২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৬:১৪:২৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


ডেটলাইন ঈদের পর!
কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৫-২০২২
কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে


ঈদের ব্যস্ততা সর্বত্র। ৩০ দিন সিয়াম সাধনার পর অনেকেই গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে গিয়েছেন। সেখানে তাদের ব্যস্ততা। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে অবস্থানকারীরাও এবার একটু নিঃশ্বাস নিতে পারছেন। কারণ গত দুই বছর পর করোনার কোনো বিধিনিষেধ নেই। ফ্রি মুভ করতে পারছেন সর্বত্র। তাই ঘুরে বেড়ানোর প্ল্যান বিভিন্ন পর্যটন স্পট কিংবা প্রিয়জনের কাছে।

এর মধ্যেও একটা ছোট্ট দুশ্চিন্তা তো রয়েই গেছে। সেটা ঈদের পর কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ঈদের আগে বেশ কিছুদিন থেকেই এমন একটা কথা বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। ঈদের পর আন্দোলনের মাঠে নামা। এ বাক্যটা একটা কালচারেই পরিণত। বাস্তবিক অর্থে তেমন কিছুই দেখা যায়নি কখনই। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটা মনে হচ্ছে কিছুটা ভিন্ন। 

এমনিতেই সরকারের রয়েছে কিছু দুর্বলতা। দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও বিভিন্ন চাপ। নিষেধাজ্ঞার কবলে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটা সংস্থা। এছাড়াও যে বিষয়টা এখন সবার কাছে ষ্পষ্ট হওয়ার অপেক্ষা সেটা আগামী নির্বাচনটা কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে সেটা। কারণ বিরোধীদলগুলোর দাবি বর্তমান সরকার পদত্যাগ করে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান করবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। সরকারের সেটাতে ডাইরেক্ট ‘না’।

একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন এ দাবি। বিরোধীদলসমূহের মধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বলেই দিয়েছে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ, সরকারের অধীনে ব্যতীত নির্বাচন হবে এক তরফা। যা ২০১৪ ও ২০১৮ সনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মানুষের ভোট দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। ফলে সেটা চলবে না। মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হতে হবে। এ জন্যই এ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে চলবে না। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে বিরোধীদলসমূহের দাবি অযৌক্তিক। তাছাড়া তারা গণবিচ্ছিন্ন। দেশ সুন্দর চলছে। উন্নতির জোয়ারে ভাসছে দেশ। ফলে এ সরকারকেই মানুষ সর্বদা প্রত্যাশা করে। 

এখানে আরো একটা বিষয় বিদেশি বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহ। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও তাদের সকল মিত্রদেরও প্রচণ্ড চাপ সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচন। পূর্বের দুইবারের ন্যায় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য স্বীকৃতি তারা দেবে না। আর সে গ্রহণযোগ্যতা না হলেও তারাও গুটিয়ে নেবে তাদের বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার হাত। কিন্তু বিরোধীদলসমূহও বলে দিয়েছে তারা তাদের দাবি না মানলে নির্বাচনে যাবে না পূর্বের মতোই। ফলে এই যে দুই মেরুতে দু’পক্ষের অবস্থান। এবং বিদেশিদের চাপ। সব মিলিয়ে একটা ভয়ার্ত অবস্থা বিরাজ করছে। 

বিরোধীপক্ষের মধ্যে বিএনপির নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু রাজশাহীতে বলেছেন, ঈদের পরে কঠোর আন্দোলনে নামবেন তারা। বিএনপির অন্যান্য নেতারা এভাবে বলেনি। যেমনটা বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ঈদের পরে। ঈদের আগে ও পরে, বৃষ্টির আগে ও পরে এবং রোজার আগে ও পরে- আমি এই কথায় বিশ্বাস করি না। কারণ আন্দোলন চলমান। আন্দোলন কখনো কখনো বেগবান হয় আবার কখনো কখনো ধীরে হয়। আর কখনো কখনো আন্দোলন কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করে।’ তিনি ওই সময় আরো বলেন, একযুগেরও বেশি সময় ধরে আমরা এই আন্দোলনটা করছি। এই আন্দোলনের লক্ষ্য একটা। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।

