মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন আইনপ্রয়োগের ইতিহাস বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের নীতিমালা এবং সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। ১৮৯২ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অভিবাসন নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল অভিবাসীদের বহিষ্কার। প্রায়ই রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলনে বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের অধীনে এই বহিষ্কারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। মার্কিন ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিবাসী বহিষ্কার করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যিনি তার আট বছরের মেয়াদে ৩০ লাখ ৬৬ হাজার ৪৫৭ জন অভিবাসীকে বহিষ্কার করেন। তার পরই রয়েছেন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, যিনি তার মেয়াদে ২০ লাখ ১২ হাজর ৫৩৯ জনকে বহিষ্কার করেন। ওবামার নীতিতে অপরাধে জড়িত অভিবাসীদের ওপর জোর দেওয়া হলেও অনেক পরিবার এবং কমিউনিটি এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহিষ্কারের সংখ্যার ভিত্তিতে শীর্ষ পাঁচ প্রেসিডেন্টদের মধ্যে রয়েছেন বিল ক্লিনটন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রোনাল্ড রিগান। এ তথ্য মার্কিন অভিবাসন নীতির ক্রমবর্ধমান কঠোরতার একটি চিত্র তুলে ধরে এবং এ থেকে বোঝা যায় যে, অভিবাসন আইন প্রয়োগ কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।
জর্জ ডব্লিউ বুশ : তার সময়ে ২০ লাখ ১২ হাজার ৫৩৯ জন অভিবাসী বহিষ্কার করা হয়। তার প্রশাসন সীমান্ত নিরাপত্তা এবং অভিবাসন আইন কঠোর করার দিকে জোর দেয়।
বিল ক্লিনটন : আট বছরের মেয়াদে তিনি ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৬৪৬ জন অভিবাসী বহিষ্কার করেন। ১৯৯৬ সালের ‘ইলিগ্যাল ইমিগ্রেশন রিফর্ম অ্যান্ড ইমিগ্র্যান্ট রেসপন্সিবিলিটি অ্যাক্ট’-এর ফলে বহিষ্কারের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প : চার বছরে তার প্রশাসন ৫ লাখ ৫১ হাজার ৪৪৯ জন অভিবাসীকে বহিষ্কার করেন। তার কঠোর অভিবাসন নীতি বহিষ্কারের ক্ষেত্রে দ্রুততা নিয়ে আসে।
রোনাল্ড রিগান : আট বছরের মেয়াদে তিনি ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৪ জন অভিবাসী বহিষ্কার করেন। যদিও এই সংখ্যা পরবর্তী প্রশাসনের তুলনায় কম, তবে তা তার সময়ের অভিবাসন নীতির একটি প্রতিফলন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতি সব সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে। বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের সময় অভিবাসন আইনপ্রয়োগের হার এবং বহিষ্কারের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ১৮৯২ সালে বহিষ্কারের ডেটা সংরক্ষণ শুরু হলে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেঞ্জামিন হ্যারিসন (রিপাবলিকান) এক বছরে মাত্র ২ হাজার ৮০১ জন মানুষকে বহিষ্কার করেন। এরপর গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের (ডেমোক্র্যাট) সময় চার বছরে মোট ৯ হাজার ৬৯ জন মানুষ বহিষ্কৃত হয়, যার বার্ষিক গড় ছিল ২ হাজার ২৬৭ জন। ঊনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের শুরুতে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলে ১৭ হাজার ৬৪২ জন এবং থিওডোর রুজভেল্ট ৭৬ হাজার ৩৯০ জন মানুষকে বহিষ্কার করেন। বিশেষত, উইলিয়াম এইচ টাফটের সময় বহিষ্কারের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে বার্ষিক গড় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৭৮৮ জন।
ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের প্রশাসন আট বছরে ১ লাখ ৬২ হাজার ৩৭১ জন মানুষকে বহিষ্কার করে, যার বার্ষিক গড় ছিল ২০ হাজার ২৯৬ জন। এরপর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ওয়ারেন হার্ডিং তিন বছরে ৬০ হাজার ৬৫২ জনকে এবং ক্যালভিন কুলিজ পাঁচ বছরে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯১৩ জনকে বহিষ্কার করেন। কুলিজের বার্ষিক গড় বহিষ্কার ছিল ৩২ হাজার ৯৮৩ জন, যা ওই সময়ে সর্বোচ্চ।
