জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে পেট্রোবাংলা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। জানা গেছে প্রস্তাবে শিল্পগ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ৩০.৭৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৭৫.৭২ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্যাপটিভ জেনারেশনে গ্যাস ব্যবহারের জন্য গ্রাহকদের এই বর্ধিত মূল্য পরিশোধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, গ্যাসের মূল্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্ধারিত না রেখে বিশ্ববাজারে গ্যাসের মূল্য নির্ভর করা হবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে পেট্রোবাংলা নিজেদের গ্যাস ক্ষেত্র হতে ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানিকৃত এলএনজি থেকে ১ হাজার ১০০ মিলিয়নসহ দৈনিক সর্বোচ্চ ৩ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করতে পারে। সিস্টেমে সর্বোচ্চ চাহিদা ৪২০০-৪৫০০ ঘনফুট থাকায় শিল্পগ্রাহকসহ সব গ্রাহক নিদারুণ গ্যাস সরবরাহ সংকটে আছে। পূর্ববর্তী সরকার শিল্পগ্রাহকদের সার্বক্ষণিকভাবে মানসম্পন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করলেও সরবরাহ উন্নত করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
অন্যান্য কারণসহ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের ছোট, মধ্যম, বড় শিল্পকারখানা এখন নিদারুণ সমস্যায় আছে। এ মুহূর্তে পেট্রোবাংলার প্রস্তাব অনুযায়ী, রেগুলেটরি কমিশন মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রদান করলে সেটি হবে মরার উপর খাঁড়ার ঘা। অনেকের হয়তো জানা আছে বা চোখ মেললেই দেখা যাবে রাতের আঁধারে সিএনজি পাম্প থেকে সিএনজি সংগ্রহ করে অনেক শিল্পগ্রাহক কারখানা পরিচালনা করছে। এখানে ব্যাপক নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে। কিন্তু ক্রেতা-বিক্রেতা গভীর রাতের ওই সময়টুকু দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের জন্য লেনদেন করে আসছে। দেখেও না দেখার ভান করছে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পূর্ববর্তী সরকার বিদায় নেওয়ার পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৫ মাসের অধিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। জ্বালানি উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পর মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি সরকারের প্রাধিকার নয়। সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে দেনার দায়ে বিপর্যস্ত সংকটাপন্ন জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর পেয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষকদের ধারণা সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের চুরি, অপচয় সীমিত করা হলে এখনই বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন নেই।
সরকার অন্যান্য পরিবর্তনের সঙ্গে জ্বালানি বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। কমিশন সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব পরীক্ষা করে পাবলিক হেয়ারিংয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করবে।
গ্যাস ব্যবহারকারী ক্যাপটিভ জেনারেশন বিষয়ে বিবেচনার সুযোগ আছে। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো শিল্পখানায় মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা অর্জন করায় পর্যায়ক্রমে ক্যাপটিভ জেনারেশনে গ্যাস ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বাংলাদেশ। এখানে গ্যাস সাশ্রয় করে সেটি শিল্পে সরবরাহ করা যেতে পারে।
কেন জ্বালানি মন্ত্রণালয় এই মুহূর্তে শিল্পগ্রাহকদের গ্যাসের মূল্য বিপুল মাত্রায় বৃদ্ধি করার প্রয়োজন বোধ করলো বোধগম্য নয়। বিশ্ববাজারে এলএনজি মূল্য এখন স্বাভাবিক আছে। বাংলাদেশ মাত্র চাহিদার ২০ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে থাকে। শিল্পগ্রাহকরা এমনিতেই অন্য গ্রাহকদের তুলনায় নিয়মিত গ্যাসের বিল পরিশোধ করে থাকে। পেট্রোবাংলা কিন্তু শিল্পগ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী, গ্যাস সরবরাহ করতে পারে না।
