যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে এক সম্ভাব্য বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, তার প্রশাসন এমন একটি ‘অস্থায়ী পাস’ ব্যবস্থার পরিকল্পনা করছে, যা নির্দিষ্ট শিল্প যেমন কৃষি ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে কর্মরত অভিবাসীদের সীমিত সময়ের জন্য বৈধভাবে কাজের সুযোগ দেবে। এই পাসের আওতায় তারা বৈধভাবে কর পরিশোধ করবেন, তবে এতে তাদের স্থায়ী আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না। তারা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী আইনি মর্যাদা বা নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ পাবেন না।
অভিবাসন নীতিতে দীর্ঘদিনের কড়াকড়ির পর এই নতুন প্রস্তাব প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের প্রতিফলন বলেই মনে করছেন অনেক অভিবাসী অধিকারকর্মী। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, কৃষকদের এমন কিছু নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হবে যাতে তারা নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারেন কাকে নিয়োগ দেবেন। তার ভাষায়, ফার্মার জানে, সে খুনিকে নিয়োগ দেবে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যারা ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে খামারে কাজ করছেন, তাদের হঠাৎ করে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, যা কৃষকদের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতে, এই বাস্তবতা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প মনে করেন প্রস্তাবিত অস্থায়ী পাস ব্যবস্থা অভিবাসীদের জন্য একটি সাময়িক স্বস্তি আনতে পারে। তবে এই ঘোষণার মধ্যে প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ দ্বৈত অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জুন মাসে হোটেল, কৃষি ও রেস্তোরাঁ শিল্পে কর্মরত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আইস অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলেও, কয়েকদিন পরই আবার তা চালু করা হয়। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের মুখপাত্র জানিয়েছেন, যারা সহিংস অপরাধীদের আশ্রয় দেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে আইস’র কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেন, তাদের জন্য কোনো নিরাপদ স্থান থাকবে না।
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অভিবাসন আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ অব্যাহত থাকবে। হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র স্পষ্ট করে বলেছেন, যে কেউ অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন, তারা নির্বাসনের ঝুঁকিতে আছেন। অর্থাৎ, অভিবাসীদের জন্য সাময়িক কিছু সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হলেও দীর্ঘমেয়াদে আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। এপ্রিলে ট্রাম্প আরেকটি ধারণা দেন, যেখানে অবৈধ অভিবাসীরা চাইলে দেশ ছেড়ে গিয়ে বৈধ প্রক্রিয়ায় পুনরায় প্রবেশ করতে পারবেন। সেইসঙ্গে প্রশাসন এইচ -২এ (কৃষি) ও এইচ -২বি (অ-মৌসুমী শ্রমিক) ভিসা প্রোগ্রামগুলো উন্নত করার কথাও বিবেচনা করছে বলে জানা যায়। এই দুটি প্রোগ্রাম মূলত কৃষি, পর্যটন ও নির্মাণ শিল্পে বৈধভাবে অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগের একটি আইনি পথ।
এদিকে মানবাধিকার ও অভিবাসন নীতি পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলো এই নতুন উদ্যোগকে দ্ব্যর্থপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। তারা বলছে, এ ধরনের ‘অস্থায়ী পাস’ বা সীমিত বৈধতা প্রকৃত নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারবে না। বরং এটি অভিবাসীদের আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলবে, যেখানে একদিকে তারা কাজ করছেন, আর অন্যদিকে সবসময় গ্রেপ্তার ও নির্বাসনের ভয়ে রয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি, রেস্তোরাঁ এবং হোটেল খাত অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এই খাতগুলোতে স্থানীয়রা কাজ করতে অনাগ্রহী হওয়ায় অভিবাসী শ্রমিকরাই মূল শ্রমশক্তি হিসেবে কাজ করছেন। তাই অভিবাসীদের হঠাৎ সরিয়ে দিলে উৎপাদন ও সেবাখাতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
তবে মূল প্রশ্ন থেকে যায়-এই অস্থায়ী পাস কতটা কার্যকর হবে এবং কী ধরনের আইনি কাঠামোর মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হবে? এখন পর্যন্ত হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। ফলে এটি রাজনৈতিক বার্তা, নাকি বাস্তব নীতিমালা-তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্থায়ী পাস পরিকল্পনা একদিকে কৃষকদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে, অন্যদিকে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনে নতুন দুশ্চিন্তার ছায়া ফেলতে পারে। এই নীতির সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন মানবিকতা, আইনি স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা নইলে এটি হয়ে উঠতে পারে আরেকটি অস্থিরতা ও বিভ্রান্তির উৎস।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতিতে এক ধরনের বিপরীতমুখী অবস্থান। কারণ, একদিকে প্রশাসন অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে, অন্যদিকে আবার নির্দিষ্ট শিল্পে শ্রমিক সংকটের কারণে কিছু নীতি নমনীয় করার কথাও বলছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিখাতে অভিবাসী শ্রমিকদের উপর ব্যাপক নির্ভরতা রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা ভোরবেলা ৪টার মধ্যে কাজে হাজির হন এবং দীর্ঘ সময় মাঠে কাজ করেন। সেই বাস্তবতায় ট্রাম্প প্রশাসনের অস্থায়ী পাস পরিকল্পনা কৃষি খাতের জন্য স্বস্তির বার্তা হতে পারে, তবে এর আইনি কাঠামো, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এখনো অনিশ্চিত।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, অভিবাসন নীতিতে এমন দ্বৈত মানসিকতা অভিবাসীদের জীবনে আরও অনিশ্চয়তা ও ভীতি সৃষ্টি করবে। তারা সরকারের কাছে স্থায়ী ও মানবিক ভিত্তিক নীতিমালার দাবি জানাচ্ছে, যাতে অভিবাসী শ্রমিকরা ন্যায্য মর্যাদা ও সুরক্ষা পেতে পারেন। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন সত্যি কী ধরনের অস্থায়ী পাস চালু করে, এবং সেটি কতটা কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গতভাবে বাস্তবায়িত হয়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিখাত ও হোটেল-পর্যটন শিল্পে অভিবাসী শ্রমিক ছাড়া উৎপাদন ও পরিষেবা কার্যক্রম টিকিয়ে রাখা একেবারেই কঠিন।
এই ‘অস্থায়ী পাস’ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণকারী অভিবাসীরা বৈধভাবে কর পরিশোধ করলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী আইনি মর্যাদা বা নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ পাবেন না-এটি স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এর ফলে এক ভয়ংকর বাস্তবতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন মানবাধিকার বিশ্লেষকরা। কারণ, যখন কোনো ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে আইনগত সুরক্ষা ও নাগরিক মর্যাদা ছাড়া শ্রম দিচ্ছেন, তখন তা একপ্রকার অর্থনৈতিক বা আধুনিক দাসত্বের রূপ নিতে পারে। এই অভিবাসীরা হঠাৎ গ্রেপ্তার, নির্বাসন কিংবা শোষণের ঝুঁকিতে থাকবেন, অথচ উৎপাদন ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে তারা নিরলস পরিশ্রম করে যাবেন। এভাবে আইনি নিরাপত্তাবিহীন একটি শ্রমশক্তি গড়ে উঠলে তা যুক্তরাষ্ট্রে একটি শ্রম দাস শ্রেণির জন্ম দিতে পারে। যারা কাজ করবেন, কর দেবেন, কিন্তু নাগরিক অধিকার বা স্থায়ী মর্যাদা পাবেন না। এই বৈষম্যমূলক কাঠামো শুধু মানবাধিকারের প্রশ্নই তোলে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেও চ্যালেঞ্জ করে।