১৯৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক মন্দার সময় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারের চার বছরে ১ লাখ ১০ হাজার ২৭৫ জন মানুষ বহিষ্কৃত হন। ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, যিনি ১৩ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তার সময় মোট ১ লাখ ৭১ হাজার ৯৩৯ জন মানুষকে বহিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে হ্যারি এস. ট্রুম্যানের (ডেমোক্র্যাট) সময় সাত বছরে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৫৩ জন মানুষকে বহিষ্কার করা হয়।
ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার (রিপাবলিকান) আট বছরে ১ লাখ ১০ হাজার ১৯ জন মানুষ বহিষ্কার করেন, যার বার্ষিক গড় ছিল ১৩ হাজার ৭৫২ জন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি (ডেমোক্র্যাট) তার তিন বছরের মেয়াদে ২৩ হাজার ৯৬৯ জন মানুষ বহিষ্কার করেন। লিন্ডন বি জনসনের (ডেমোক্র্যাট) পাঁচ বছরে ৪৮ হাজার ৭৩৭ জন বহিষ্কৃত হন।
১৯৭০-এর দশকে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাঁচ বছরে ৮১ হাজার ২২ জন এবং জেরাল্ড ফোর্ড তিন বছরে ৮২ হাজার ৩১৬ জন মানুষকে বহিষ্কার করেন। জিমি কার্টারের (ডেমোক্র্যাট) চার বছরের মেয়াদে ১ লাখ ৫ হাজার ৩৭৮ জন মানুষ বহিষ্কার হন। এরপর রোনাল্ড রিগানের (রিপাবলিকান) আট বছরের প্রশাসনে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৪ জন মানুষ বহিষ্কৃত হন।
১৯৯০-এর দশকে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ চার বছরে ১ লাখ ৪১ হাজার ৩২৬ জন মানুষকে বহিষ্কার করেন, যার বার্ষিক গড় ছিল ৩৫ হাজার ৩৩২ জন। তার পরবর্তী ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের আট বছরের মেয়াদে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৬৪৬ জন মানুষ বহিষ্কার হন, যা প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮ হাজার ৭০৬ জন।
২০০০ সালের পর অভিবাসীদের বহিষ্কারের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তার আট বছরের মেয়াদে ২০ লাখ ১২ হাজার ৫৩৯ জন মানুষকে বহিষ্কার করেন, যার বার্ষিক গড় ছিল ২ লাখ ৫১ হাজার ৫৬৭ জন। তবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় (ডেমোক্র্যাট) বহিষ্কারের সংখ্যা সর্বোচ্চ রেকর্ড ছোঁয়। তার আট বছরের প্রশাসনে ৩০ লাখ ৬৬ হাজার ৪৫৭ জন মানুষ বহিষ্কার হন, যা প্রতি বছর গড়ে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩০৭ জন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের (রিপাবলিকান) প্রশাসনের প্রথম দুই বছরে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৪৪৯ জন মানুষ বহিষ্কার হন, যার বার্ষিক গড় ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭২৫ জন। যদিও ট্রাম্প অভিবাসন নীতিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন, তবে তার প্রশাসন বারাক ওবামার বহিষ্কারের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট উভয়েই তাদের সময়ে অভিবাসন নীতি প্রয়োগে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে বারাক ওবামার প্রশাসনের বহিষ্কারের সংখ্যা অভিবাসন নীতির কঠোরতার একটি নজির হয়ে থাকবে। অভিবাসন ব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় রয়েছে, যা মানবিক দৃষ্টিকোণ এবং কার্যকর নীতিমালা উভয়ই বিবেচনা করতে আহ্বান জানায়।
আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণবহিষ্কার অভিযান: অপারেশন ‘ওয়েটব্যাক’
