বাংলাদেশের অভিনয় অঙ্গনে এক সময়ের অবিচ্ছেদ্য নাম জাহিদ হাসান। কমেডি, ট্র্যাজেডি কিংবা ক্ল্যাসিক-সব ধরনের চরিত্রেই সাবলীল ছিলেন তিনি। কিন্তু এক সময় হঠাৎ করেই আড়ালে চলে যান। পর্দায় একরকম অনুপস্থিত থাকেন দীর্ঘদিন। নতুন প্রজন্ম যখন ওটিটির মাধ্যমে ছকভাঙা গল্পে অভিনয় করছে, তখনই ‘আমলনামা’ ও ‘উৎসব’-এর মতো কাজ দিয়ে আবার আলোচনায় ফিরেছেন। তবে এই ফেরা সহজ ছিল না। কোথাও গিয়ে নিজেকে ‘বিপরীত সময়ের শিল্পী’ বলেও ভাবতে হয়েছে তাকে। এসব নিয়ে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: পর্দায় আপনার দীর্ঘ অনুপস্থিতি। একটা সময় কি নিজেকেই অপরিচিত মনে হতে শুরু করেছিল?
জাহিদ হাসান: একদম। নিজেকে যখন নিজের জায়গায় খুঁজে পাই না, তখন সেটা খুবই অস্বস্তিকর। চারপাশে নতুন মুখ, নতুন ছন্দ, নতুন এক দুনিয়া। অথচ আমি যাকে ভালোবাসি- অভিনয়, সেটা তো বদলায়নি। কিন্তু জায়গা বদলে গেছে। যাদের সঙ্গে পথচলা ছিল, তাদের অনেকেই আর পাশেই নেই। কেউ ডাকেও না। তখন মনে হতো, আমি কি ভুল ছিলাম?
প্রশ্ন: এমন না যে আপনি কাজ করতে চান না, বরং কেউ আগ্রহ দেখায় না-এটাই কি আসল যন্ত্রণা?
জাহিদ হাসান: হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমি তো কাজ চাই, কিন্তু কাউকে গিয়ে বলতেও পারি না। একটা সময় ছিল, যখন নির্মাতারা বলতো, ‘এই চরিত্রে শুধু জাহিদ ভাইই লাগবে।’ এখন সেই কথাগুলো শোনা যায় না। যেন আমি আর দরকারি নই। আমি তো বসেছিলাম না, সব সময় প্রস্তুত ছিলাম। শুধু ডাকটা আসেনি।
প্রশ্ন: নতুনদের কাছে কি আপনাদের প্রজন্ম ‘পুরোনো পাতার ইতিহাস’ হয়ে গেছে?
জাহিদ হাসান: অনেকের আচরণ থেকে তাই মনে হয়। ওরা ভাবে, তারাই রাজা, বাকি সবাই ইতিহাস। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যারা সময় পার করে আজও টিকে আছেন, তাদের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ থাকা দরকার। এই শিল্পের ভিত তো তারাই তৈরি করেছেন। আমরা না থাকলে ওরা এতোটা মসৃণ পথ পেতো কি না, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
প্রশ্ন: এতো বছর কাজ করেছেন, এখনো কি নিজেকে প্রমাণ করতে হয়?
জাহিদ হাসান: এটাই সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। আপনি তিন যুগ ধরে নিজেকে প্রমাণ করেছেন, কিন্তু হঠাৎ করে সবাই যেন ভুলে গেল আপনি কী করতে পারেন। আরেকবার সুযোগ না পেলে আপনি দেখাবেন কীভাবে? আমি তো রানিং খেলোয়াড়, কিন্তু বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন: যখন কেউ আপনাকে ডাকে না, তখন সময় কীভাবে কাটান?
জাহিদ হাসান: তখন সময় কাটে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। অনেক রাত জেগে থেকেছি, ভাবতাম-সব ভুল করলাম কি? যারা আমার হাত ধরেছিল, তারাই পেছন ফিরে তাকায় না। কষ্ট হয়। কিন্তু আবার নতুন করে নিজেকে বোঝাই, এটা শেষ নয়। আমি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখি, তিনি সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নেন।
প্রশ্ন: ‘উৎসব’-এর মতো ছবিতে আপনি একেবারে ভিন্ন একটা চরিত্রে। চ্যালেঞ্জিং ছিল?
জাহিদ হাসান: খুব। প্রথমে স্ক্রিপ্ট পড়ে কিছুটা অস্থির হয়েছিলাম। চরিত্রটা সরাসরি ভালো বা খারাপ কিছু নয়। একজন মানুষ, যিনি জীবনে বহু ভুল করেছেন, আবার ভালোবাসতেও শিখেছেন। এই রকম চরিত্র করতে গেলে শিল্পীর আত্মা দিয়ে কাজ করতে হয়। আমি সেভাবেই করেছি।
প্রশ্ন: ছবির মুক্তির সময় আপনি হাসপাতালে। মিশ্র অনুভূতি ছিল নিশ্চয়ই?
জাহিদ হাসান: অসম্ভব। বাইরে ছবি হিট করছে, মানুষ হলে হলে ঢুকছে, আর আমি শুয়ে আছি হাসপাতালের বিছানায়। দেখতে কেউ আসতেও পারে না। আমার ভেতর একদিক থেকে আনন্দ, আবার অন্যদিকে প্রচণ্ড কষ্ট-আমি ছবিটা দেখতে পারছি না, অনুভব করতে পারছি না।
প্রশ্ন: চরিত্রে ‘ভিলেনের মতো’, তবু দর্শক সংযুক্তি পাচ্ছে। এটা কেন?
জাহিদ হাসান: কারণ ওই মানুষটাই দর্শক। সে ভুল করে, আবার ভালোবাসে। সে নিজের স্বার্থে কিছু করে, আবার বিবেকের টানেও ভোগে। ছবির ভূতগুলো আমাদের আত্মোপলব্ধি। আমি যখন চরিত্রটা করছিলাম, মনে হচ্ছিল আমি নিজেকেই আবিষ্কার করছি।
প্রশ্ন: কাজের জন্য শুধু প্রতিভা না, সম্মানও জরুরি-আপনি কি তা সব সময় পেয়েছেন?
জাহিদ হাসান: সব সময় না। অনেকেই ভাবেন, শিল্পী মানেই কাজ করলেই হলো। না, এটা একটা সম্মানজনক সম্পর্ক। আমাকে যদি কেউ সম্মান না দেয়, আমি কষ্ট পাই। টাকা বড় বিষয় নয়, কিন্তু সম্মান ছাড়া কাজ করা আমার কাছে অসম্ভব।
প্রশ্ন: নতুন প্রজন্ম নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
জাহিদ হাসান: তারা অনেক প্রতিশ্রুতিশীল। আগ্রহ আছে, সাহসও আছে। কিন্তু গভীরতা আনতে হলে সময়ের দরকার। ধৈর্য লাগে। আমি শুধু চাই তারা যেন কাজটাকে সম্মানের জায়গা থেকে করে।
প্রশ্ন: সামনে আপনাকে কী ধরনের চরিত্রে দেখতে চাইবে দর্শক?
জাহিদ হাসান: আমি নিজেও জানি না। তবে আমি অপেক্ষায় আছি এমন কিছু চরিত্রের, যেগুলো শুধু অভিনয় নয়, আমার ভেতরের মানুষটাকেও চ্যালেঞ্জ করবে। আমি এখন ‘কম কিন্তু গভীর’ কাজ করতে চাই। শুধু পরিমাণ দিয়ে নয়, মান দিয়ে নিজেকে তুলে ধরতে চাই।