২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ১০:০২:০৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কি সমঝোতার ইঙ্গিত
চায়ের কাপে ঝড়
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০৭-২০২২
চায়ের কাপে ঝড়


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক মন্তব্যে চায়ের কাপে ঝড়। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিকে ‘চা খাওয়াবেন সংক্রান্ত এক বক্তব্যে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা, চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যে রসবোধ নতুন কিছু নয়। পদ্মা সেতু-সংক্রান্ত এক বক্তব্যে একবার বেগম খালেদা জিয়াকে ‘পদ্মা সেতু থেকে টুস করে ফেলে দেয়া’ কিংবা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মা সেতু থেকে ফেলে চুবিয়ে ওঠানো-সংক্রান্ত বক্তব্য দিয়ে সমালোচনা তৈরি করেছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রেসকনফারেন্সেও তিনি অনেক হাস্যরস করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেই সবসময় ভাবগম্ভীর থাকবেন এমনটা তো নয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তারও তো কথা বলে মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্যাপাসিটি থাকবে। তবে এগুলোকে অনেকেই তার সহজ-সরল উক্তি হিসেবেই ধরে নেন। 

আবার সিরিয়াসও ভাবেন। তবে এবারের বক্তব্যটাকে একেবারে হাস্যরস বোধের মধ্যে ফেলে দিতে চান না অনেকেই। যে বক্তব্যটা তিনি দিয়েছেন, দেশের একটা ক্রাইসিস মুহূর্তে তার ওই বক্তব্যে অনেকেই গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও সে দলের প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা সময়েই বিএনপির অস্তিত্ব নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। এটা অবশ্য রাজনৈতিক কৌশল। শুধু তিনিই নন সুযোগ পেলে একে অপরের বিরুদ্ধে বলার কৌশলটা কেউই ছাড়েন না।  

দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপামর মানুষ যেখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা সমঝোতার রাজনীতির মাধ্যমে দেশে বিরাজমান সংকট মোকাবিলার স্বপ্ন দেখছে, সেখানে কিন্তু দুই দল দীর্ঘদিন যাবৎ দুই মেরুতে। করোনা-পরবর্তী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। অনেকের চাকরি নেই। ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। আয়-রোজগার কমেছে। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ তো মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যাবার অবস্থা। জ্বালনি সংকটে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশও পুড়ছে সে সংকটে। ফলে এমন সংকটটাকে অনেকেই ‘জাতীয় সংকট’ হিসেবেই অভিহিত করে ঐক্যবদ্ধ মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন। সেখানে সরকার আর বিরোধীদল নয়। সবাই যে যার অবস্থান থেকে দেশের স্বার্থে কাজ করবে। কিন্তু এমন মুহূর্তেও দুদলের মধ্যে অনেকটাই তেলে-জলে অবস্থা। এরই মধ্যে বিএনপির অস্তিত্ব নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য এটা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে তো প্রতিনিয়ত রয়েছেই। 

এমতাবস্থায় জনগণের কাক্সিক্ষত সেই সমঝোতার রাজনীতির স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন যেখানে, সে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর মুখে বিএনপিকে ‘চা খাওয়াবেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার রহস্য খোঁজার চেষ্টা করছেন অনেকেই। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৩ জুলাই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের যৌথসভায় তাঁর সরকারি বাসভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্যে বলেন,আমি তো বলে দিয়েছি, তারা (বিএনপি) যদি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে আসে, পুলিশ যেন বাধা না দেয়। বিশেষ করে বাংলামোটরে বাধা দেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। আসুক না হেঁটে হেঁটে যতোদূর আসতে পারে। আমি বসাবো, চা খাওয়াবো। কথা বলতে চাইলে শুনবো। কারণ আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তারা সেটা তো করেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, তারা কথা যতো পারুক, বলুক। যদি সারাদিন কথা বলার পরও বলে, আমাদের কথা বলতে দেয় না। মিটিং করে লোক হয় না, বলে আমাদের লোক আসতে দেয় না। অভিযোগ তো তারা করে। কিন্তু তাদের কাছে লোক আসবে কেন? কোন আশায় আসবে? তিনি বলেন,তবে যদি বোমাবাজি ও ভাঙচুর করে, সেটি করলে বাধা দেবো এবং উপযুক্ত জবাব পাবে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কোনো বাধা নেই। সেটা তো করেই যাচ্ছে। 

তবে যেভাবেই বলুক না কেন, প্রধানমন্ত্রী যে কথাগুলো বলেছেন, সেটা বিরাজমান রাজনীতিতে একটা সমঝোতার ইঙ্গিত হিসেবেই মনে করছেন অনেকেই। মূল সমস্যা তো একটাই। নির্বাচন প্রক্রিয়া। বিএনপি বলছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তারাই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন এবং সেটা হবে ইভিএমে। এখানে আরেকটি বিষয় হলো উন্নয়নসহযোগী দেশসমূহ। ওই দেশগুলোর একটিই কথা, সব দলের অংশগ্রহণে হবে একটি অবাধ নির্বাচন। যাতে সাধারণ নাগরিক তাদের নেতা বেছে নিতে পারেন। উন্নয়নসহযোগীদের শর্ত বা চাওয়ার সঙ্গে বিএনপি ও তাদের সমমনাদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের বিষয় আমরা নিজেরা (বিএনপিসহ অন্য বিরোধীদল ও ক্ষমতাসীন দল) বসে সমাধান করতে পারি। এখানে অন্য কাউকে নাক গলাতে দেয়া উচিত নয়। এটাও ঠিক নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারলে অতিউত্তম। কিন্তু বিগত দুই নির্বাচনে (২০১৪ ও ২০১৮) কী তেমন কিছু হয়েছে? ছিটেফোঁটাও ছিল না বিরোধী মতকে সম্মান দেখানোর। ফলে বিশ্বাসটা সেখানেই নষ্ট হয়ে গেছে। 

প্রধানমন্ত্রী এরপরে বলেছেন, আবার একটু অন্যস্টাইলের কথা। বিএনপির নেতৃত্বে এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারী, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারি ও অর্থপাচারকারী রয়েছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। আরো বলেছেন, ‘দেশে একটা মানুষও পায়নি তারা নেতা বানাতে? দলটির গঠনতন্ত্রের ৭ অনুচ্ছেদে আছে, সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়, তাহলে দলটির নেতা হতে পারবে না। কিন্তু বিএনপি তাই করেছে। তারপরও তারা কথা বলছে।’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনী সংস্কার করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যদি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো শৃঙ্খলা এসে থাকে, সেটা আওয়ামী লীগের হাত ধরে হয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী-গুণী যাঁরাই কথা বলেন, তাঁরা কি এটা চিন্তা করেছেন ৩০০ সিটে যদি একটা দল সাড়ে ৭০০ মনোনয়ন দেয়, তাহলে তাদের নির্বাচন কী করে হয়? একজন বিএনপি অফিস থেকে দিচ্ছে, আরেকজন লন্ডন থেকে, আরেকজন গুলশান অফিস থেকে দিচ্ছে। যারা এভাবে নির্বাচন করে, তারা নির্বাচনে জিতবে কী করে? বিএনপির দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক বিদ্যুতে বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়। যোগাযোগের অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে এনেছে। পরপর তিনবার ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশ আজ উন্নয়নশীল।’ 

ফলে প্রধানমন্ত্রীর ‘চা’ খাওয়ানোর অভিলাষটাতে যতোটুকু না আশার আলো দেখা গিয়েছিল, তার চেয়ে খানিকটা বেশি গা-জ্বালা হয় বিএনপির। অমন বক্তব্যের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, (প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে) ‘এসব হালকা কথা বলে লাভ নেই, চা-টা খাওয়ার কথা বলে লাভ নেই। একটাই কথা, পদত্যাগ করুন।’ পরের দিন রোববার বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (অ্যাব) আলোচনা সভায় বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা দিন। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে দেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন, যেন সত্যিকার অর্থে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।’ 

তিনি বলেন, ‘এক বিদ্যুতেই কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেয়া হয়েছে। টেন্ডার ছাড়া প্ল্যান্ট হবে, এ বিষয়ে কাউকে প্রশ্ন করা যাবেন না, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। যেখানে ইনডেমনিটি দেয়া হয়, সেখানে আপনি কী করে আশা করতে পারেন দুর্নীতি হবে না? ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়’ খনার বচনটি তুলে ধরে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘এখন এই বচন এতোই যথার্থ যে শাসকদের দুর্নীতি, লুটপাট, তাদের অশিক্ষা, ব্যর্থতাসব মিলিয়ে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। অথচ তাদের মুখের ভাষা কী। তারা বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানিয়ে দিচ্ছে, মালয়েশিয়া বানিয়ে দিচ্ছে। কানাডা, সানফ্রান্সিসকোও বানিয়ে দিচ্ছে।’

শ্লেষের সুরে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে কোনো কোনো জায়গা আছে, আমি নাম উল্লেখ করতে চাই না। যেখানে গেলে আপনার মনে হবে আসলেও বোধহয় তা-ই।’ 

দুই দলের কথার যুদ্ধটা চলছে বেশ ভালোই। তবে চিরাচরিত গ্রামগঞ্জের ঐতিহ্য একবাড়ি থেকে অন্যবাড়ি বা একজন অন্যজনের কাছে গেলে অন্তত এক খিলি পান দেয়। সময়ের তাড়াহুড়ায় চলে যেতে চাইলেও আফসোসের সুরে বলবেন- একটু পান খেয়ে গেলেন না? কালচারটা এখনো আছে সিনিয়র সিটিজেনের মধ্যে। সেটা রূপান্তরিত হয়ে বর্তমান সমজে এখন ‘চা’। বাসায় আসলে তো বটেই- রাস্তায় পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে অফার করার রীতি, চলেন এক কাপ ‘চা’ খান। এটা কোনো দাওয়াত নয়। তাৎক্ষণিক আয়োজন। তাৎক্ষণিকের আতিথেয়তা। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এটা বেশ রয়েছে। চা বা পান খাওয়ার আপ্যায়নটা মন থেকেই দেয়া হয় বাংলাদেশে। এখানে মশকরা বা কূটচালের জন্য বা কাউকে বাজে নজরে দেখার জন্য হয়ে থাকে না। মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথমোক্ত (চা খাওয়ানোর) কথাটাতে বেশ আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছেন। ফলে এ নিয়ে সর্বত্র আলোচনা। তবে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণটা কোন উদ্দেশ্যে সেটা হয়তো আরো সময় অতিবাহিত হলেই ঠাহর করা যাবে।


শেয়ার করুন