২৬ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ৬:৪৩:৩৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
বাংলাদেশ ও মেক্সিকোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার এদেশে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন আমরা হতে দিব না- আখতার হোসেন সাংবাদিকতা ব্যবস্থাকে সাংবাদিকবান্ধব করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে- মাহফুজ আলম আমাদের যেকোনো মূল্যে ঐক্য ধরে রাখতে হবে- তারেক রহমান প্যারিসে বাংলাদেশ কমিউনিটি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারে পুরস্কার বিতরণ সংস্কার ও নির্বাচনকে যেভাবে মুখোমুখি করা হচ্ছে তা ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক- তারেক রহমান আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই- প্রধান উপদেষ্টা আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবীতে মধ্যরাতে মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানাইলের কারণে ৫৫ হাজার মৃত্যু ট্রাম্পকে থামাতে আদালতকে ভূমিকা রাখতে হবে


বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও জ্বালানি নিরাপত্তা
সালেক সুফি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৩-২০২৫
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও জ্বালানি নিরাপত্তা বিদ্যুৎ লাইন


বাংলাদেশের দীর্ঘ স্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের আদলে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাসমূহের মধ্যে লেভেল প্লে সৃষ্টির লক্ষ্যে সৃষ্টি করা হয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। কিন্তু ২০০৩ -২০২৪ সকল সরকার কর্তৃত্ব পরায়ণ থেকে যথেচ্ছার করায় বার্ক সত্যিকার অর্থে কার্যকরি প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিকশিত হয় নি। ফলশ্রুতিতে একচ্ছত্র আমলা নিয়ন্ত্রিত জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে সৃষ্টি হয়েছে মহাসংকট। অস্বচ্ছতা, দুর্নীতির কারণে জ্বালানি নিরাপত্তায় সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সরকারি সংস্থাগুলো হয়ে পড়েছে দেউলিয়া। জ্বালানি সরবরাহ সঙ্কটে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও গ্রাহক মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পকারখানাগুলোর উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে, ডুবছে। অথচ সরকার বার্ককে সত্যিকার অর্থে সঠিক পেশাদার লোকজন নিয়োজিত করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের স্বেচ্ছাচার আর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং বর্তমান দূরবস্থা অনেকটাই কেটে যেতো। দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে নিরপেক্ষ সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্বে কারিগরি এবং প্রশাসনিকভাবে শক্তিশালী করা সময়ের দাবি। 

বার্ক অ্যাক্ট ২০০৩ অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি জ্বালানি, বিদ্যুৎ কোম্পানি এবং সংস্থাগুলো বার্ক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করে নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে ব্যবসা পরিচালনা করার কথা। সেই অনুযায়ী সংস্থাগুলোর কারিগরি, আর্থিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম দেশে অনুমোদিত এ্যাক্ট, রেগুলেশন, পলিসি অনুযায়ী হচ্ছে কি না সেটি দেখার অধিকার বার্ক সংরক্ষণ করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এযাবৎ জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের কোনো উন্নয়নমূলক কার্যক্রম এবং বিনিয়োগ বার্কের প্রাক অনুমোদন নিয়ে করা হয় নি। যদি করা হতো তাহলে গ্যাস এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করেই বিপুল অর্থ বিনিয়োগে প্রয়োজনের অনেক বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে একদিকে সরকারি অর্থের অপচয়, অন্যদিকে দেনার দায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোকে দেউলিয়া হতে হতো না। পূর্ববর্তী সরকার এতো বেপরোয়া ছিল যে একপর্যায়ে বিদ্যুতের ট্যারিফ এবং জ্বালানি মূল্য নির্ধারণ দায়িত্ব বার্ক থেকে সংকুচিত করে সরকার ভাগ বসায়। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বার্ক অ্যাক্টের পরিবর্তন বাতিল করে নিরঙ্কুশ অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান এবং সদস্য হিসেবে অভিজ্ঞ দক্ষ পেশাদারদের দায়িত্ব দেওয়ায় ঘুরে দাঁড়াতে সৃষ্টি করেছে বার্ক। পূর্বের সরকার ইচ্ছা মত যথা প্রযোজ্য কাজে অনভিজ্ঞ অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্তাদের নিযোগ দিয়ে বার্ককে আজ্ঞাবহ পোস্ট বক্সে পরিণত করেছিল।

বিগত সরকারের কিছু কার্যক্রম নিরপেক্ষভাবে অনুসদ্ধান করলেই দায়ী ব্যাক্তিদের আইনের আওতায় আনা যাবে। দেশে বাপেক্সের মত সক্ষম জাতীয় অনুসন্ধান কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও অধিক খরচে অস্বচ্ছভাবে উন্নয়ন কূপ খননের জন্য কেন রাশিয়ান গাজপ্রমকে নিয়োজিত করা হয়েছিল? চুক্তিটি গাজপ্রমের সঙ্গে হলেও কীভাবে এরিয়েল নামের দুর্বল কোম্পানি খননের দায়িত্ব পেলো? গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে সৃষ্ট গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি অনুসন্ধান করা জরুরি। কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১০০ গ্যাস কূপখননের অবাস্তব প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাপেক্সের ওপর? আবার বাপেক্স যখন উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করলো, তখন কেন মাঝপথে প্রকল্প বাতিল করে বেশ কয়েক বছর মূল্যবান সময় অপচয় করা হলো?

