১৪ ডিসেম্বর ২০১২, শনিবার, ০৩:৫১:০৪ পূর্বাহ্ন


প্রবাসে হিন্দু রাজাকার!
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১১-২০২৪
প্রবাসে হিন্দু রাজাকার!


বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ একটি অপমানজনক শব্দ। যার অর্থ বিশ্বাসঘাতক বা প্রতারক। কিন্তু ব্যুৎপত্তিগতভাবে একটি আরবি শব্দ। যার শাব্দিক অর্থ হল স্বেচ্ছাসেবী। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী ‘রাজাকার’ শব্দের অর্থ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা স্বেচ্ছাসেবক নামে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে সহায়তা করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা ও ক্ষতিসাধন করে।

স্বেচ্ছাসেবী অর্থের এ শব্দটি এখন ব্যবহার হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতাকারী নৃশংসতার সমার্থক একটি বাহিনী হিসেবে। বাংলাদেশের মানুষ এ নামটি এখন উচ্চারণ করেন অত‍্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল এই রাজাকার বাহিনি। রাজাকারের আরো ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় তদানীন্তন হায়দরাবাদের শাসক নিজাম ভারতভুক্ত হতে অনিচ্ছুক থাকায় ভারতের সামরিক বাহিনীতে প্রাথমিক প্রতিরোধের জন্য ‘রাজাকার’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। তিন মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দলটির এই পরিণতির জন্য নানাবিধ কারণ অনুসন্ধানের প্রয়াস পাচ্ছেন। ব্যক্তি হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক আচরণ, সরকারের কর্তৃত্ববাদিতা, গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণ, দুর্নীতি, বিরোধীদলকে রাজনীতির সুযোগ না দেওয়া, দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর লাগামহীন সন্ত্রাসের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ‘রাজাকার ফোবিয়া’কেও দাবি করেছেন।

তাদের মতে, ১৫ বছরের শাসনামলে বলতে গেলে পুরোটাই আওয়ামী লীগ এই রাজাকার ফোবিয়ায় ভুগেছে। তৃণমূল থেকে দলীয় প্রধান পর্যন্ত সবাই এতে আক্রান্ত হয়েছেন। যখনই কেউ সরকারের সমালোচনা করতে চেয়েছে, প্রায় সর্বক্ষেত্রে তাকে প্রকারান্তরে রাজাকার ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। হোক সেটা সাধারণ ছাত্রদের কোনো আন্দোলন কিংবা শ্রমিকের মজুরির দাবিতে; সবকিছুকেই তারা দেখেছে ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র’ হিসেবে। এমনকি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কথা বলতে গেলেও রাজাকার হতে হয়েছে। এমনকি অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন, তারাও যদি আওয়ামী লীগের কোনো কাজের সমালোচনা করেছেন, তাদেরও রাজাকার অভিধায় ভূষিত করতে এতোটুকু পিছপা হয়নি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি। নিয়তির নির্মম পরিহাস। আখেরে রাজাকার ফোবিয়াই ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগের বিদায়ের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ১৫ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ মনে হয় ভুলেই গিয়েছিল, অতি ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সামান্য বিরোধিতার গন্ধ পেলেই যাকে খুশি তাকে অহেতুক ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে ‘রাজাকার’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে রাজাকার শব্দটির প্রতি মানুষের যে ঘৃণাবোধ ছিল, তা দূরীভূত হতে হতে ফিকে হয়ে গেছে।

২০১৮ সালে যুক্তিসংগত মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের দাবি উড়িয়ে দিয়ে রাজপথের রাজাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ট্যাগ দিয়েছিলেন প্রজাতন্ত্রের একজন মন্ত্রী। ২০২৪ সালে সেই একই দাবি তোলা ছাত্রছাত্রীর গায়ে একই ট্যাগ লাগাতে চেয়েছিলেন খোদ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী। অনেক ‘বাচ্চা’ জানে, তার বাবা রাজাকার ছিলেন না, শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যুক্তিসংগত প্রশ্ন তোলায় তাকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ গালি খেতে হলো। আমরা এক সাবেক বিচারপতিকে লাইভ টকশোতে ‘দেশে ৪ কোটি রাজাকারের বাচ্চা আছে’ বলে উচ্চস্বরে আচ্ছামতো চেঁচাতে শুনেছি এবং তাকে সে অনুষ্ঠানেই সঞ্চালক তরণীটিকে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিতে দেখেছি।

