২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০২:৩৯:১৪ পূর্বাহ্ন


ইসির সঙ্গে ডিসি-এসপিদের হট্টগোলে ম্যাসেজ কী
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-১০-২০২২
ইসির সঙ্গে ডিসি-এসপিদের হট্টগোলে ম্যাসেজ কী


ডিসি-এসপিদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে গিয়ে কিছু অভিযোগ করে বসেন ইসিরা। কিন্তু সেগুলো ভালো লাগেনি ডিসি-এসপিদের। তারা মনে করেছেন, ইসির বক্তব্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগতুল্য। জবাবে ডিসি-এসপিরাও অভিযোগের তীর ছুড়েছেন ইসির বিরুদ্ধে। এতে করে হৈ চৈ, শোরগোল, হট্টগোল, জনৈক ইসি বক্তব্যের মাঝপথে ডায়াস থেকে নেমে যাওয়া এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে ৬৪ জেলার ডিসি-এসপির সঙ্গে ইসির  সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন সিইসি হাবিবুল আউয়াল। এতে উপস্থিত ছিলেন চার নির্বাচন কমিশনার- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান (অব.), বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান, ইসি সচিব, ডিসি-এসপি ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন ও পুলিশ সদরদফতরের অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম। 

মূলত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রোডম্যাপ ঘোষণার পর যা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে প্রধান ভূমিকা রাখবেন সেই জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপারদের (এসপি) আলোচনায় বসে নির্বাচন কমিশন। গত ৮ অক্টোবর আগারগাঁওয়ে ডিসি-এসপিদের ডেকে তাদের সঙ্গে সম্মেলন করে নির্বাচন কমিশন। সেখানে ‘নিরপেক্ষতা’ ও অন্যান্য বিষয়ে পুলিশের বিপক্ষে অভিযোগ করা হয় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। আবার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও উঠে আসে পুলিশের জমে থাকা অভিযোগ। 

ডিসি-এসপিদের প্রতি নির্দেশনা কী 

১৪-১৫ মাসের মতো বাকি আগামী সংসদ নির্বাচনের। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের নির্বাচন অনেকটাই ভিন্ন। প্রতিটা সংসদ নির্বাচন এলেই নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব বেড়ে যায়। তবে এবারে তাদের চ্যালেঞ্জ অনেকটাই প্রচ- ও চাপ সামাল দেয়ার বিষয়। সেটা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিরপেক্ষ হওয়ার চ্যালেঞ্জ, নির্বাচনে অংশ নেয়া সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও দাতা দেশসমূহের আস্থা অর্জন। কেননা উল্লিখিত প্রতিটা স্থান থেকেই প্রচ- চাপ ইতিমধ্যে এসে পড়েছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। এতে করে অধিকতর চ্যালেঞ্জের মুখে সিইসি হাবিবুল আউয়াল কমিশন। বিশেষ করে বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সনের জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের যে ভূমিকা সেটা সমালোচিত। ফলে সে প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের ওপর একটা বিশ্বাসহীনতা তৈরি হয়েছে। সে থেকে মুক্ত হতে যায় আগামী নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন। 

এতে করে ১২তম জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশন হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, দল নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে হবে। এমন কাজ করা যাবে না, যাতে মনে হবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন। একইসঙ্গে আগামী নির্বাচনে এ সকল শীর্ষ কর্মকর্তাদের সার্বিক কর্মকা- ইসি পর্যবেক্ষণে রাখবে বলেও সতর্ক করেন হাবিবুল আউয়াল।  

ওইদিন প্রায় তিনঘণ্টাব্যাপী ওই সম্মেলনে চার নির্বাচন কমিশনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্টরাও উপস্থিত ছিলেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার দরুণ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না আইজিপি। 

সম্মেলনে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ 

তিন ঘণ্টা স্থায়ী ওই বৈঠকে কী হয়েছে? বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কয়েকজন কথা বলেছেন। তেমনি নির্বাচন কমিশনারাও তাদের বক্তব্যগুলো রেখেছেন। এখানেই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ হয়, যা বিতর্কে রূপ নিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হস্তক্ষেপে শান্ত হয়।                                                  

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সম্মেলনে ডিসি-এসপি তাদের বক্তব্যে জানিয়েছেন, নির্বাচন গ্রহণে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয় পুলিশকে। সেখানে কেন্দ্রের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রায় অসম্ভব। এছাড়াও প্রতিকূল আবহাওয়ায় নানা সমস্যাও হয়। 

সে সময় সে পরিস্থিতি মোকাবিলায় যাতায়াতসহ বেশকিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। ফলে এখানে বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন। যে বাজেট দেয়া হয় সেটা দিয়ে মাঠপর্যায়ের ওই সকল কাজ সম্পাদন করা ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। ফলে বাজেট বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেন তারা। কিন্তু এ বিষয়ে নির্বাচন কশিনার মো. আনিছুর রহমান তার বক্তব্যে ডিসিদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা দাবির কথা বললেন, আমরা ইসির পক্ষ থেকে যে টাকা দিই তাও তো আপনারা সঠিকভাবে বণ্টন করেন না। ম্যাজিস্ট্রেটদের তেলের টাকাও আপনারা দেন না। তাঁর এ বক্তব্যের সময় ডিসিরা দাঁড়িয়ে হৈ চৈ শুরু করেন। বেশ কয়েকজন ডিসি নির্বাচন কমিশনারের এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। বলেন, আপনি যাচাই করে দেখেন আমরা  দেই কি-না। এ সময় হট্টগোল সৃষ্টি হয়। তখন আনিছুর রহমান বলেন, তিনি তথ্যপ্রমাণ নিয়েই কথা বলছেন। এ পর্যায়ে আনিছুর রহমান বলেন, এখন জেলা পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় এ নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ আসছে। কিন্তু এসব বিষয়ে আপনারা কিছুই বলছেন না। অভিযোগ আছে, কর্মকর্তারা মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেন। 

