১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ০৪:২৮:০১ পূর্বাহ্ন


মোদি-ইউনূস বৈঠক : কার লাভ, কার ক্ষতি
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২৫
মোদি-ইউনূস বৈঠক : কার লাভ, কার ক্ষতি বৈঠকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি


অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনের সময় সাইডলাইনে মোদি-ইউনূস আলোচনা হয়েছে। সেই বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ থেকে প্রদত্ত বক্তব্যের বিষয়বস্তুতে কিছুটা বৈপরীত্য থাকলেও মোদ্দাকথা, ভারতের কূটনৈতিক কৌশলের কাছে বাংলাদেশ সুবিধা করতে পারেনি। ভারত বলেছে, তারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে আগ্রহী। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের নিপীড়ন বিষয়ে ভারত সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পারস্পরিক সম্পর্ক বিষিয়ে যায় এমন বক্তব্য প্রদান থেকেও বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতে অবস্থারত শেখ হাসিনাকে বিচারের জন্য বাংলাদেশে প্রেরণের বিষয় তুলে ধরা হলেও সঠিক কি আলাপ হয়েছে, সেটি ভারত বা বাংলাদেশ সুস্পষ্ট করে বলেনি। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ভারতের একটি মিডিয়াকে বলেছেন, যে বৈঠকে হাসিনাকে ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা উঠেছিল। এর বেশি কিছু বলা যাবে না...। অন্যদিকে ভারত বলেছে, দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সব অনিষ্পন্ন সমস্যাসমূহ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা সম্ভব। 

বলাবাহুল্য, ভারত বাংলাদেশের প্রধান প্রতিবেশী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে সহায়তাকারী প্রধান দেশ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব সূচনা থেকেই ছিল, আছে এবং থাকবে। তবে সে প্রভাব যেন দুটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পারস্পরিক সমতা, শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে হয় সেটি সবাই কামনা করে। 

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, ছাত্র সমন্বয়ক এবং কিছু প্রান্তিক রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে ভারতবিরোধিতা, অনিয়ন্ত্রিত বক্তব্য এবং একই সঙ্গে ভারতীয় মিডিয়ায় নানা অপপ্রচারের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক বিষিয়ে আছে। বাংলাদেশের সরকার প্রধান চীন সফরকালে ভারতের সেভেন সিস্টার (সাত অঙ্গরাজ্য) নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। কূটনৈতিকভাবে সেটি কতটুকু সঠিক বা বেঠিক সেই আলোচনায় যাবো না। এরপরও চীনের সঙ্গে ড. ইউনূসের সখ্য ভালো চোখে দেখবে না ভারত, এটাই চিরসত্য। কিন্তু এটাও ঠিক, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে চীনের সহায়তা ছাড়া এগোতেও পারছে না। রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে ভারত এগোচ্ছে না। দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর চীন সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশের পাশে থাকার। এটা ইউনূসের জয়। একইভাবে তিস্তাসহ বাংলাদেশের নদীর পানি ইস্যুতে চীনের প্লান ও সহযোগিতার আশ্বাস বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছুর সূচনার ইঙ্গিত। এরপর অন্যান্য বিনিয়োগ তো আছেই। 

কিন্তু ভারত কিন্তু আদৌ সহজভাবে বিষয়টি নেয়নি। বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশের অবস্থান কিন্তু অনেকটাই ভারত নির্ভর। ৩.৭৫ দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতবেষ্টিত। অধিকাংশ নদনদী ভারত নেপাল থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। নদীগুলোর সমতাভিত্তিক জলবণ্টন না হওয়ায় বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে, অধিকাংশ নদনদী মৃতপ্রায়। 

পদ্মা গঙ্গার জলবণ্টন চুক্তি নবায়ন করতে হবে, তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর জলবণ্টন কবে হবে বিধাতাই জানেন। বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্যিক ভারসাম্য স্থাপন জরুরি। দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বজায় থাকলে উভয় দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলাই বাহুল্য। এমতাবস্তায় কিছু অর্বাচীন মানুষের তীব্র ভারত বিরোধিতা বাংলাদেশকে কোনোভাবেই স্বনির্ভর হতে সহায়তা করবে বলে মনে হয় না। ভারত কখনো বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। ভারতকে এড়িয়ে বাংলাদেশ কখনো চীন বা পাকিস্তানকে বিকল্প বন্ধু বানিয়ে স্বস্তিতে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে ভারতকে বুঝতে হবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক ছিল। কেন সেই সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে তার অনেক যৌক্তিক কারণ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মাদ ইউনূস তার বিশ্বপর্যায়ে গ্রহণ যোগ্যতার কারণে কিন্তু বাংলাদেশকে দর কষাকষির পর্যায়ে নিয়ে গেছেন এটা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয়ও। 

এটি অনুমেয় আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ভারত শেখ হাসিনাকে অনির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে না। যে পদ্ধতিতে বিচারের আগেই ফলাফল নির্ধারণ করে জুলাই-আগস্ট ঘটনাবলির বিচারকার্য এগিয়ে চলেছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ অসম্ভব। আর অন্য দেশের মতো ভারত চাইছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। 

 বিশ্বমিডিয়ায় কিন্তু জুলাই-আগস্ট এবং তৎপরবর্তী হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, মব জাস্টিস নিয়ে নানা তথ্য সংবলিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। দেশেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাহাস চলছে। সংস্কার এবং নির্বাচন নিয়ে চলছে সাপ-লুডু খেলা। এমতাবস্থায় বর্তমান সরকার কোনোভাবে ভারত বৈরী মনোভাবকে পুঁজি করে দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি করা সমীচীন হবে না।

আশা করি, বিচক্ষণ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার মুখ্য সহকর্মীরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছেন। অন্যদিকে ভারতকেও বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পরিবর্তন করতে হবে। সৎ প্রতিবেশীর পরিচয়ে উদার হতে হবে। 

শেয়ার করুন