতির একাংশ পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্য দাবি তুলে আসছে। এবার তারা এটাতে পাল তুলে দিতে সক্ষম হয়েছে। এসব অশান্তি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের অনেকটাই নিষ্ক্রিয়তায় সেনাসদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু পাহাড়ের আন্দোলনকারীরা জানেন, সেনাসদস্যরা ভয় দেখাবেন, গুলি ছুড়বেন না। তাই সেনাদের ভয় পাচ্ছে না। কোথাও কোথাও তারা দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের পাল্টা হুমকি ও তাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। কেন এটা তারা করছেন তা কারো বোঝার বাকি নেই। কিন্তু ধৈর্যধারণ করে চলছে প্রশাসন সেনাসদস্যরা। কিন্তু কত দিন এমনটা চলবে। ইতিমধ্যে পাহাড় সমস্যা নিয়েও সমতলে শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলার চেষ্টা করছেন ভিন্ন দেশের ইন্ধনে এসব হচ্ছে পাহাড়ে। এটাকে শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
প্রশাসনে অস্থিরতা
১৬ বছরে তিলে তিলে কয়েক স্তরবিশিষ্ট প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিলেন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পক্ষান্তরে নিরপেক্ষ বা ভিন্নমতের যেসব প্রশাসনিক ক্যাডার তাদের দূরেই শুধু নয়, বহু দূরে ঠেলে হয়তো ধুকে ধুকে শেষ হওয়া বা বাধ্যতামূলক অবসর, ওএসডি, প্রমোশন না দেওয়া ছিল নিত্য ঘটনা। তাদের অবজ্ঞা করে জুনিয়রদের তাকে ডিঙিয়ে সিনিয়র করে অপদস্তকরণ ছিল নিত্য ঘটনা। এতে একপেশে একটা প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন নিখুঁতভাবে।
সাজানোটা এমনভাবে ছিল যে, কখনো যেন প্রশাসন নিয়ে তাকে দুশ্চিন্তার ছিটাফোঁটাও করতে না হয়। বহু চিন্তা ও গবেষণার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন তিনি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার এসে প্রশাসন থেকে আওয়ামী মুক্ত বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ভাষায় স্বৈরাচার দোসরমুক্ত করতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সব ভেস্তে যেতে বসেছে। একজন বাদ দিয়ে অন্যজন সে স্থানে আনার জন্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। দিনশেষে দেখা যায়, তিনিও ওই আগের সরকারের সুফলভোগী। ফলে স্বাভাবিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার যা চাইছে বা চাইবে সে আশা পূরণ হচ্ছে না। সমস্যার মূল এখানে।
দেশ মূলত পরিচালিত হয় দুটি স্থান থেকে। প্রধানমন্ত্রী বা তার কার্যালয়, আরেকটি সচিবালয়। প্রধানমন্ত্রীর স্থানে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নিয়েছেন। কারণ এটা অলমোস্ট একক এক পদ। কিন্তু বাংলাদেশ সচিবালয় হলো প্রশাসনের হাজারো স্থানে কাজ করা আমলা বা কর্মচারীদের স্থান। এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে নিয়োগ দান ডেকে পাঠানোর কাজ করতে হয়। ফলে এ স্থান চাইলেই কী মুহূর্তে ঠিক করে ফেলা সম্ভব? প্রফেসর ইউনূসকে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে এ সেক্টরের নিজের পছন্দের লোক খুঁজে পেতে। সঠিক কাজ পেতে।
তার সরকারের সূচনায় আরেকটা বড় ধাক্কা দিয়েছেন, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। জামায়াতের এ আমির বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে সাজানো স্থানগুলোর ৮০ শতাংশ বিএনপি দখল করে নিয়েছে। বাকি রয়েছে ২০ ভাগ। ড. শফিকের এ কথার একটা প্রভাব অন্তর্বর্তী সরকারে পড়েছে। ফলে অনেক স্থানে নিরপেক্ষ লোক খুঁজতে গিয়ে দীর্ঘদিন বঞ্চিত বা বিএনপিপন্থীদের এড়াতে কোথাও কোথাও জামায়াতপন্থী, কোথাও কিছুটা নিরপেক্ষ, কিন্তু আওয়ামী সুফলভোগীদের চেয়ারে বসাচ্ছেন। এতে করে বড় ধরনের একটা সমস্যার সম্মুখীন অন্তর্বর্তী। কারণ আওয়ামীপন্থীরা কখনো ছাত্র-জনতার বিজয়ী অন্তর্বর্তী সরকারকে মণেপ্রাণে সাপোর্ট দেবেন না এটাই বাস্তব এবং ক্রমশই তারা চাইবেন, যাতে অন্তর্বর্তী অক্ষম হয়, অযোগ্যতা প্রকাশ পায়।