সংলাপেও এ অভিযোগ এসেছে ইসির কাছে। এই নির্বাচন কমিশনার কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার প্রশ্ন তুলে বলেন, কর্মকর্তারা কি নপুংশক, নখদন্তহীন হয়ে পড়েছেন? তিনি একজন এসপির উদাহরণ দিয়ে বলেন, মাত্র ১৮ দিন হলো একজন এসপি জয়েন করেছেন। আমার পদবি মনে হয় এসপির চেয়েও ছোট, তিনি (এসপি) আমার সঙ্গে দেখাও করেননি। তাঁর বক্তব্য চলাকালে বৈঠকে থেমে থেমে হৈ চৈ হয়। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে আনিছুর রহমান কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা যদি আমার বক্তব্য শুনতে না চান, তাহলে আমি বক্তব্য দেবো না। তখন কর্মকর্তারা কেউ কেউ ‘না’ ‘না’ সূচক ধ্বনি দেন। এ পর্যায়ে বক্তব্য থামিয়ে আনিছুর রহমান মঞ্চে তাঁর নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসে যান। 

অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্যে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, নির্বাচন কমিশনার সম্মেলনে তার বক্তব্যের একটি অংশে ক্লিয়ার ম্যাসেজ দিয়েছেন ডিসি-এসপিদের। তিনি বলেছেন, আপনারা সরকারের অবাধ্য হবেন না। কিন্তু সরকার ও দলের মধ্যে প্রভেদ বিবেচনায় রেখে দলনিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। আপনারা কেবল সরকারি কর্মচারী নন, গণকর্মচারীও। আমরা সরকারি কর্মচারী নই, কিন্তু গণকর্মচারী। দলীয় সরকারের অধীন মনে করে নিজেদের দলীয় কর্মী বা সমর্থক ভাববেন না বা এমনভাবে আচরণ করবেন না, যাতে সরকারি বা গণকর্মচারী হিসেবে আপনাদের দলনিরপেক্ষতা জনগণের দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সরকার ও দল এক নয়। 

আলোচনা সভা শেষে সিইসি সংবাদ সম্মেলন করেন। অন্য তিন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর সিইসির সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে এলেও আনিছুর রহমান ছিলেন অনুপস্থিত।

সাংবাদিকদের যা বললেন সিইসি 

নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে ডিসি-এসপিদের সম্মেলন শেষে সিইসি হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই। সেই সঙ্গে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছি- দল নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করতে হবে। এমন কাজ করা যাবে না, যাতে জনগণ মনে করে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছেন।’

কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনের সময় ইসির অবস্থান থাকবে কঠোর। মাঠ কর্মকর্তাদের কাজও পর্যবেক্ষণ করা হবে। দায়িত্ব পালনে কোনো শৈথিল্য সহ্য করা হবে না। সিইসি বলেন, আমরা কঠোর ভাষায় বলছি- ভয়ভীতি, পক্ষপাতিত্ব, চাপ বা অন্য যে কোনো কারণে নির্বাচনে অবৈধ হস্তক্ষেপ প্রতিহত করতে না পারলে নির্বাচন হবে না; প্রহসন হবে। পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে। এতে সংসদ নির্বাচনে জনগণের আগ্রহ, আস্থা ও অংশগ্রহণ উৎসাহিত হবে বলে মনে করেন সিইসি।

তাহলে ইসির কথা মানবেন তো ডিসি-এসপিরা 

দায়িত্ব গ্রহণের পর এ প্রথম কাছে ডেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে একটা রোডম্যাপ ও নির্দেশনা দেয়ার জন্য এ সম্মেলন। কিন্তু সেখানে পাল্টাপাল্টি যে বক্তব্য বা কথা এসেছে এতে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ইসির কথা শুনবেন তো ডিসি-এসপিরা? জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বাকি প্রায় ১৪ মাস। এক্ষুনি যদি ইসির কথার জবাবটা হৈ চৈয়ের মাধ্যমে দিতে হয়, তাহলে এর মাধ্যমে একরকম ক্ষোভই প্রকাশ পেলো ইসির বিরুদ্ধে। ঠিক একইভাবে মাঠ প্রশাসন যারা দেখভাল করেন সে ডিসি-এসপিদের ওপর যে অভিযোগ সবার সামনে করেছেন এক ইসি। সেটা মোটেও শোভনীয় কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ সবাইকে এক পাল্লায় মাপা যেমন উচিত নয়, তেমনি যে অভিযোগের তীর সেটা সব জেলার ডিসি-এসপিরা করবেন এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই বলে ঢালাওভাবে অভিযোগ স্বাভাবিকভাবেই ডিসি-এসপিদের প্রেস্টিজ ইস্যু। সব মিলিয়ে এ দুইয়ের ঐক্য না হলে কখনই একটা জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এখনো ঢের বাকি সময়। এরপরও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনও এদের মাধ্যমেই সামাল দিতে হবে। ফলে দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই এমন পরিস্থিতির তৈরির দায়ভারটাই আসলে কার? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এমন ঘটনায় কী ম্যাসেজ পেলো সাধারণ জনগণ?

শেয়ার করুন