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে অনেক শিল্পকারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো তিন শিফটের পরিবর্তে দুই শিফটে পরিচালিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় শিল্প গ্রাহকদের বর্ধিত মূল্য পরিশোধ করতে হলে অনেক শিল্পকারখানাকে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হবে, রফতানিমুখী শিল্পকারখানাগুলো প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। নিঃসন্দেহে পাবলিক হেয়ারিংয়ের সময়ে শিল্পকারখানাগুলোর প্রতিনিধি, গ্রাহক প্রতিনিধিদের সংগঠন এবং অন্যান্য অংশীজন তীব্র প্রতিবাদ করবে। রেগুলেটরি কমিশন এবং সরকারকে বিব্রত হতে হবে।
পূর্ববর্তী সরকারের ভ্রান্ত পরিকল্পনা, অদক্ষতা এবং দুর্নীতির কারণে জ্বালানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অন্যতম প্রধান কারণ সুবিধাবাদী আমলা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ দুষ্টু জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত। সংস্কার আর উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একইভাবে আমলাদের পরামর্শে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির পথে হাঁটলে সেটি হবে দুঃখজনক।
এটাও সত্য যে, বিগত পতিত সরকারের বিপুল বকেয়া পরিশোধের দায় নিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সংকটে আছে। ভোক্তাদের ওপর এ পরিশোধের দায় হস্তান্তর করার সনাতন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি সুচিন্তিত গ্যাস-বিদ্যুৎ মূল্য অবকাঠামো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্রহণ করবে বলে আশা করি। পরিবর্তিত কমিশনের চেয়ারম্যান অভিজ্ঞ, নতুন সদস্যরাও খাতসংশ্লিষ্ট। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না, যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দেখার অপেক্ষায় থাকলাম, চূড়ান্ত কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভাসমান এলএনজি টার্মিনালগুলো গ্যাস সংকটে স্থায়ী সমাধান নয়
কক্সবাজারের মহেষখালী উপকূলে থাকা দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বাংলাদেশের গ্যাস সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এগুলোকে স্থায়ী সমাধান বিবেচনা করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান সামিট এনার্জি পরিচালনাধীন এফেসারু দুটির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতেই আছে বছরে সর্বোচ্চ কতদিন এগুলো অপারেশনে থাকবে। মেট ওশান সার্ভে অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে এগুলোর অপারেশন স্থগিত থাকে। এর বাইরে বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং কয়েক বছর পর মেজর ওভারহোলিং করতে হয়। বর্তমানে দেশে দৈনিক সমন্বিত গ্যাস চাহিদা ৪২০০-৪৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দুটি টার্মিনাল একসঙ্গে চালু থাকলে ৯০০-১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট আর এলএনজি যোগ হয়ে সর্বোচ্চ সরবরাহ হয় ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্যাস চাহিদা মূলত আমদানিকৃত এলএনজি দিয়েই মিটানো হয়। বিষয়টি বিগত ২ বছর ধরেই সবার জানা। এটাও সবার জানা দেশের উৎপাদনরত গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর গ্যাস উৎপাদন ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে এখন ২ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। ১০০-১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, গৃহস্থালি সব শ্রেণির গ্রাহকদের সংকট চরমে। এমতাবস্থায় কখনো একটি বা দুটি টার্মিনাল অপারেশনে না থাকলেই গ্যাস সংকট দুর্ভিক্ষে পরিণত হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার অন্যতম কোম্পানি আরপিজিএল দীর্ঘদিন ধরে মাতারবাড়ীতে ল্যান্ড বেজড এলএনজি টার্মিনাল (এলবিটি) নির্মাণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে জমি নির্ধারণ জটিলতায় তিন-চার বছর অপেক্ষা করছে। ভাবতে অবাক লাগে সমস্যাটি জেনেও কেন মিটিয়ে এলবিটি স্থাপন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা হচ্ছে না। এরই মাঝে আবার সরকার পেট্রোবাংলা শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। সরকারের ভ্রান্ত পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টির অভাব, দুর্নীতি আর ব্যর্থতার দায় বহন করতে হচ্ছে সর্বস্তরের জনসাধারণকে।