৩০ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ০৮:০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের প্রতিভা বিকাশে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা রাখা যাবে না’ সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬


পয়সা দেখলাম কিন্তু জীবনে সুখ দেখলাম না
২৯ বছর পর স্থায়ীভাবে ফিরে গেলেন বেলাল উজ্জামান
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-১২-২০২৩
২৯ বছর পর স্থায়ীভাবে ফিরে গেলেন বেলাল উজ্জামান এয়ারপোর্টে বেলাল উজ্জামান (মাঝে)


বেলাল উজ্জামান। তিনি স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় এসেছিলেন ১৯৯৪ সালে। ভিজিট ভিসাতেই এসেছিলেন। অন্য আরো ১০ জনের মতো স্বপ্ন ছিল গ্রিনকার্ড হবে, প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে যাবেন, স্ত্রী-সন্তানদের দেখবেন এবং এক সময় সুযোগ হলে তাদের নিয়ে আসবেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন গত ২৯ বছরেও পূরণ হয়নি। অবশেষে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। একাকী জীবনে মৃত্যুকেও খুব কাছ থেকে দেখেছেন, যে কারণেই দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। হয়নি সেই কাঙ্ক্ষিত গ্রিনকার্ড। এক মিথ্যাবাদী এবং প্রতারকের চক্করে পড়েছিলেন। সেখানেই তার গ্রিনকার্ডের স্বপ্নের সমাধি। মরীচিকার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় প্রিয়তমা স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপরও এক ছেলে এবং এক মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমেরিকায় থেকে যান। কিন্তু গত ১৫ নভেম্বরের পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন দেশে চলে যাবেন এবং গত ৩ সিডেম্বর হুইল চেয়ারে করে তিনি বাংলাদেশে চলে যান।

সিলেট শহরের আখালিয়ার সন্তান বেলাল উজ্জামান ১৯৯৪ সালে আমেরিকায় আসার পর নিজ এলাকার একজন প্রতারকের চক্করে পড়েন। বেলাল উজ্জামানকে বলেন, তিনি এই দেশের ইমিগ্রেশন সম্পর্কে জানেন। বাংলাদেশে ল’ নিয়ে লেখাপড়া করেছে। তিনি বেলাল উজ্জামানের আবেদনটি করে দেবেন। বেলাল উজ্জামানও তার কথা রাজি হয়ে যান এবং বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য দিয়ে আবেদনও করা হয়। এক সময় বেলাল উজ্জামান জানতে পারেন যে, তার কেইস ডিনাইড হয়ে গিয়েছে। তাকে কোর্টের যাওয়ার যে তারিখ দেওয়া হয়েছিল ওই তারিখও জানায়নি প্রতারক লোকটি। এক সময় বেলাল উজ্জামান কোর্টে যান। তাকে রোজডেল কোর্টে পাঠানো হয়। তিনি সেখানে যাওয়ার পর জানতে পারেন যে, তার দেরি হয়ে গিয়েছে এবং তাকে ডিপোর্টেশন লেটার ধরিয়ে দেওয়া হয়। কি আর করবেন, অন্য আরো কাগজপত্রহীন বাংলাদেশির মতো তিনি বসবাস করতে থাকেন। যে কারণে তিনি এখন যারা আমেরিকায় আসছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, কখনো কোনো মিথ্যা এবং গোজামিল তথ্য দেবেন না। তাতে করে আপনাদের ক্ষতি হতে পারে। তিনি আরো বলেন, যারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করবেন তারা যেন জেনে বুঝে এবং ভালো আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করেন। যদিও বেলাল উজ্জামানকে শেষ সময়ে একজন জুইস আইনজীবী সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি তা গ্রহণ করেননি।

বেলাল উজ্জামান যখন বাংলাদেশ থেকে আসেন, তখন দেড় বছর বয়সের একটি মেয়ে এবং ১৫ দিন বয়সের একটি ছেলে ছিল। ছেলের নাম নাজিম চৌধুরী এবং মেয়ের নাম নাদিয়া চৌধুরী। ইতিমধ্যেই নাদিয়া চৌধুরীর বিয়ে হয়ে যায়। সে এখন তার স্বামী নিয়ে ফ্রান্সে থাকেন। ছেলে নাজিম চৌধুরীও বোনের সঙ্গে ফ্রান্সে। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অনেক দিন সে আমার জন্য অপেক্ষা করেছে। এক সময় আমার স্ত্রী আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়। আমার ছোট বোন আমার সন্তানদের লালন পালন করে।

বেলাল উজ্জামান ম্যানহাটনে একটি ডেইলি স্টোরে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। বললেন, ভালোই বেতন পাই। কোনো অসুবিধা নেই। তিনি আরো বলেন, আমি জীবনে কারো কাছ থেকে অর্থ নিইনি। পারলে সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে সাহায্য করেছি। তিনি থাকতেন জ্যামাইকার একটি বাসায়। এই বাড়ির মালিক বাংলাদেশি কমিউনিটির অত্যন্ত পরিচিত মুখ, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক কর্মকর্তা ও রূপসী চাঁদপুর ফাউন্ডেশনের সাবেক সভাপতি ফারুক হোসেন মজুমদার। ফারুক হোসেন মজুমদার বলেন, আমি বাড়িটি যখন ক্রয় করি তখনো তিনি এই বাসার বেজমেন্টে থাকতেন। আমি বাড়ি ক্রয় করার পর তিনি আমাকে বললেন, আপনার কোনো অসুবিধা না হলে আমি এখানে থাকতে চাই। ফারুক হোসেন মজুমদার বলেন, তিনি আমাকে ভাগনে ডাকতেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তবে তার মধ্যে অশান্তি তা আমি জানতাম। তাকে আমি আগেও বলেছি সিলেট শহরে আপনার পাঁচতলা বাড়ি আছে, বনশ্রীতে তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে, সম্পত্তি আছে, ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আপনি চলে যান। কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি। কারণ বউ চলে যাওয়ার কারণে তার মধ্যে অভিমানের জন্ম নিয়েছে। অবশেষে সব অভিমান ভুলে তিনি দেশে যেতে রাজি হলেন।

তারও একটি কারণ আছে। গত ১৫ নভেম্বর বাসার বেজমেন্টে তার রুমে থাকা অবস্থায় তিনি স্ট্রোক করেন। বেলাল উজ্জামান জানান, স্ট্রোক করার পর আমি ৮ থেকে ৯ ঘণ্টার মতো ফ্লোরে পড়েছিলাম। তবে আমার জ্ঞান ছিল। কিন্তু নড়তে চড়তে পারছিলাম না। এমনকি ফোনটি পর্যন্ত ধরতে পারছিলাম না। তিনি বলেন, আমি যখন নড়তে-চড়তে পারছিলাম না তখন আমাকে পায়খানা এবং প্রস্রাব রুমেরই করতে হয়েছে। আমার শরীরের একটি সাইড অবশ হয়ে যায়। ওই অবস্থায় বেজমেন্টে থাকা পাশের রুমের লোকজন বাসায় আসে। তাদের নাকে গন্ধ লাগে। প্রথমে তারাা এয়ারফ্রেশনার ছাড়ে, কিন্তু কোনোভাবে গন্ধ যাচ্ছে না। পাশে লোকজনের ডাকাডাকিতেও তিনি সাড়া দিতে পারছিলেন না। ওই অবস্থায় লোকজন বাড়ির মালিক ফারুক হোসেন মজুমদারকে ফোন করেন। ফারুক হোসেন মজুমদার বাসায় গিয়ে বেলাল উজ্জামানকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে তিনি তালা খুলে দেখতে পান যে, বেলাল উজ্জামান ময়লাসহ ফ্লোরে পড়ে রয়েছেন। ফারুক হোসেন মজুমদার বলেন, আমি তাকে বললাম অ্যাম্বুলেন্স কল করবো কি না। তিনি ইশারা দিলেন অ্যাম্বুলেন্স কল করার জন্য। অ্যাম্বুলেন্স কল করার পর তারা আসে এবং তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি বলেন, তার ওপর আল্লাহর রহমত আছে, তা না হলে স্ট্রোক করার ৮/৯ ঘণ্টা কারো বেঁচে থাকার কথা নয়। হাসপাতাল থেকে তাকে রিলিজ করা হয়েছে। যদিও এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। তার শরীরের ডান দিকে এখনো নর্ম। এই অবস্থায় বেলাল উজ্জামান সিদ্ধান্ত নেন তিনি দেশে ফিরে যাবেন। দেশ প্রতিনিধির এক প্রশ্নের জবাবে বেলাল উজ্জামান বলেন, নানা টেনশনে আমার স্ট্রোক হয়েছে। আমি আর নিতে পারছিলাম না। তিনি বলেন, আমি তো মরেও পড়ে থাকতে পারতাম। এমন করুণ মৃত্যু আমি চাই না। আমি মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। যে কারণে আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশ থেকে আসছে, তারা যেন আমার ভুল না করে। কোনো প্রতারকের খপ্পড়ে না পড়ে। জীবনের একটি ভুল জীবনকে ধ্বংস করে দেবে। তিনি বলেন, আমি ঠিকই পয়সা দেখলাম, কিন্তু সুখ দেখলাম না। আমার মতো যেন অন্য কারো জীবনে এভাবে ধ্বংস হয়ে না যায়, সেজন্য আপনাকে কাহিনিটি শেয়ার করলাম।

শেয়ার করুন