আবার যেমনটা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ঈদের পর সরকার পতনের কঠোর আন্দোলন শুরু হবে। তিনি বলেন, আমরা বড় পরিসরে ঐক্য করবো। আমাদের সে ঐক্যের যাত্রাও শুরু হয়ে গেছে। যত দ্রুত হওয়া প্রয়োজন সেটা হচ্ছে না। তবে ঈদের পর সেটা আরো বেগবান করার উদ্যোগ নিয়েছি। গণতন্ত্র উদ্ধারে এ সরকারকে হটাতে আমরা ঈদের পর মাঠে নামবো। 

একইভাবে আরো অনেকেই একইটোনে কথা বলছেন। ঈদের আগে বিরোধীদলের সমমনা অন্তত সাতটি দল এক সঙ্গে বসে তারা তাদের ঐক্য ও সরকার পতনের আন্দোলনে নামার ব্যাপারে কিভাবে এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো যায় সেটা নিয়ে আলোচনা করে ঐকমত্য হয়েছেন। 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল দীর্ঘদিন থেকেই সরকার পতনের আন্দোলনে মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত হতে বলে আসছেন দলীয় নেতা-কর্মীদের। যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন ২০ দলীয় জোটের অনেকের সঙ্গেই। তিনি সর্বশেষ যে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা একদফা। অর্থাৎ এ সরকারের পতনের আন্দোলন। যদি তারা পদত্যাগ করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি মেনে নেয় তাহলে তো কথাই নেই। নতুবা আন্দোলন। তবে বিরোধীদলের এ ধরনের বক্তব্যে চুপ করে বসে নেই সরকার দলের লোকজনও। 

যেমনটা ঈদের পর অন্যান্য দলকে নিয়ে আন্দোলনে নামার যে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি সে প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, তাদের আন্দোলন কোন ঈদের পরে? আমরা গত ১২-১৩ বছর ধরে ঈদের পরে, রোজার পরে, বার্ষিক পরীক্ষার পরে, শীতের পরে, বর্ষার পরে তাদের আন্দোলন হবে এ রকম শুনে আসছি। তাই কোন ঈদের পরে সেটি একটু খোলসা করলে ভালো হয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সরকার পতন আন্দোলনের ঘোষণা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেছেন, দেখতে দেখতে ১৩ বছর। বিএনপির আন্দোলন হবে কোন বছর? তিনি পহেলা মে, এক অনুষ্ঠানে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন,জনগণ যাদের ক্ষমতার উৎস তাদের অন্য কারো শক্তির কাছে জিম্মি হতে হয় না। ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, বিদেশে আওয়ামী লীগের বন্ধু আছে, কোনো প্রভু নেই। ফলে ঈদের পরে কী হচ্ছে এটা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যেই একটা কথার যুদ্ধও শুরু হয়েছে। 

এটাও তো ঠিক, যে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলন ও নিজ ঘর ঠিক করতে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই মাঠে। তৃণমূলে তাদের কমিটিগুলো করছে। বিরোধগুলো মিটাতে বিএনপির শীর্ষ ও দায়িত্বশীলরা কাজ করে যাচ্ছে। এবং সেটাকে তারা শেষের দিকেই প্রায় নিয়ে এসেছেন। দলটির এটা একটা বড় সফলতা। 

বসে নেই আওয়ামী লীগেও। দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটির তৃণমূলে রয়েছে অনেক বিভাজন। একদল সুবিধাভোগী, অন্যরা বঞ্চিত। সুবিধাভোগীদের দলে হাইব্রিড বেশি। এটা নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্টি। ওগুলো মেটানোর জন্য দায়িত্ব দিয়ে তৃণমূলে পাঠানো হলেও তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। তবে ঠিক, নির্বাচনের ঘোষণা এলে এগুলোর অনেকই এমনিতেই মিটে যায়। 