পুলিশে ফেরেনি আস্থা
দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের প্রধান কাজ পুলিশ বাহিনীর। কিন্তু এ সেক্টরে এখনো আস্থা ফেরানো যায়। বহু কর্মকর্তা কাজে যোগ দেননি। দেবেন কি না সেটাও জানে না সরকার। কিন্তু দেশে থেকে এসব কর্মকর্তা নানাভাবে প্রতিহিংসার আগুন ছড়াতে ছাড়ছেন না সাধারণ সদস্যদের মধ্যে। ফলে অনেক দেশপ্রেমিক পুলিশ সদস্য দ্বিধাদ্বন্দ্বে। যদি হাসিনা সরকার আবার ফিরে আসে এবং এসব কর্মকর্তা যদি তাদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে লিয়াজোঁ করে ফেরেন, তাহলে তাদের অবস্থা তছনছ করে দেবেন। এ আশঙ্কায় তাদের কর্মে ধীরগতি। তাদের তৎপরতা যে গণঅভ্যুত্থান ঘটানো ছাত্র-জনতার যে গতি বা স্পিরিট বা একটা বিপ্লবী সরকারের অভিপ্রায় প্রকাশ পাবে সেটা অনুপস্থিত। অন্তর্বর্তী সরকারের বড় কাজ দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরানো। কিন্তু সেটা করবে পুলিশ সদস্যরা। সেই পুলিশ বাহিনী ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ টাইপের ভূমিকা রাখলে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমলাদের বড় একটি অংশের ইন্দন যে নেই এ সেক্টরে সেটাই-বা কে বলবে।
এক কথায়, হঠাৎ গড়ে ওঠা গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু হাসিনার প্রশাসনের সেটআপ যথারীতি বিদ্যমান। তাদের কী হবে? তাদের কীভাবে সরানো যাবে বা আদৌ কি সরানো বা মুক্ত হওয়া সম্ভব? নাকি তাদের ষড়যন্ত্র হজম করেই যেতে হবে।
আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর চ্যালেঞ্জ
এমনতিই ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার পাচার, অনেক ব্যাংক দেউলিয়া প্রায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তী কোনটা রেখে কোনদিকে নজর দেবে? ইতিমধ্যে এ সেক্টরে কিছুটা শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টায় সফলতার আভা দেখতে পাচ্ছেন সবাই। কিন্তু এখানে সফল হতেই হবে। নতুবা সব ভেস্তে যাবে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিদেশি বন্ধুদের বলছেন পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণে। তারা সেটাতে সায়ও দিচ্ছে। তবুও দেশ চালাতে, বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়নে যেসব লোন নেওয়া হয়েছে তার সুদ-আসল পরিশোধসহ নানা চ্যালেঞ্জ অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। অর্থ সংকটে শেখ হাসিনাও ছিলেন। চীনের কাছে অর্থ সহায়তা চাইতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। এরপরই তো তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু সে সংকট তো বিদ্যমান।
উপদেষ্টাদের দুর্বলতা
গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে নিরপেক্ষ লোক খুঁজতে গিয়ে যেসব উপদেষ্টাম-লী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের একজনের মধ্যেও বিপ্লবী চেতনার ছিটাফোঁটাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। একা প্রফেসর ইউনূস কয়দিকে সামাল দেবেন। সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে তৈরি হওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের যে তেজ দেখার প্রতীক্ষায় ছিল দেশের ১৮ কোটি মানুষ, তার ছিটাফোঁটাও আঁচ করা যাচ্ছে না। কাজ তারা করছেন, কিন্তু সেটা ঢিমেতালে।
প্রথম দু-একটি সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে আলাপ করে নিলেও সেটা এখন আর নেই। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, গণঅভ্যুত্থানের পরের সরকার শুধু পরিচিত মুখ নিয়ে উপদেষ্টা গঠনই নয়, উচিত ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে একটি সেল গঠন করে তাদের থেকে বুদ্ধি-পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বর্জন। এটাতে উপদেষ্টা পরিষদ আরো শক্ত ভূমিকা রাখতে সাহস ও শক্তি পেতেন। কারণ রাজনীতিবিদরা যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। ভালো-মন্দ থাকবেই। কিন্তু সবাই তো আর অর্থ ও ক্ষমতালোভী নন?
