১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০১:৪১:৫২ পূর্বাহ্ন


প্রশাসনের দুর্বলতা সংকট বাড়াচ্ছে
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-১০-২০২৪
প্রশাসনের দুর্বলতা সংকট বাড়াচ্ছে সচিবালয় ভবন


সড়কে মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। কারণ-অকারণে যানজটের কবলে নগরবাসী। শিল্পাঙ্গনে অস্থিরতা, বাজারেও ঊর্ধ্বগতি বাড়ছে। ক্ষোভ বিরাজমান জ্বালানি কোম্পানিগুলোতে সঙ্গে জ্বালানি সংকট অব্যাহত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে আহত-নিহতদের বেশির ভাগ পরিবার এখনো অস্বস্তিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি দমন সংস্থা, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনে গতি আসেনি, ক্রীড়াঙ্গন অনেকটা স্থবির। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৬০ দিন অতিবাহিত। ১৫ বছরের ভেঙেপড়া সবকিছু গুছিয়ে গতি ফিরিয়ে আনার অনেক চ্যালেঞ্জ। আর্থিক ক্ষেত্র, ব্যাংক-বীমা ধীরে ধীরে ব্যবসা বিনিয়োগ সহায়ক হয়ে উঠছে। কিন্তু শুল্ক ব্যবস্থাপনা, পোর্ট ফ্যাসিলিটিজ, সড়ক, রেল পরিবহন, জ্বালানি নিরাপত্তা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগ নানা প্রতিবন্ধিকতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংকট বাড়াচ্ছে। 

সরকারের বিভিন্ন স্তরে পূর্ববর্তী সরকারের সুবিধাভোগীরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। পরিবর্তনের উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করছে। একশ্রেণির জনগোষ্ঠীর মনে ধারণা আন্দোলন করলেই সবকিছু আদায় হবে। তাই সরকারি কাজে গতিশীলতা ফিরে আসেনি। দেশি-বিদেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে বিরাজমান হতাশা। ৬০ দিন হয়তো খুব বেশি সময় নয়। তবে একেবারে কম বলা যাবে না। পৃথিবী কিন্তু থেমে নেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হলে শিল্পাঞ্চলে দ্রুত স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। গাজীপুর, আশুলিয়া এলাকায় শিল্পগুলো এমনিতেই জ্বালানি-বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ জানেই না শ্রমিক অসন্তোষের কারণ। তাহলে এদের বোঝানোর দায়িত্বটা কার? কিছু মানুষ অশুভ শক্তির ইন্ধনের কথা বলেছে। শ্রমিকদের অধিকাংশ দাবি মেনে নেওয়ার পরও কেন অসন্তোষ? এই ধারা অক্ষত থাকলে বাংলাদেশি পণ্য অনতিবিলম্বে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ হারাবে। জাতীয় স্বার্থেই সব সংশ্লিষ্ট মহল দ্রুত পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়তা প্রত্যাশায়। 

জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর যেই না সামিট এনার্জি মালিকানাধীন ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চালু হলো স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয়ের প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সংকট কিছু দিনের জন্য বেড়েছিল। যাহোক সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দুটি কার্গো ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অচিরেই ৫০০ মিলিয়ন আর এলএনজি যোগ হবে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে। ৩০০০-৩১০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সঞ্চালন হলে কিছুটা স্বস্তি আসবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে, শিল্পে। গভীর রাতে পেট্রল পাম্পগুলোতে সারি সারি কাভার্ড ভ্যান দাঁড়িয়ে থেকে সিএনজি সংগ্রহ করছে। এগুলো জ্বালানি সংকটে থাকা শিল্পকারখানাগুলো ব্যবহার করে। সিএনজিচালিত গাড়ি চালকরা অভিযোগ করেছে তারা নির্ধারিত সময়েও সঠিক মোট সিএনজি পাচ্ছে না। এগুলো দেখার কেউ নেই। সরকার অপরিকল্পিতভাবে ভোলা গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস সিএনজি করে ঢাকায় আনার একটি প্রকল্প স্থগিত করেছে। গ্যাস উৎপাদনে বড় উৎকণ্ঠার কারণ ১ হাজার এমএমসিএডি উৎপাদনকারী শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনে ক্রমহ্রাসমান ধারা দেখে। জাতীয় গ্যাস উৎপাদনে ৫০ শতাংশের অধিক জোগানদানকারী এই গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন দ্রুত কমে গেলে মহাসংকট হতে পারে। অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্র বা সর্বোচ্চ পরিমাণ এলএনজি আমদানি করেও সেই মহাসংকট সামাল দেওয়া যাবে না। সরকার গৃহীত ৪৮ কূপ অথবা ১০০ গ্যাস কূপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পেট্রোবাংলা সফল হবে বলে নিশ্চয়তা নেই। পেট্রোবাংলার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে কয়েকটি কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বিনষ্ট হয়েছে। অচিরেই শীর্ষ ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রয়োজনের খাতিরে কিছু প্রকল্প যেমন মহেশখালীর তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল, ভোলা থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ, মহেশখালী থেকে তৃতীয় সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণ, মাতারবাড়ীতে ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিসমূহে বিরাজমান বৈষম্যগুলো দ্রুত দূর করা প্রয়োজন। সরকার কাজ করছে কিন্তু সেখানেও গতিহীনতা। জ্বালানি নিশ্চয়তা বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি বিদ্যুৎ চাহিদা অপেক্ষাকৃত কম থাকবে। এই সময়ে জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যবহারে কৃচ্ছ্রতা পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে। খুঁজতে হবে সাগর থেকে নির্মিত এসপিএম প্রকল্প কেন পুরোমাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে না? কি অবস্থা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত নির্মাণাধীন তরল জ্বালানি বহনকারী পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের। অনেকের ধারণা সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্মাণাধীন প্রকল্পে অনেক দুর্নীতি হয়েছে। জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের কর্মকা- নিয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। অচিরেই কিছু ব্যবস্থা গৃহীত হবে বলে আশা করা যেতে পারে।

সরকারকে মেট্রোরেল চলাচল দ্রুত স্বাভাবিক করায় সাধুবাদ। স্বল্প খরচে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনগুলো দ্রুত কার্যক্ষম করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রশংসার দাবিদার। সরকার দ্রুত মেট্রো সুবিধা সম্প্রসারিত করলে জনগণ উপকৃত হবে। আরো অন্তত দুই জোড়া মেট্রোরেল যোগ করা যায় কি না ভেবে যেতে পারে। একই সঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসের অবশিষ্ট কাজ কীভাবে দ্রুত শেষ করা যায় বিবেচনা করতে হবে। গাজীপুর থেকে মদনপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন ঢাকা বাইপাসের কাজ, আশুলিয়া-টাঙ্গাইল রোড এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ হওয়া প্রয়োজন। দেখলাম, যমুনা রেলসেতু এবং গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে, ডিসেম্বর ২০২৪ নাগাদ গ্যাস পাইপলাইনসহ রেলসেতু চালু হলে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে। সিরাজগঞ্জে চালু এনডব্লিউপিজিসিএলের গ্যাসভিত্তিক চারটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করলাম। কেন্দ্রগুলো গ্যাস সংকটে ভুগছে। অত্যাধুনিক এ কেন্দ্রগুলোকে চাহিদামাফিক কীভাবে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় সেটি বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার বিষয়ে অনেক আন্তরিক। সবক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার সম্পাদনের জন্য সরকার প্রশাসনে নির্মোহ থেকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে। পূর্ববর্তী সময়ে সুবিধাভোগী কর্মরতদের বহাল রেখে রেখে সেই কাজগুলো করা সহজ হবে না। পরিকল্পিতভাবে কাজগুলো দ্রুত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আগ্রহী প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের সহায়তা কামনা করা যেতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও সতর্কতা প্রয়োজন।

শেয়ার করুন