১০০ দিন সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনা ও কাজে সমন্বয়ের অভাব দৃশ্যমান। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের সাড়ে পনেরো বছরের অবসানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন অনির্বাচিত সরকার ১০০ দিন সময়ে নানা সেক্টরে বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। কিন্তু ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপর্যস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যায়ে হোঁচট খাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভালো উদ্যোগগুলো সাফল্য অর্জন করবে বলে মনে হয় না।
বন, পরিবেশ মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ বিশেষভাবে সাড়া জাগিয়েছে। পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগগুলো নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে সন্দেহ নেই. প্রথমেই বলবো পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং নিষিদ্ধকরণ। সমন্বিত প্রয়াস নিয়ে পরিবেশসম্মত বিকল্প দ্রব্য সুলভ মূল্যে সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে এবং ব্যবহার নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হলে উদ্যোগটি পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে শুভ প্রভাব সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে অংশীজনদের অংশগ্রহণে ব্যাপক জনসচেতনতার অভাব আছে। কিশোর-যুবকদের সম্পৃক্ত করে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হলে ৬-১২ মাসের মধ্যে পলিথিন ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করি। পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার ঢাকাসহ নগর শহরগুলোর জলাবদ্ধতা, নদী-খাল ভরাট হওয়াসহ পরিবেশদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অন্য ভালো উদ্যোগ হলো প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শিথিলতার কারণে বিশেষত অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। বন পরিবেশ মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর হঠাৎ করে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করায় বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দ্বীপটির ভৌগোলিক অবস্থান স্পর্শকাতর অবস্থানে। নাফ নদের অন্যপাশে সংঘাত বিক্ষুব্ধ মায়ানমার। বাস্তুচ্যুত হয়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এসেছে কক্সবাজারে। প্রবাল দ্বীপটিতে পর্যটনভিত্তিতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হয়েছে। স্থানীয় কিছু জনগোষ্ঠী বিশেষত জেলে সম্প্রদায় এবং ইতিপূর্বে যারা ড্রাগে জড়িত ছিল, তাদের একটা বিশাল অংশের জীবন-জীবিকা দ্বীপের পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। সন্দেহ নেই অপরিকল্পিত পর্যটন প্রবাল এবং মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে পর্যটন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উপার্জন প্রতিরক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা না করে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং নিষিদ্ধকরণ অবিলম্বে কার্যকর করায় কিছু অশুভ সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি, এক্ষেত্রেও সব অংশীজনের সক্রিয় সংযুক্তির মাধ্যমে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
লক্ষ করেছি, পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা শহর থেকে জরাজীর্ণ বাস এবং পরিবহনসমূহ অপসারণের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সবাই জানে ঢাকা মহানগরীর অসহনীয় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ অসংখ জরাজীর্ণ বাস, ট্রাক, হিউম্যান হলার। পর্যাপ্ত সংখ্যক আধুনিক বাস এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সংস্থান করে জরাজীর্ণ যানবাহনগুলো পর্যায়ক্রমে ৬-১২ মাসের মধ্যে তুলে নেওয়া হলে যানজট নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশের বিশেষ করে বায়ুদূষণের ওপর শুভ প্রভাব পড়বে। তবে এক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মালিক সমিতিগুলোর সুসমন্বয় প্রয়োজন হবে। সরকার এক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক যানবাহনের কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভেবে দেখতে পারে। দুনিয়ার অনেক আধুনিক শহরে বৈদ্যুতিক যানবাহন আসছে। বাংলাদেশে অবশ্য এই ধরনের যানবাহন এসেছে পেছনের দরজা দিয়ে। অসংখ্য থ্রি হুইলার চলছে ব্যাটারি ব্যবহার করে ঢাকাসহ সারা দেশে। এগুলো অবৈধভাবে বিদ্যুৎ গ্রহণ করছে। যানজট সৃষ্টি, তথা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ তিন চাকার বাহন বিশেষত রিকশা নিষিদ্ধ করার এই আদেশ জারি করেছে আদালত। এখানেও সমন্বয়ের বা পরিকল্পনার অভাব সুস্পষ্ট। স্মরণে রাখতে হবে, কয়েক লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এখন ব্যাটারিচালিত যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল. এদের জন্য বিকল্পব্যবস্থা নিশ্চিত না করে হঠাৎ ঘোষণায় এগুলো বন্ধ করা আদৌ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রেও সরকার সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি নিদির্ষ্ট সময়সীমার মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন থেকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে।
মনে রাখতে হবে, জনসংখ্যার একটা বিশেষ অংশের স্বার্থ জড়িত বিষয়সমূহ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এ সরকারকেই করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের নানা চ্যালেঞ্জ থাকে। তবে এই ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সব অংশীজন সরকারকে সহায়তা করতে হবে।
জানি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমাজ ঘনিষ্ঠ নানা বিষয়ের সংস্কার নিয়ে, বিশেষত দেশকে নির্বাচনমুখী করার কাজে ব্যতিব্যস্ত আছে। আছে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচল করা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। এ মুহূর্তে এমন কিছু করা সংগত হবে না যেগুলো বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।