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমানোর পর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী, উপদেষ্টা সুফলভোগী, অর্থপাচারকারী থেকে শুরু করে এদের অনুসারীরা দেশে ছিলেন। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে অজ্ঞাত কারণে ধীরে চলানীতিতে অনেকে বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমিয়ে চলে গেছেন অন্য দেশে। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার ডে ওয়ান থেকে শক্ত হলে এতোদিন এদের অন্তত ৮০ জনকে আটকে দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব ছিল। এদের অনেকের বিরুদ্ধে খোদ শেখ হাসিনারও ছিল অভিযোগ। যাদের অর্থ-পিপাসা, অর্থের লোভের কারণে বহু বদনামের শিকারে পরিণত হতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারকে এবং দলটির আজকের পরিণতির জন্যও সমান দায়ী। ফলে এদের আটক করে বিচারের আওতায় এনে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিচার করলে অন্তর্বর্তীর গ্রহণযোগ্যতা আরো বৃদ্ধি পেতো।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছুটা মিল রয়েছে। শেখ হাসিনা ছাড়া, শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত ছাড়া বিশাল মন্ত্রীবর্গের মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না কেউ। এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে মনে হচ্ছে, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ইঙ্গিত ছাড়া একা একা কোনো উপদেষ্টাই একক সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তীর ধীরে চলা নীতির অন্যতম কারণ এমনটা বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
অবশ্য এর কারণও রয়েছে। উপদেষ্টাদের বেশির ভাগ রিটায়ার্ট বা ওই বয়সের। তাছাড়া প্রশাসনিক পরিচালনা করার সম্যক ধারণা বা গ্রহণযোগ্যতা কোনো এক সময় থাকলেও এখন সেটা হ্রাস পেয়েছে। এতে করে এরা প্রায়সময় ভোগেন সিদ্ধান্তহীনতায়।
তাছাড়া মূল লড়াইটা তাদের শেখ হাসিনার মতো ঝানু এক পলিটিশিয়ানের বিরুদ্ধে। তার দীর্ঘ ১৫ বছরের সেট করা একটি প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ফলে কিছুটা ভয় তাদের পেতেই হচ্ছে। এতে করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাতপাঁচ ভাবতে হয় এবং যেটা তারা নেবেন, তা সবাই মিলে ইউনূসের নেতৃত্ব দেওয়া টেবিলের পাস করে তবেই।
এটাও অন্তর্বর্তী সরকারের যে বিপ্লবী এক ভাব হওয়ার কথা, যেটা প্রতিনিয়ত প্রকাশ করে যাচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ সে দুঃসাহস তারা দেখাতে ব্যর্থ। ওয়ান-ইলেভেনে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের নেতৃত্ব দেওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে তুলনা করলে প্রথম প্রায় দেড় মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ঢের পিছিয়ে। মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা এমন ত্রাস তৈরি করেছিলেন, যাতে করে রাজনীতিবিদ, অসাধু ব্যবসায়ীরা যে যার অবস্থানে আর ফিরবেন না বলে দিনে অন্তত ৩০ বার কমিটমেন্ট করে তওবা করতেন। রাজনীতিবিদরা বলতেন, ‘আমরা আর রাজনীতি করবো না। ব্যবসায়ীরা বলতেন আর ব্যবসা করবো না সব ছেড়ে দেবো। জান নিয়ে বাঁচতে চাই।’
অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সচিবালয়ে পদোন্নতি, ডিসি হওয়া নিয়ে হাতাহাতি, মিছিল করার মতো লজ্জাজনক দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। পতন হওয়া দল আওয়ামী লীগের নেতারা একটু দম দিয়ে রয়েছেন, শুধু তাদের বিরুদ্ধে একের পর হত্যা মামলা রুজু হওয়ার জন্য। অন্যরা চুপ, তাদের বিরুদ্ধেও যদি হত্যা মামলা হয় সে ভয়ে। কারণ সহস্রাধিক নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপট তো তৈরি। তবে এ ভয় কত দিন থাকবে তাদের, এটা এখন বড় প্রশ্ন। দিনদিন প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকা-ে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতায় ক্রমশ সাহস জোগাচ্ছে আওয়ামী নেতাদের একটু-আধটু নড়াচড়া করার।
সবশেষ
একটা দেশ পরিচালনায় অনেকগুলো সেক্টর। কিন্তু পরিচালনাকারীরা কঠোর না হলে দুর্বলতার সুযোগে বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের অনিয়মে জড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক। দেশ ও দশের সুবিধার্থে প্রশাসন শক্তিশালী ও অ্যাটাকিং মুড হলে সর্বস্তরে ভয় বিরাজ করলে সুফল আদায় করা সম্ভব। বাংলাদেশের মানুষের চাহিদার শেষ নেই। তাদের কাছে ভালোরও শেষ নেই। ফলে বিগত সরকার যেভাবে পরিচালনা করে গেছেন, সেখান থেকে মুক্তি পেতে যারা মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং আন্দোলনে বিভিন্নভাবে শরিক হয়েছিলেন, কয়দিনের ব্যবধানে তাদের মুখে অন্যরকম কথাবার্তা শুরু। নতুন সরকারকে সময় দিতে হবে। সংস্কারের জন্য আসা অন্তর্বর্তীকে সুযোগ ও সহযোগিতা দিলে রাজনৈতিক দলসমূহ বিভিন্ন দেশ-বিদেশের চাপে যেসব কর্ম করার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয় সেগুলো এ অন্তর্বর্তী করে দিয়ে গেলে সেটা দেশ ও জনগণেরই লাভ। মনে রাখা উচিত, অন্তর্বর্তী সরকার তো অন্তর্বর্তীকালের জন্য। অনন্তকাল থাকতে আসেনি তারা বা তাদের সে মনমানসিকতা ও ধৈর্যও নেই। ফলে অভিজ্ঞ এ উপদেষ্টাদের সুচিন্তিত মত ও চিন্তাধারার সুফল পেতে সাধারণ মানুষকেও সহায়তার প্রয়োজন। তা না হলে আবারও স্বৈরাচার ফিরে এলে তখন আর পেছনের কার্যাদির জন্য আফসোস করে লাভ হবে না। কারণ গণঅভ্যুত্থান কিন্তু বারবার হয় না।