১৯৫০-এর দশকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনথিভুক্ত মেক্সিকান অভিবাসীদের ওপর পরিচালিত হয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণবহিষ্কার অভিযান, যার নাম ছিল ‘অপারেশন ওয়েটব্যাক’। প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার শাসনামলে চালু হওয়া এই অভিযানে প্রায় ১৩ লাখ মানুষকে তাদের জীবন ও কাজ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মেক্সিকোতে ফেলে আসা হয়। যদিও এই সংখ্যাটি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে, অনেকেই বলছেন প্রকৃত সংখ্যা ৩ লাখের কাছাকাছি হতে পারে। ১৯৪২ সাল থেকে শুরু হওয়া ব্রাসেরো প্রোগ্রাম-যেখানে মেক্সিকোর শ্রমিকরা বৈধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পার- এর মাধ্যমে প্রচুর মেক্সিকান কর্মী দেশটিতে প্রবেশ করেছিলেন। তবে এর বাইরেও হাজার হাজার অনথিভুক্ত অভিবাসী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাজ খুঁজে নিচ্ছিলেন।
কিন্তু ১৯৫৩ সালের দিকে মার্কিন সরকার এই অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দক্ষিণ টেক্সাসের কৃষকরা ব্রাসেরো প্রোগ্রাম এ অংশ না নিয়ে, নিয়ম বহির্ভূতভাবে কম বেতনে অভিবাসীদের কাজ করাচ্ছিলেন। এ নিয়ে বর্ডার পেট্রোলের প্রধান হারলন বি. কার্টার প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে বললেন, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের অভিযান চালানো প্রয়োজন। ১৯৫৪ সালে ‘অপারেশন ওয়েটব্যাক’ শুরু হয়। এই অভিযানে সামরিক কৌশল ও প্রোপাগান্ডা ব্যবহার করে সীমান্ত পেট্রোল বাহিনী ও স্থানীয় কর্মকর্তারা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। তারা কারখানা, কৃষিক্ষেত্র এবং অন্যান্য কর্মস্থলে অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার অভিবাসীকে ধরে নিয়ে যায়।
অভিযানের নৃশংসতা
অভিযানের সময়, অভিবাসীদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষকে বাস, নৌকা এবং প্লেনে করে এমন মেক্সিকান অঞ্চলে পাঠানো হয়, যেখানে তাদের কোনো পরিচিত জন ছিল না। অনেকেই এই অজানা অঞ্চলে নিজেদের জীবন নতুন করে শুরু করতে হিমশিম খেয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে, অভিবাসীদের এমন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যেখানে পরিবেশ ছিল চরম প্রতিকূল। টেক্সাসে, অভিবাসীদের একটি বড় অংশকে জাহাজে গাদাগাদি করে পাঠানো হয়, যা পরে ‘দাস জাহাজের’ সাথে তুলনা করা হয়। অনেকেই হিটস্ট্রোক, রোগ এবং অন্যান্য কারণে মৃত্যুবরণ করেন। বর্ণবাদ ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন ‘অপারেশন ওয়েটব্যাক’ একটি বর্ণবাদী উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত। মেক্সিকান অভিবাসীদের প্রতি তৎকালীন মার্কিন সমাজের মনোভাব ছিল অত্যন্ত নেতিবাচক। তাদের ‘নোংরা’, ‘রোগবাহী’, এবং ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হিসেবে চিত্রিত করা হতো। এই অভিযানে শুধু অনথিভুক্ত অভিবাসী নয়, অনেক মার্কিন নাগরিককেও অবৈধভাবে মেক্সিকোতে পাঠানো হয়েছিল। এটা ছিল মানবাধিকারের একটি বড় ধরনের লঙ্ঘন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মেক্সিকান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের পদক্ষেপ নতুন কিছু ছিল না। ১৯৩০-এর মহামন্দার সময়ও, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৮ লাখ মেক্সিকানকে, যাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই মার্কিন নাগরিক, দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে ব্রাসেরো প্রোগ্রামের অধীনে ১৯৪২ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে প্রায় ৪৬ লাখ মেক্সিকান শ্রমিক বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করেছিলেন। তবুও অনথিভুক্ত অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং কঠোর আইন প্রয়োগ অভিবাসন সমস্যা আরো জটিল করে তোলে।
‘অপারেশন ওয়েটব্যাক’ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। এটি শুধু অনথিভুক্ত অভিবাসীদের উপরই নয়, মার্কিন মুলুকে বসবাসরত লাতিনো সম্প্রদায়ের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই অভিযান থেকে বোঝা যায়, কীভাবে বর্ণবাদ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য মানবাধিকারের লঙ্ঘন করা হয়েছে।