১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ০৪:০৬:৪৬ পূর্বাহ্ন


নিউইয়র্কের প্রথম মসজিদ পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৪-২০২৫
নিউইয়র্কের প্রথম মসজিদ পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ


নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনে, উইলিয়ামসবার্গের রিভারসাইড এলাকার এক শান্তিপূর্ণ আবাসিক সড়কে দাঁড়িয়ে আছে পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ। এক সুদৃশ্য কাঠের তৈরি মসজিদ, যার বয়স আজ ৯০ বছর। মসজিদটির ঠিকানা হলো ১২৩ পাওয়ারস স্ট্রিট, ব্রুকলিন, নিউইয়র্ক। এটি নিউইয়র্ক শহরের মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রথম মসজিদ এবং আমেরিকার তৃতীয় মসজিদ। নিউইয়র্কসহ আমেরিকায় মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। ১৯০৭ সালে ইউরোপ থেকে তাতার মুসলিম অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং তারা প্রতিষ্ঠা করেন লিথুয়ানীয় তাতার সোসাইটি। তাতাররা মূলত লিপকা তাতার, যাদের ইতিহাস পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়ায় বিস্তৃত এবং তারা ইসলামের প্রচারক হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে ১৯২৭ সালে তাদের সংগঠনটি নাম পরিবর্তন করে ‘আমেরিকান মোহামেডান সোসাইটি’ রাখে। এই সোসাইটি মূলত তাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য কাজ করছিল।

১৯৩৫ সালে আমেরিকান মোহামেডান সোসাইটি ব্রুকলিনের পাওয়ারস স্ট্রিট এলাকায় একটি পুরোনো মেথডিস্ট চার্চ কিনে নেয় এবং এই স্থানটি তাদের ধর্মীয় কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে। মসজিদটির টাওয়ারে একটি সজ্জিত অর্ধচন্দ্র স্থাপন করা হয়, যা ইসলামের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। মসজিদটির কাঠের বাহ্যিক রূপ পূর্ব ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলোর অনুকরণে তৈরি, যা মসজিদের অভ্যন্তরেও বিদ্যমান ছিল। অভিবাসী তাতার মুসলিমরা নিজেদের পূর্ববর্তী মসজিদের নস্টালজিয়া মেটাতে এখানে কাঠের প্যানেলিং দিয়ে এটি সম্পূর্ণ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কোরআন শিক্ষা প্রদান এবং ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে সমাজের একতা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা।

পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ দ্রুত স্থানীয় মুসলিমদের জন্য একটি ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এটি কেবল নামাজের জায়গা ছিল না, বরং মুসলিম পরিবারের সদস্যরা এখানে একত্রিত হয়ে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন, সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন এবং একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক কমিউনিটি তৈরি করতেন। মসজিদটি একসময় অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিল, যেখানে শিশুদের কোরআন শেখানো, আড্ডা দেওয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হতো। তাতার মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়া এবং একে অন্যকে সাহায্য করার সংস্কৃতি এখানে প্রচলিত ছিল।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ তার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়েছে। সোসাইটির ট্রেজারার মেরিয়ন সেডোরোভিটজ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালিসা র‌্যাটকেভিচ হাগউট জানান, গত কয়েক দশকে সামাজিক পরিবর্তন এবং আন্তঃধর্মীয় বিবাহের প্রবণতা মসজিদটির জীবন্ত কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি, সোসাইটির সদস্যরা বিভিন্ন কারণে শহর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন, বিশেষ করে কর্মসংস্থানের খোঁজে। বর্তমানে, মসজিদটি প্রায় সময় বন্ধ থাকে এবং সাধারণত শুধু সদস্যদের বিয়ের অনুষ্ঠান, মৃত্যুর পর জানাজার নামাজ বা বিশেষ উপলক্ষে খোলা হয়। এক সময়ের ব্যস্ত মসজিদ আজ প্রায় নিঃশব্দ, যেখানে পূর্বের প্রাণচাঞ্চল্য আর দেখা যায় না। তবে এটি তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে এখনো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

লিপকা তাতাররা ছিলেন এক ঐতিহাসিক মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা মঙ্গোল সাম্রাজ্যের গোল্ডেন হোর্ড খাঁনাত থেকে এসেছে। তারা ইসলামের আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে রাশিয়ার অন্যান্য তাতারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। এরা ১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লিথুয়ানিয়ায় বসতি স্থাপন করে এবং সেখানে শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের ভূমিকা ছিল, আক্রমণকারী মঙ্গোলদের প্রতিরোধ করা এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে রক্ষা করা।

আজও লিপকা তাতাররা পোল্যান্ড, বেলারুশ এবং লিথুয়ানিয়ায় সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করছে এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস আজও জীবিত রয়েছে। লিপকা তাতারদের অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য হলো তাদের ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং নিজের সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত না হওয়া, যা তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে।

পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু চিন্তা রয়েছে। নিউইয়র্ক সিটির মুসলিম সম্প্রদায় আজকাল অনেক বৈচিত্র‍্যময় এবং ভিন্ন জাতির মানুষ এখানে বসবাস করে। মসজিদটি যদি আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে, তাহলে এটি আরো কার্যকর হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর পরিসরের পুনরুজ্জীবন এবং অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটির মডেল অনুসরণ করলে মসজিদটি তার প্রাচীন গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে যদি এটি প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারের নামাজের জন্য খোলা হয় এবং অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটির মতো কার্যক্রম চালু করা হয়, তাহলে এটি নতুন প্রজন্মের মুসলিমদের কাছে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি একটি তরুণ পাকিস্তানি ইমাম মসজিদে নামাজ পড়ানোর জন্য এসেছেন, যা সম্ভবত এই ঐতিহাসিক মসজিদটির পুনঃজীবনের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।

পাওয়ারস স্ট্রিট মসজিদ ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা নতুন প্রজন্মকে ইসলামের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ না করি, তবে তারা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হতে পারে। আন্তঃধর্মীয় বিবাহ এবং সমাজে ধর্মীয় অজ্ঞতা বৃদ্ধি পেলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একতার অভাব হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে ইসলামের মৌলিক আদর্শ এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো ইসলামের শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তুলে ধরা, যাতে তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয় সংরক্ষণ করতে পারে। যদি আমরা সঠিকভাবে ইসলামের শিক্ষা না দিই, তবে আমাদের মুসলিম সমাজের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হতে পারে এবং ধর্মীয় সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তাই মুসলিম সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করতে আমাদের উচিত, ধর্মীয় শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ এবং প্রচার করা, যাতে নতুন প্রজন্ম ধর্মীয় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজে একতা এবং শান্তির পরিবেশ বজায় রাখতে পারে।

শেয়ার করুন