সিসি। কেন গ্যাস সঞ্চয় কমে আসার পরও জিটিসিএলকে একের পর এক ব্যয়বহুল গ্যাস সঞ্চালন অবকাঠামো নির্মাণ চাপিয়ে দিয়ে আর্থিকভাবে রুগ্ণ করা হলো? জিটিসিএলের নিম্নবর্ণিত প্রকল্পগুলো অবশ্যই তদন্তের আওতায় আসতে পারে 

১. এডিবির অনুদানে মুচাই, আশুগঞ্জ, এলেঙ্গায় পাইপ লাইন কম্প্রেশার স্টেশন অগ্রবর্তী থাকা অবস্থায় কেন কোনো চুক্তির আওতায় শেভরনকে মুচাইতে অপেক্ষাকৃত অধিক মূল্যে মুচাই কম্প্রেশার স্টেশন স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হলো? আবার তিনটি কম্প্রেশার প্রকল্প চালু থাকা অবস্থায় কেন সমান্তরালে জরুরি ভিত্তিতে অপেক্ষাকৃত অধিক খরচে বিবিয়ানা-ধানুয়া পাইপলাইন নির্মাণ করা হলো? ফলশ্রুতি পাইপ লাইনটি নির্ধারিত ক্ষমতার অনেক কম গ্যাস পরিবহন করছে। আশুগঞ্জ এবং এলেঙ্গা কম্প্রেশার চালু রাখার মত গ্যাস নেই। এলেঙ্গা কম্প্রেশার কোনো দিন চালু হয়নি।

২. কেন কাদের স্বার্থে আশুগঞ্জ -বাখরাবাদ প্যারালাল পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে? পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন প্রতিবেদন দেখলেই প্রতিয়মান হবে আশুগঞ্জ ০ বাখরাবাদ ১ এবং ২ পাইপলাইনে গ্যাস ব্যবহার শূন্য। 

৩. যেখানে গ্যাসের স্বল্পতার কারণে কুষ্টিয়া-যশোর-খুলনায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়নি সেই অবস্থায় কেন বগুড়া থেকে দিনাজপুর হয়ে রংপুর গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করা হলো? 

৪. কেন তীব্র গ্যাস সংকটের সময়েও ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাস নানা অজুহাতে গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত করা হলো না? স্মরণে থাকতে পারে ইউনোকোল নামের আন্তর্জাতিক অয়েল কোম্পানি ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে ওয়েস্টার্ন রিজিওন ইন্টেগ্রেটেড প্রজেট প্রস্তাব করে ভোলার গ্যাস বরিশাল হয়ে খুলনায় সঞ্চালনের প্রস্তাব দিয়েছিল। প্রকল্পের অধীনে ভোলা, বরিশাল এবং খুলনায় তিনটি গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা ছিল। 

৫। গ্যাস সরবরাহ সংকট থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টাকে প্রধান করে কমিটির মাধ্যমে কেন শিল্পগুলোকে অস্বচ্ছ উপায়ে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছিলো? অনেক দুর্নীতির অভিযোগ আছে গ্যাস সংযোগ প্রদানের প্রদানের ক্ষেত্রে?

৬ গ্যাস না থাকা সত্ত্বেও কেন মেঘনাঘাটে তিনটি অত্যাধুনিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল? বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন প্রস্তুত। কোথা থেকে আসবে গ্যাস?

৭. কেন মাতারবাড়ীতে ভূমিভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প ৫ বছরের অধিক সময় ঝুলে আছে? কেন দুটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন করতে ৮ বছর সময় লাগলো? 

৮ মহেশখালী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত দুইধাপে দুবার অপেক্ষাকৃত অধিক মূল্যে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এই দুই পাইপলাইন নির্মাণকালে অকারণে অত্যধিক ক্ষমতার মিটারিং স্টেশন নির্মাণ করে আর্থিক দায় জিটিসিলের ওপর বর্তানো হয়েছে।

৯. বিগত সরকারের সময়ে পেট্রোবাংলা এবং গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর একশ্রেণির দুর্বৃত্ত মনোভাবের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস চুরি হয়েছে। গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ককে রীতিমতো ধর্ষণ করে অনিরাপদ করা হয়েছে। 

উপরোক্ত ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব অবশ্যই পূর্বরবর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানি বিদ্যুৎ সচিববৃন্দ এবং অবশ্যই পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের ওপর বর্তায়। 

আমি মনে করি, বার্ককে প্রয়োজনীয় জনবল দিয়ে শক্তিশালী করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে ৩-৫ বছরের মধ্যে জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর ঘুরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তা সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

শেয়ার করুন