এতোক্ষণ রাজাকার প্রসঙ্গটা টানলাম বিশেষ একটি কারণে। সম্প্রতি নিউইয়র্কের একজন সিনিয়র সাংবাদিক নিজেই নিজেকে ‘রাজাকার’ উপাধি দিয়েছেন। এটা তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হলেও তাই এ বক্তব‍্যটি ভাইরাল হয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক রতন তালুকদার এক অনুষ্ঠানে নিজেকে রাজাকার বলে দাবি করেছেন। গত ১৯ নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে টাইম টিভির এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, গত ৫ আগস্ট আমি জ‍্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলাম, বাংলাদেশে আন্দোলনরত ছাত্রদের নির্বিচারে হত‍্যা করা হচ্ছে। আমি এর প্রতিবাদ জানাই। যদি এজন‍্য আমাকে রাজাকার বলা হয়, তাহলে আমি তাই। আওয়ামী লীগ না করলে যদি রাজাকার হয়, তাহলে আমি রাজাকার। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কথা বললে যদি রাজাকার হয়, আমি তাই। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালা নই। আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বললে বা আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাংবাদিক। তা না হলে হতে হয় রাজাকার। যদি তাই হয়, তাহলে আমি রাজাকার সাংবাদিক। শেখ হাসিনা শত শত মানুষ হত‍্যা করেছে, আমি তার বিচার চাই। তিনি আরো বলেন, হিন্দু মন্দিরে প্রথম হামলা হয় ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবের শাসনামলে। তারপর প্রতিটি সরকারের আমলে তা ধারাবাহিকভাবে হয়েছে। আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় পরে তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। জামাতে ইসলামী কোনো হিন্দুদের মন্দিরে হামলা করেনি। তারা কোনো ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত নয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ফেরিওয়ালা নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক নয়, তারা মুক্তি চেতনার লাইসেন্স বিক্রি করেছে। এসব বললে যদি আমি রাজাকার হই, তাহলে আমি রাজাকার। তার এ ধারালো বক্তৃতা ভাইরাল হয় এবং অনেকের নজর কাড়ে। তার এই স্পষ্টবাদিতার জন‍্য অনেকে তাকে অভিনন্দন জানান।

নতুন পত্রিকা ‘প্রজ্ঞা’

গত সপ্তাহে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে আরো একটি পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ‘প্রজ্ঞা’ নামের বৃহৎ কলেবরের এ সাপ্তাহিকীটির প্রথম সংখ‍্যার পৃষ্ঠা সংখ‍্যা ১১২। এতো বড় এই পত্রিকায় কমিউনিটির কোনো খবরাখবর না থাকায় অনেকেই আশাহত হয়েছেন। এ ডিজিটাল যুগে বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে ভেসে না গিয়ে ‘প্রজ্ঞা’ মেরুদ- সোজা রেখে সত্য ও উৎকর্ষের সন্ধানে ব্রতী হবে, সমাজ ও সাধারণ মানুষের প্রতি দ্বায়বদ্ধ হবে অনেকের সঙ্গে আমরাও তা আশা করবো। প্রবাসের ১৫-১৬টি নিয়মিত অনিয়মিত পত্রিকার মিছিলে প্রজ্ঞা অগ্রসরমান একটি কমিউনিটি বিনির্মাণে সাহসী ভূমিকা রাখবে এ প্রত‍্যাশাও আমাদের।

সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সমাজের সামগ্রিক বিষয়াদি সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পায় বলেই সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রয়াত সাংবাদিক-সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন যথার্থই বলেছিলেন ‘সংবাদপত্রের দায়িত্বই হলো চলমান সমাজচিত্রের প্রতিফলন’। আমরা আশাবাদী হতে চাই। চাই সংবাদপত্র সমাজের নির্ভেজাল দর্পণ রূপে শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করুক। প্রকাশিত হোক দলমত নিরপেক্ষ সামষ্টিক মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত নির্ভীক সংবাদপত্র।

