বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন এপ্রিল ২০২৬ প্রথমার্ধে বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণা করবে। জুলাই-আগস্ট ২০২৪ গণআন্দোলনের পরিণতিতে সৃষ্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল ন্যূনতম সময়ে একটি নিরপেক্ষ, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান। জনগণ সাধারণভাবে দীর্ঘদিন ভোটাধিকার বঞ্চিত থেকে সংক্ষুব্ধ থাকায় শেখ হাসিনা সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল।
আগস্ট ২০২৪ থেকেই বিএনপিসহ মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিশেষ অবস্থায় সড়কে অবস্থানকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চাইছিল ডিসেম্বর ২০২৫ জাতীয় নির্বাচন শেষে ব্যারাকে ফিরে যেতে। কিন্তু সবার দাবি উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান এপ্রিল ২০২৬ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করায় নতুন করে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলো।
তাছাড়া বাস্তবতা হলো ২০২৬ সালের এপ্রিলের মাঝে দুই একটা কালবৈশাখী হতে পারে, হয়তো তীব্র গরম থাকবে, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অজুহাত সৃষ্টি হবে। সার্বিক অবস্থার বিবেচনায় সরকারের উচিত সব স্টেকহোল্ডার বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের উপযুক্ত সময় পুনরায় বিবেচনা করার। এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সপক্ষে কেউ জোরালো যুক্তি দেখাতে পারবে না।
ঐতিহ্যতভাবে বাংলাদেশে ডিসেম্বর-জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের জন্য আদর্শ এবং উপযোগী সময়। এই সময় আবহাওয়া অনুকূল থাকে। স্কুল-কলেজ অবকাশ সময়। অন্যদিকে এপ্রিল-মে গ্রীষ্মের শুরুতে ঝড়বৃষ্টি, রোজার মাস, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার সময়। কেন এপ্রিলকে বেছে নেওয়া হলো নির্বাচনের জন্য, সেই বিষয়টি কিন্তু ব্যাখ্যা দেননি ড. ইউনূস।
অজুহাত হতে পারে, সরকার চাইছে সম্মত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে, জুলাই সনদ ঘোষণা এবং অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে। এখানে লক্ষণীয় জুলাই-আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে সরকার কিন্তু দেশের সার্বিক বিষয়ে খুব একটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নানা সীমাবদ্ধতা আছে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে যতটুকু সম্মতি আছে সেগুলো ঘোষণা দিয়ে বাস্তবায়ন করে এখনো ২০২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সুযোগ আছে বলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মনে করে। বাংলাদেশে ইতিপূর্বে কেয়ারটেকার সরকার ৯০ দিনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার নজির আছে। এমতাবস্থায় দুই একটি প্রান্তিক দলের ইচ্ছার প্রতি সাড়া দিয়ে এপ্রিল ২০২৬ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে সরকারপ্রধান সঠিক কাজ করেছেন বলে মনে হয় না।
প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের পর নতুন ভোটার সংযুক্ত হয়। নির্বাচন কমিশনকে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রয়োজন হয়। সরকারকে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের জন্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। এমতাবস্থায় কীভাবে অন্তর্বর্তী সরকার বা নির্বাচন কমিশন এপ্রিল মাসে নির্বাচন করবে? রাজনৈতিক দলগুলো রোজা, ঈদ, প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে?
এপ্রিলের নির্বাচনের ঘোষণা যেভাবে এলো
ঈদুল আজহার প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশ ডিসেম্বর ২০২৫ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করেছিল। জামায়াতে ইসলামী চাইছিল ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিল ২০২৬ জাতীয় নির্বাচন, সম্প্রতি সৃষ্ট এনসিপি চাইছিল জুলাই সনদ শেষে নির্বাচনে রোডম্যাপ ঘোষণা। যা হোক দলনিরপেক্ষ জনগোষ্ঠী নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময় জানতে পেরে আশ্বস্ত হয়েছে। আশা করি নির্বাচন কমিশনসহ সংস্থা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে, সব রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে জনগণের সামনে নিজেদের নির্বাচনী অঙ্গীকার পেশ করবেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রয়োজীনয় সংস্কার এবং বিচারকাজ এগিয়ে নেওয়ার বিষয়েও কথা বলেছেন, জুলাই ২০২৫-এর মধ্যে জুলাই ঘোষণা করার কোথাও ব্যক্ত করেছেন।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের ঘোষিত সময় নিয়ে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে এপ্রিল ২০২৬ ব্যাবধান চার মাসের। এই সময়ের মধ্যে বিশাল কিছু নতুন হবে মনে হয় না। কিন্তু মনে রাখতে হয় ডিসেম্বর এবং এপ্রিল দেশের আবহাওয়া অনেক বিপরীত থাকে। জুন মাসে আবার জাতীয় বাজেট ঘোষণার অবশ্যকীয়তা থাকে। জানি না নির্বাচন ডিসেম্বরে না করে এপ্রিলে করলে কি সুবিধা?
অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা সমীচীন ছিল। সরকারের অন্যতম স্টেকহোল্ডার সেনাবহিনী প্রধান কিছুদিন আগে ডিসেম্বর ২০২৫ জাতীয় নির্বাচন শেষে সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্ব বাস্তবতায় যতদিন অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন সংকট ঘনীভূত হবে। রাজপথে রাজনৈতিক দলগুলো সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। জানি না চার মাস বেশি সময়ে সরকার দেশকে কতটা নিয়ন্ত্রিত করে উন্নতির নির্বাচন উপযোগী পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারবে?
বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো নির্বাচনে প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনৈতিক দল এবং জোটের বাইরে একমাত্র জামাতের কিছু ভোট ব্যাংক আছে। ২০২৫ বা ২০৩০ যখনি নির্বাচন হোক এই পরিচিত মহলের বৈরী তৃতীয় পক্ষের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। জানি না বর্তমান সরকারের পক্ষে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রেখে নির্বাচন করা সম্ভব হবে কি না? নিশ্চিত নই নতুন দলগুলো ভোটের মাঠে আদৌ পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাবে কি না?
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে নির্বাচন সময় নির্ধারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার চৌকস সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মনে হয় না। এখন চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশন, বেসামরিক এবং সামরিক প্রশাসনকে নিরপেক্ষ নির্বাচন সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে সংস্কার করার। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নির্বাচন উপলক্ষে নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রণয়ন করে জনতার সামনে নিয়ে যাওয়ার। ২০২৬ নির্বাচনে কিন্তু বিশাল সংখ্যক নতুন ভোটার থাকবে। নিরপেক্ষ পরিবেশ থাকলে পেশি এবং অর্থের প্রভাবে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। সব নির্বাচনপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দলের উচিত হবে সরকারকে সহায়তা করা। সরকারের উচিত হবে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা।