০৪ মে ২০১২, শনিবার, ০২:০৬:৩২ অপরাহ্ন


নিজ দল শরিকদের ভোট ডাকাতির অভিযোগে বিব্রত আ.লীগ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০১-২০২৪
নিজ দল শরিকদের ভোট ডাকাতির অভিযোগে বিব্রত আ.লীগ


ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সানজিদা খানম। হেরে গেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আওলাদ হোসেনের কাছে। কিন্তু এই সানজিদা খানম গণমাধ্যমে বলেছেন, নির্বাচনে ফল বিপর্যয় নয় বরং প্রতিপক্ষের ভোট ডাকাতি আর কারচুপির কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরেছেন। সানজিদা খানম আরো জানান, প্রতিপক্ষ আওলাদ হোসেনের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো ভোট দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ তার হাতে আছে। এগুলো নিয়ে তিনি শান্তিপূর্ণ আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। সানজিদা খানম বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছিলাম আমি। মাত্র ২২ হাজার ভোট পাওয়ার মতো প্রার্থী আমি নই।


ভয় দেখিয়ে, অবৈধভাবে ব্যালটে সিল মেরে, সন্ত্রাসী কায়দায় ভোট কেন্দ্র দখল করে, সহকারী রিটার্নিং অফিসারের অস্থায়ী কার্যালয়ে গিয়ে অফিসারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, হুমকি-ধমকি দিয়ে ২৪ হাজার ভোট পেয়েছেন আওলাদ হোসেন। তিনি তার অবৈধ টাকার জোরে ১০ লাখ পোস্টার ছাপিয়ে আমার ১ লাখ পোস্টার ঢেকে দিয়েছিলেন। তার প্রত্যেকটি অপকর্মের রেকর্ড আমার কাছে আছে। তিনি জানান, নির্বাচনের দিন রাত সাড়ে ১১টায় টেলিভিশনের স্ক্রলগুলোতে ঢাকা-৪ আসনে বিজয়ী প্রার্থী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হচ্ছিল। তার কাছে সেগুলোর স্ক্রিনশট নেওয়া আছে বলে জানান। 

এদিকে একিই দিনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী, দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস গণমাধ্যমে স্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করেছেন। তিনি হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কাঁচি মার্কার মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে। মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল কাঁচি প্রতীকে পেয়েছেন ৮৯ হাজার ৭০৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস পান ৮২ হাজার ৮৩৩ ভোট।

হেরে যাওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের এই হেভিওয়েট প্রার্থী, দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তিদাস বলেন, নির্বাচনে কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকি নির্বাচনে হারার পর তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা অমানবিক অত্যাচার এবং নিপীড়ন চালালেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন না। আক্ষেপ করে বলেন, বিএনপি-জামায়াত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়েছিল সেই বর্বরতাকেও এখন হার মানাচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তিদাস বলেন, ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের কমপক্ষে ৪০ শতাংশ ভোট রয়েছে। এই ৪০ শতাংশের মধ্যেও যখন আওয়ামী লীগের কোনো জেলা পর্যায়ের নেতা ভাগ বসান, তখন বলতেই হয় আমার নিশ্চিত বিজয়কে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

এসেছে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ

নেত্রকোনা-৩ (কেন্দুয়া-আটপাড়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অসীম কুমার উকিল। অসীম কুমার উকিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়নে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর প্রতিপক্ষ ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এবার মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র লড়েন। ২ হাজার ২৫৩ ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হন। এব্যাপারে অসীম কুমার উকিলের অভিযোগ ‘দল এবং ভোটের মাঠ দুটোই আমার পক্ষে ছিল। কিন্তু দুটি কারণে আমাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। টাকা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে নির্বাচনের মাঠে আমার অবস্থান দুর্বল করার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমার প্রতিপক্ষ তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। ভোটের মাঠে প্রচুর টাকা ছড়ানোর পাশাপাশি আমার ভোটব্যাংককে নিরুৎসাহ করতে আমাকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের মাঠ আমার পক্ষে থাকলেও সব মহলের আশীর্বাদ থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এদিকে নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে বলে অভিযোগ করেছিল বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এক বিবৃতিতে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এ অভিযোগ করেছিলেন, বেশ কিছু প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্প্রদায়ের নাম উল্লেখ করেও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও হুমকি দিয়ে ভোটকেন্দ্রে না যেতে বলা হয়েছে। আবার কোথাও বলা হয়েছে, ভোটকেন্দ্রে গিয়ে বিশেষ মার্কায় ভোট দিতে হবে, নইলে খবর আছে। হুমকিদাতাদের নির্দেশ অনুযায়ী কেন্দ্রে গেলে বা না গেলে পরবর্তী সময়ে দেখে নেওয়া হবে বলেও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শরিকদের মুখেও অভিযোগ

