২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৪:০২:০০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


জাতীয় পার্টি, না অন্য কেউ সংসদের বিরোধী আসনে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০১-২০২৪
জাতীয় পার্টি, না অন্য কেউ সংসদের বিরোধী আসনে


৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দ্রুততম সময়ে সব কার্যাদি সম্পন্ন হচ্ছে। নির্বাচনে বিজয়ীদের গেজেট প্রকাশ, শপথ গ্রহণ, মন্ত্রিপরিষদ গঠন এবং তাদেরও শপথ-এক কথায় সবকিছুই সম্পন্ন। এবার সংসদ অধিবেশনের পর্ব। সেটাও ঘোষণা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। জানুয়ারির ৩০ তারিখে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হবে। ওই দিন বিকেল ৩টায় রাজধানীর সংসদে বসছে ওই অধিবেশন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদের (১) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ অধিবেশন আহ্বান করেছেন বলে গত ১৫ জানুয়ারি সোমবার সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। এ সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শুরু হবে ওইদিন থেকে, যা শেষ হবে ২০২৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। 

নিয়মানুসারে সংবিধান অনুযায়ী বছরের প্রথম ও নির্বাচনের পর প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন। পরে ওই ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেবেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সবকিছুই ঠিকঠাক চললেও একটা স্থানে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়ে আছে। সংসদে বিরোধীদল হবে কারা। আর বিরোধীদলীয় নেতাও হবেন কে? এ মুহূর্তে কোটি টাকার প্রশ্ন এটা। গত সংসদে বিরোধীদলের আসনে ছিল প্রায়াত রাষ্ট্রপতি হুসেন মুহাম্মাদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি। এবার মাত্র ১১ সিট পেয়েছে তারা। নিয়ামানুসারে সরকার গঠন করা দলের পর যারা বেশি আসন পাবে, তারাই হবে বিরোধীদল। সে দলের নেতা হবেন বিরোধীদলীয় নেতা। কিন্তু জাতীয় পার্টির ১১ আসন এবার নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনধারী দল নয়। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯ আসনের মধ্যে ২২৩টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ। এছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি, জাসদ একটি ও ওয়ার্কার্স পার্টি একটি এবং কল্যাণ পার্টি একটি আসনে জয় পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২ আসনে বিজয়ী হয়েছেন। ফলে এখানে প্রধান বিরোধীদল হওয়ার কথা স্বতন্ত্র। সমস্যা হলো এবারের নির্বাচনে যারা স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, তারা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই নেতা। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওপেন ছিল নির্বাচন করার ব্যাপারে। দলীয় মনোনয়নের বাইরে যেয়ে নির্বাচন করার কারণে ওই ৬২ আসন আওয়ামী লীগের হয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতে এসেছেন। তাহলে এই স্বতন্ত্র মোর্চা যদি গঠিত হয়। এবং সেখান থেকে একজন বিরোধীদলীয় নেতা সিলেক্ট করা হয়, তাহলে সংসদে যে লাউ সে কদুই হয়ে গেল। কিন্তু নিয়মানুসারে এর বাইরে যাওয়ারও তেমন সুযোগ নেই। যদিও আইনবিদরা বলছেন, সংসদে বিরোধীদল কে হবে এ ব্যাপারে ব্যাপক কোনো বিশ্লেষণ নেই। 

ক্ষমতাসীন দলের সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিরোধীদলীয় উপনেতাও হয়েছেন ইতিমধ্যে মতিয়া চৌধুরী। তবে এটা ঠিক, বিরোধীদলীয় নেতা কে হবেন সেটাও সরকার পক্ষই ঠিক করবেন এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যে স্বতন্ত্র থেকে বিজয়ী এ কে আজাদকে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার আহ্বান জানানো হলে তিনিও সম্মতি দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে সরকারপ্রধানের নির্দেশনা অমান্য করবেন না বলেই জানা গেছে। 

তবে জাতীয় পার্টি কম আসন পেলেও বিরোধীদলীয় আসনে বসতে উদগ্রীব হয়ে আছে বলে জানা গেছে। কারণ সংসদে বিরোধীদলের মর্যদাও অনেক। বিরোধীদলীয় নেতার সম্মানও বেশি। সব মিলিয়ে অনেক সিট হারিয়ে দলের মধ্যে প্রচণ্ড চাপে থাকা দলটি কোনমতে সম্মানরক্ষার্থে এখন বিরোধীদল হতে লবিং করছে বলে জানা গেছে। তবে এক্ষেত্রে সরকার প্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর সব নির্ভর করবে। 

তবে কী হবে এটা এক্ষুণি অনুমান করা না গেলেও সংসদ বসার আগে হয়তো এটা সুরাহা করে ফেলা হবে। এদিকে রাজনীতি ও আইন বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামতে জানাচ্ছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চাইলে বিরোধীদল হিসেবে থাকতে পারেন। এতে কোনো বাধা নেই। আবার তারা যেহেতু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত, তাই তারা নিজ দলেও যোগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। 

ওবায়দুল কাদের যা জানালেন 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হওয়ার পর বিরোধীদল কারা, অলরেডি বিরোধীদল জাতীয় পার্টির তো অনেকেই জিতেছেন, ১৪ দলেরও দু’জনের মতো জিতেছেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তো দূরে নয়। যিনি লিডার অব দ্য হাউজ হবেন, তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। 

সংসদে বিরোধীদল কারা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের রহস্যের হাসি দিয়ে বলেন, পদ্ধতিটা কেন আপনাকে বলব? নতুন সরকার বসুক। সংশ্লিষ্ট যারা আছে, তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করবেন। সব বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী, নতুন লিডার অব দ্য হাউজ পরিস্থিতি, বাস্তবতা, করণীয় বিষয়ে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য সবাইকে অপেক্ষায় থাকতেও অনুরোধ করেন তিনি। 

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ব্যাখ্যা 

আইন ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দ্বাদশ সংসদে বিরোধীদল কারা হবে, তা নির্ধারণ করছে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের অবস্থানের ওপর। স্বতন্ত্ররা যদি মনে করেন, তারা সরকারের সঙ্গে না থেকে নিজেরা একটা মোর্চা করবেন। অবশ্যই তারা সেটা করতে পারবেন। তখন বিরোধীদল হিসেবে কাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, সেটা জানা যাবে; কিন্তু আমার মনে হয়, বিরোধীদল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন প্রয়োজন। স্বতন্ত্রদের যথেষ্ট আসন আছে। ৬২টি আসনে তারা জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্ররা তো আওয়ামী লীগেরই, তাহলে বিরোধীদলও একই দলের হয়ে গেল না-এই বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, যারা স্বতন্ত্র নির্বাচিত হয়েছেন তারা আওয়ামী লীগ হিসেবে নির্বাচিত হননি। তাদের প্রতীকও ভিন্ন ছিলো (ঈগল, কেটলি, ট্রাক প্রভৃতি)। নৌকা মার্কায় কেবল আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। কাজেই স্বতন্ত্ররা আওয়ামী লীগার, এটা মুখের কথা হতে পারে, কিন্তু আইনের কথা বা বাস্তবতার কথা সেটা না। 

আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও প্রায় একই কথা বলছেন। তাদের মতে আইনে এটা ‘সম্ভব’। সংসদে বিরোধীদল কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার স্পিকারের। 

অতীত অভিজ্ঞতা 

স্বতন্ত্রের জোট করার ঘটনাও রয়েছে নিকট অতীতে। ২০১৪ সালে বিএনপির বর্জনের সুযোগে সংসদে সেই মর্যাদা পায় জাতীয় পার্টি। সেবার ৩৪টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে জোরালো অবস্থান নেওয়া রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে যোগ দেয় বিএনপি ও তাদের শরিকরা। 

জাতীয় পার্টি তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করেই নির্বাচনে যায়, আসন পায় ২২টি। বিএনপি ও তাদের জোটের আসন ছিল আটটি। সে নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি মহাজোট থেকে বেরিয়ে এসে আবার বিরোধীদলে বসে। বিরোধীদলীয় নেতা হন পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার মৃত্যু পর আবার বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন রওশন এরশাদ। 

১৯৮৮ সালে বিতর্কিত চতুর্থ জাতীয় নির্বাচনের পরও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে ২৫১টি আসনে জয় পেয়েছিল। অন্যদিকে জাসদের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধীদল পেয়েছিল ১৯টি আসন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছিল ২৫টি আসন। এছাড়া জাসদ তিনটি ও ফ্রিডম পার্টি দুটি আসন পায়। জাতীয় পার্টি ক্ষমতা নেওয়ার পর, ফ্রিডম পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন জাসদ নেতা আ স ম আব্দুর রব।

শেয়ার করুন