১৬ জানুয়ারী ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:৫১:২৭ পূর্বাহ্ন


বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০১-২০২৫
বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গ জাতীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ


বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বহুল আলোচিত হট ইস্যু জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র। জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে বিপ্লব ঘোষণা নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ মাস বিলম্বে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবি তুলে দেশব্যাপী জনসমর্থনের জন্য মাঠে নেমেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ। ইতিপূর্বে জাতীয় গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ওরা ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ জাতীয় শহিদ মিনার থেকে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই ঘোষণাপত্রে মুখ্য বিষয় হিসাবে দাবি করা হয়েছিল ১৯৭২ সংবিধানকে কবর রচনা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা। 

স্মরণে রাখতে হবে এই দুটি কাজ করার অধিকার একমাত্র জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ তথা বৈধ নির্বাচিত সংসদের। জাতীয় গণঅধিকার পরিষদ নিবন্ধিত হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল না। তাছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রণীত হয়নি। শুরুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের প্রেস সচিব বিপ্লবের ঘোষণা উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টতা না থাকার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মূলধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রতিবাদী হওয়ায় সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংকট এড়াতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজে থেকেই সকল রাজনৈতিক দল এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের কথা বলে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার কথিত কার্যক্রম স্থগিত হয়। তবে ওই দিন জাতীয় শহিদ মিনারে সমবেত জনতার উপস্থিতিতে ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণার ডেট লাইন (১৫ জানুয়ারি) বেঁধে দেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ এখন তাদের দেশব্যাপী জনসংযোগের অংশ হিসাবে কাল ফরিদপুরে একটি সভার আয়োজন করেছিল।

সবাই জানে আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগের পর সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সুরক্ষিত রাখার শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে। নোবেল লরিয়েট আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যাক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন সীমিত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে। এই সরকারের মূল দায়িত্ব ন্যূনতম সময়ে অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। সরকারে কয়েক জন ছাত্র প্রতিনিধি আছে। সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। সেখানে সংবিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলা আছে। বলা হচ্ছে, জানুয়ারি ২০২৫-এর মধ্যে কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে প্রদান করলে সরকার সব রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বিত সুপারশিমালা প্রনয়ন এবং এগুলো বাস্তবায়নের পথ নকশা প্রণয়ন করবে। সব রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠীকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একতাবদ্ধ হয়ে সেই সময়ের অপেক্ষা করতেই হবে।

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আত্ম উৎসর্গকারী ছাত্র-জনতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছি, কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে স্বাধীনতার সব অর্জন ওলটপালট করার অধিকার দেওয়া হয়নি। দেশে একটি সংবিধান আছে, নানা সংশোধনে ১৯৭২ ক্ষত বিক্ষত করা হয়েছে। সেটি সংশোধনের একটি কার্যক্রম চলমান। কিন্তু সেই সংবিধান কবর দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া পরোক্ষভাবে দেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে অস্বীকার করার শামিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনা সরকারের সব অপকর্মের সুষ্ঠু নিরপেক্ষ বিচার সময়ের দাবি হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার দেশের আপামর জনতার। নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার সিদ্ধান্ত নিবে সংবিধান এবং আওয়ামী লীগ বিষয়ে। কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠী দাবি তুলতেই পারে গণতান্ত্রিক দেশে। কিন্তু সেটি মেনে নেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক বিষয়গুলো রাজনৈতিক ভাবেই সমাধান করতে হবে।

কেন, কি পরিস্থিতিতে, কাদের ইন্ধন এবং পরিকল্পনায় নিরীহ গোছের কোটাবিরোধী আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পথে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল সেটি এক সময়ে প্রকাশিত এবং প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা মানুষ কখনোই স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মীয় উগ্রতা চেতনাকে সফল হতে দেবে না। তরুণসমাজ স্বাধীনতার চেতনা, স্বাধীনতার ঐতিহ্যকে সম্মান জানাবে। ৭১ এবং ২৪ চেতনাকে সমন্বিত করে শোষণহীন, বৈষম্যহীন দেশ গঠনে ইস্পাত দৃঢ় একতা সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। এই মুহূর্তে দেশে প্রয়োজন ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে একতা। বিভেদ জাতিকে পথভ্রষ্ট করবে।

শেয়ার করুন