আওয়ামী লীগ এবারের নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলে প্রচার করছে না খোদ দলটির নেতৃত্বাধীন জোটের অন্যতম শরিক জাসদ সভাপতি ও কুষ্টিয়া-২ আসনের নৌকার প্রার্থী হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ আসনের নৌকার প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা কারচুপিসহ প্রশাসন সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ, বরগুনা-১ আসনের আওয়ামী লীগের পাঁচবারের এমপি ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, মানিকগঞ্জ-২ আসনের এমপি মমতাজ বেগম, কিশোরগঞ্জ-২ আসনের নৌকার প্রার্থী আবদুল কাহার আকন্দ কারচুপির অভিযোগ এসেছেন। রাজশাহী-২ আসনের নৌকা প্রতীকের পরাজিত প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা সিইসিকে দেওয়া অভিযোগে বলেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির নির্দেশে, সব ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুবিধাভোগীর কার্ড আটকে রেখে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাঁচি প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দিয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিজাম-উল আজিমকে এসব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যৌথবাহিনী আটকও করে। তবে অন্যান্য ওয়ার্ডে সেই একই প্রক্রিয়া চলমান থাকে। কুষ্টিয়া-২ আসনে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিপক্ষে পরাজিত হয়েছেন হাসানুল হক ইনু। তাঁর অভিযোগ, সিলেক্টিভ কারচুপি হয়েছে। তিনি বলেন, জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে পরাজিত হয়েছি। মমতাজের অভিযোগ, মানিকগঞ্জ-২ আসনে ভোটের হার অস্বাভাবিক ছিল। তিনি বলেন, ‘সিংগাইর উপজেলার বলধরা, বায়রা ইউনিয়ন ও সিংগাইর পৌরসভার কেন্দ্রগুলোতে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। বিদেশে আছে, মারা গেছে- তাদের ভোটও দেওয়া হয়েছে। অন্য জায়গায় পাস করলেও এসব এলাকায় অস্বাভাবিক ভোট হওয়ায় পরাজিত হয়েছি।

বিব্রত ক্ষমতাসীনরা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মাত্র ক্ষমতায় বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে আর্ন্তজাতিক মহল থেকে দাবি উঠেছে নতুন নির্বাচনে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিয়ে নতুন করে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ছয়টি নাগরিক সংগঠন। এ আহ্বান জানিয়ে গত ১২ জানুয়ারি শুক্রবার একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছে সংগঠনগুলো। এতে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়। বলা হয় যে এই নির্বাচন যথাযথ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক-কোনোটিই হয়নি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমূহ ও আন্তর্জাতিক নির্বাচনী মানদন্ড মেনে এই নির্বাচন হয়েছে কি না, সে বিষয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। একসাথে বিবৃতি দেওয়া সংগঠনগুলো হলো এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (এএনএফআরইএল), ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন (সিআইভিআইসিইউএস), ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস (এফআইডিএইচ), এশিয়ান ডেমোক্রেসি নেটওয়ার্ক (এডিএন), ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রোজেক্ট (অস্ট্রেলিয়া) ও অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএএন)। এরও আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে রাইট টু ফ্রিডমের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম বি মাইলাম এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন নিয়ে আমরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম তাই সত্য হয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যরা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু নয় বলে মূল্যায়ন করেছে। উইলিয়াম বি মাইলাম এই বিবৃতি দিয়েছেন ৯ জানুয়ারি। অন্যদিকে সর্বশেষ ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘তবু প্রশ্ন’ শিরোনামে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে পঞ্চমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া শেখ হাসিনার জন্য এক ঐতিহাসিক কৃতিত্ব। কিন্তু নির্বাচনে বিরোধী দল যোগ না দেয়ায় তার বিপরীতে যারা জিতেছেন তারা সবাই স্বতন্ত্রপ্রার্থী। তবে তারা কোনো না কোনোভাবে সবাই আওয়ামী লীগের। নির্বাচনে শাসক আওয়ামী লীগ ও দলের স্বতন্ত্র গোষ্ঠী অংশ নিয়েছিলেন। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও এখানেই বিঁধে আছে তীক্ষè ও অমোঘ প্রশ্নবাণ। এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব শেখ হাসিনার জন্য। সবশেষের দিকে একটি আশঙ্কার কথা জানিয়ে পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রকে তার নিজের পথে চলতে না দিলে শেষ অবধি গণতন্ত্রই সবচেয়ে বিপন্ন হয়, ইতিহাস সাক্ষী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে যখন এমন কড়া বার্তা নাড়ছে তখন নিজ দল ক্ষমতার শরিকরা অর্থ্যাৎ সমমনাদের কন্ঠেও যখন এমন অভিযোগ উচ্চারিত হয় তখন বিষয়টা সরকারের জন্য শুধু বিব্রতকরই না বিপদজ্জনকও বটে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আওয়ামী আসলে দল আর শরিকদের এমন মন্তব্যে শুধু বিব্রতকরই নয় কিছুটা হোঁচটও খেতে পারে সামনে দিনগুলিতে পথ চলার ক্ষেত্রে।

শেয়ার করুন