তবে দিন যত যাচ্ছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই সরকারে অস্বস্তি বাড়ছে। বিশেষ করে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাটা ভীষণভাবে সমস্যা তৈরি করেছে। যা আরো স্পষ্ট হয়েছে ভারতের কাছে মার্কিন ওই নিষেধাজ্ঞা উঠাতে মার্কিনিদের রাজি করানোর অনুরোধ বা সহায়তা প্রার্থনায়। ওই সংস্থায় স্বাভাবিকভাবেই একটা অস্বস্তি। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওই অস্বস্তি ক্ষমতাসীনদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। 

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ক্রাইসিস মুহূর্ত বিরাজ করছে। ক্রমশই সবকিছু ধাবিত হচ্ছে একটা অনিশ্চয়তার দিকে। মানুষও উদ্বিগ্ন। কী হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার বিরোধীদের ঈদের পরে আন্দোলনের ঘোষণা বা ওই সময়টা নিয়ে নানা কথাবার্তা একইভাবে সে কথাগুলো আমলে নিয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জবাবদান সেটা রাজনীতির ভাষা ব্যবহার করেই হোক আর উস্কানিমূলক হোক এগুলো মানুষের মধ্যে একটা ভীতি তৈরি করবে বৈকি! 

পরিস্থিতি একেবারে সহজ সেটা কিন্তু নয়। নানা সমীকরণ চলছে রাজনীতির মাঠে। এখনো নির্বাচনের প্রায় দেড় বছরের মতো বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে নির্বাচন ইস্যুতে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হতে চলছে। সম্প্রতি, এক অনুষ্ঠানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এর আগে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতও সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অংশগ্রহলমূলক তথা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান না হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। 

এটাও ঠিক, বিদেশি কূটনীতিকরা সরাসরি বলতে পারেন না। তবে গণতন্ত্রের স্বার্থে তারা যেটুকু বলছেন, তার তাৎপর্য অনেক। তাছাড়া গত ডিসেম্বরে র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কিছুদিন পরও একটা খবর বেরিয়েছিল যে ওই স্যাঙ্কশন ওখানেই শেষ নয়। আরো প্রায় হাজার ছাড়িয়ে মানুষের ওপর মার্কিন স্যাঙ্কশন হতে পারে। সত্য হোক আর মিথ্যা। এমন খবর কিছুটা হলেও ভীতি ছড়ায়। এর সঙ্গে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা তাগিদ তো অবশ্যই রয়েছে।

যেহেতু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানো। পরের বারও যদি সেটা হয়, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ভয়াবহ একটা খবর। কারণ বাইডেন প্রশাসন ঘোষণাই দিয়েই নির্বাচনে এসেছিল। যে বিশ্বের যে সমস্ত স্থানে বা দেশে গণতন্ত্র নেই, সেখানে সেটা প্রতিষ্ঠা করবেন তারা। বিশ্বের অনেক দেশেই ওই সমস্যা।

কিন্তু সেটা যদি সত্যিই প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ নেয় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সে প্রভাব পরাটাই স্বাভাবিক। যে যাই বলুক না কেন, বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিনিদের উপেক্ষা করা চাট্টিখানি কথা নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের ভূমিকাটা দেখলেই আর বিস্তারিত ব্যাখ্যা না করলেও চলে। সেখানে না হয় তেল-গ্যাসের একটা বড় স্বার্থ জড়িয়ে। কিন্তু ভূ-রাজনীতিতে (তাদের বড় শত্রু চীনের প্রভাব ঠেকাতে) এখন বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা অঞ্চল। বাইডেন প্রশাসনের নজর যে বাংলাদেশের প্রতি নেই এটা ভাবা ভুল।


শেয়ার করুন