নিউইয়র্কের মানবাধিকার সংগঠন

প্রবাসে বাংলাদেশিদের পরিচালনায় বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। তাদের কেউ মেলা, প্যারেড আয়োজন করেন। কেউ দেন বছরে একবার ফ্লু শট, কেউ বিদেশ ভ্রমণ করে সেলিব্রিটিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পত্রিকায় প্রেস রিলিজ পাঠান। আবার কেউ নাম বা প্যাডসর্বস্ব। প্রবাসের মানবাধিকার নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মকা- চোখে পড়ে না বলেই অনেকে জানিয়েছেন।

একটি মানবাধিকার সংগঠনের নাম ছিল সাউথ এশিয়ান হিউম্যান ওয়াচ সার্ভিস। যার পরিচালক ছিলেন এমটিএতে কর্মরত প্রয়াত শহীদুল ইসলাম তালুকদার। তিনি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে নিউইয়র্ক ফিরে এসে একটা হাফ পেজ প্রেস রিলিজ পাঠাতেন সংবাদপত্রে। যেখানে উল্লেখ থাকতো বিদেশে কোনো রিটায়ার্ড সরকারি বা এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের খবর। আর তাদের সঙ্গে সে দেশের মানবাধিকার নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার বর্ণনা। বাংলাদেশের মানবাধিকার বা আমেরিকায় কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনার কথা তার প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কখনো চোখে পড়েনি।

কমিউনিটির পরিচিত মুখ শাহ শহীদুল হক সাঈদের আরেকটি মানবাধিকার সংগঠনের নাম-ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস। তিনিও মাঝেমধ্যে মেলা বা প্যারেড আয়োজন করে তার মানবাধিকার সংগঠনের অস্তিত্ব জানান দেন। ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ আরো একটি মানবাধিকার সংগঠন’। মিয়া জাকিরের প্রেসিডেন্ট।

গত ২০ অক্টোবর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হয়েছে ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস ইউএসএর দ্বিতীয় কনভেনশন। অনুষ্ঠানে এর প্রেসিডেন্ট ড. রফিকুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট বাইডেনের স্বর্ণপদক প্রাপ্তির কথা জানিয়েছেন। এজন‍্য তাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। কিন্তু এতো বড় একটা স্বীকৃতি পাওয়া একটি মানবাধিকার সংগঠন নিউইয়র্কে তাদের মানবাধিকার কর্মকা-ের পরিচিতি খুব একটা চোখে পড়ে না বলেই অনেকে জানিয়েছেন।

জ্যাকসন হাইটসভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠনের নাম-হিউম্যান সাপোর্ট করপোরেশন। এর প্রেসিডেন্ট প্রবাসে বাংলাদেশি একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা মোহাম্মদ সোলায়মান আলী। তিনি প্রতি বছর বিনামূল্যে ফ্লু শট প্রদানের ব্যবস্থা করে থাকেন। সভাপতি সোলায়মান আলী সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ বছর যাবৎ তারা এই কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন।

আমরা জানি মানবাধিকার সংস্থা বা মানবাধিকার সংগঠন হলো এমন সংগঠন যা নিপীড়িতদের মানবাধিকার লঙ্ঘন শনাক্তকরণ, ঘটনার তথ্য সংগ্রহ, এর বিশ্লেষণ ও প্রকাশনাসহ নানাবিধ কর্মকা- পরিচালনা করার মাধ্যমে জনসচেতনতার প্রচার করে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও সহিংসতা থামানোর জন্য প্রচেষ্টাও চালায়।

নিউইয়র্কে কি মানবাধিকার লক্সিক্ষত হয় না? বিশেষ করে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে? কিছু দিন আগেও একজন বাংলাদেশি ছেলেকে পুলিশ ঘরে ঢুকে ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করেছে। আরো অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে কমিউনিটিতে। এদের কোনোটিতে কি এসব মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কোনো কর্মতৎপরতা চোখে পড়েছে? নিদেনপক্ষে কোনো বিবৃতি? প্রবাসের এতো মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার রক্ষা বা প্রবাসে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে কী দায়িত্ব পালন করেন অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। 

২৪ নভেম্বর ২০২৪

শেয়ার করুন